মিজান রহমান

  ৩১ মে, ২০২৩

আসছে ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার বাজেট

ছবি : সংগৃহীত

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট ঘোষণা আসছে। ধারণা করা হচ্ছে ২০২৩-২৪ বাজেটের আকার হবে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।

বৃহস্পতিবার (১ জুন) অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করবেন। এবার বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ‘উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে।’

জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছে বুধবার (৩১ মে) বিকাল ৫টায়। এটি বর্তমান সরকারের মেয়াদের শেষ বাজেট। এ বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রয়াস ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা গুরুত্ব পাবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ বাজেটের আকার হবে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ধরা হচ্ছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে বাজেটে আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। বিভিন্ন কর থেকে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা আসবে। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর তথা আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও শুল্ক থেকে আসবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরবহির্ভূত কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক অনুদান থেকে আসবে ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। আসছে বাজেটের সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। অনুদানসহ বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। নিট বৈদেশিক ঋণ ধরা হয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণের নির্ভরতা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ।

নতুন অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের লক্ষ্য রয়েছে, যেখানে প্রায় ৬ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি। মোট বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা হবে জিডিপির ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ। ব্যয়ের জন্য রাজস্ব আয় থেকে আসবে ৫ লাখ কোটি টাকা। বাকি টাকা স্থানীয় ও বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হবে। জনস্বার্থে কিংবা দেশীয় শিল্পের সুবিধার্থে বিভিন্ন ধরনের পণ্যে শুল্ক ও কর আরোপ কিংবা ছাড়ের প্রস্তাব দেবেন অর্থমন্ত্রী। ফলে কিছু পণ্যের দাম কমতে পারে আবার কিছু পণ্যের দাম বাড়তে পারে।

এদিকে, একাদশ জাতীয় সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটির একাদশ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার জাতীয় সংসদ ভবনে কমিটির সভাপতি স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে সংসদের ২৩তম (২০২৩ খ্রিস্টাব্দের বাজেট) অধিবেশনের কার্যাদি নিষ্পন্নের জন্য সময় বরাদ্দ ও অধিবেশনের স্থায়িত্বকাল নিয়ে আলোচনা হয়। শুক্র ও শনিবার ব্যতীত প্রতিদিন বিকেল ৫টা এবং ১ জুন (আজ) বিকেল ৩টায় অধিবেশন বসবে মর্মে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। এ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর জন্য ৮৬টি ও অন্যান্য মন্ত্রীর জন্য ১ হাজার ৫৫৪টি প্রশ্নসহ ১৬৪০টি প্রশ্ন পাওয়া গেছে, বিধি-৭১ এ মনোযোগ আকর্ষণের নোটিস পাওয়া গেছে ৩২টি। বেসরকারি সদস্যদের কোনো বিলের নোটিস পাওয়া যায়নি। পূর্বে অনিষ্পন্ন বেসরকারি বিল ৮টি। ২২টি সরকারি বিলের মধ্যে কমিটিতে পরীক্ষাধীন ১১টি, পাসের অপেক্ষায় ৪টি ও অধিবেশনে উত্থাপনের অপেক্ষায় ৭টি।

এমন একসময় এ বাজেট পেশ করা হবে যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মুদ্রাস্ফীতি ঘটছে অর্থনীতিতে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জনগণকে ব্যাপক দুর্ভোগ সহ্য করতে হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আসন্ন বাজেট বক্তৃতায় ‘স্মার্ট বাংলাদেশের’ বিষয়ে রূপরেখাও তুলে ধরা হবে। বাজেট বক্তৃতায় ব্যবসা সম্প্রসারণের মাধ্যমে জনগণের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানানো হবে। এতে আইসিটি খাত, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত এবং স্মার্ট সিটিজেন তৈরির দিকে নজর দেওয়া হবে।

এ বাজেট আগের অর্থবছরের চেয়ে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হবে। এটি হবে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৮২ কোটি টাকার, যা প্রাক্কলিত জিডিপির ১৫ দশমিক ২১ শতাংশ। বর্তমান অর্থবছরে এটি ছিল ১৫ দশমিক ২৭ শতাংশ। ফলে বিশ্লেষকদের মতে, আগামী বাজেট উচ্চাভিলাষী নয়।

কর্মকর্তারা জানান, সরকারের সম্ভাব্য রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ কোটি টাকা, যা বিদায়ি অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা বেশি।

সামগ্রিক রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে এনবিআরকে ৪ দশমিক ৩০ লাখ কোটি টাকার রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হতে পারে। এরমধ্যে এনবিআর-বহির্ভূত উৎস থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা আসতে পারে। এছাড়া বাজেটে কর বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা।

সরকার এরই মধ্যে আগামী অর্থবছরের (২০২৩-২৪) জন্য ২ দশমিক ৬৩ লাখ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন করেছে। যার মধ্যে ১ দশমিক ৬৯ লাখ কোটি টাকা (৬৪ দশমিক ২৬ শতাংশ) স্থানীয় উৎস থেকে আসবে। বাকি ৯৪ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ ৩৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ আসবে বিদেশি উৎস থেকে।

স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও করপোরেশনের বরাদ্দ বিবেচনায়, আগামী অর্থবছরে সার্বিক আনুমানিক উন্নয়ন ব্যয় দাঁড়াবে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা।

প্রধান ব্যয়ের মধ্যে ৪ লাখ ৮৪ হাজার ২০৩ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয় হিসাবে রাখা হবে। যার মধ্যে ৯৪ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা সুদ পরিশোধে। ৮০ হাজার কোটি টাকা সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও ব্যয় বহনের জন্য। ভর্তুকির জন্য ১ দশমিক ১০ লাখ কোটি টাকা ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন, অনুদান হিসেবে তিন হাজার কোটি টাকার পাশাপাশি নিট বৈদেশিক ঋণ হিসেবে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯ কোটি টাকা পাওয়া যেতে পারে। বিদায়ি অর্থবছরে নিট বৈদেশিক ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা।

অর্থায়ন ঘাটতি মেটাতে সরকার আগামী বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেবে। যার অধিকাংশই হবে স্বল্পমেয়াদি ঋণ। এ অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হতে পারে ২৩ হাজার কোটি টাকা। যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নিম্নমুখী প্রবণতা থাকায় এই লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে।

আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সামগ্রিক আকার ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে। যা বিদায়ী অর্থবছরে ছিল ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা।

আগামী বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি হতে পারে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ঘাটতি মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। যার মধ্যে রয়েছে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা এবং বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ ১০ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। ভর্তুকির জন্য ১ দশমিক ১০ লাখ কোটি টাকার উচ্চতর বরাদ্দ করা হবে। সুদ দেওয়ার জন্য ১ দশমিক শূন্য ২ লাখ কোটি টাকা দেওয়া হবে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ছিল প্রায় ৮১ হাজার কোটি টাকা এবং সুদ পরিশোধের জন্য প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যের উচ্চমূল্য এবং টাকার অবমূল্যায়নের ধাক্কা সহনীয় করতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সরকার আগামী অর্থবছরেও কঠোরতা ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে পারে।

রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে করদাতার সংখ্যা বাড়াতে সারা দেশে বেসরকারি এজেন্ট নিয়োগসহ বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এজেন্টরা দ্বারে দ্বারে গিয়ে জনগণকে ট্যাক্সের আওতায় আনতে রাজি করাবেন। তারা জনগণকে ট্যাক্স ফাইল খুলতে ও রিটার্ন জমা দিতে সাহায্য করবেন। তবে এজেন্টরা কর আদায় করবেন না।

যাদের ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) আছে ও করযোগ্য আয়সীমার নিচে তাদের রিটার্ন জমা দিতে হবে ও ন্যূনতম ২,০০০ টাকা ট্যাক্স দিতে হবে।

করযোগ্য আয়ের সীমা বর্তমান ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩.৫০ লাখ টাকা করা হতে পারে। করযোগ্য আয়ের উপর ন্যূনতম কর ৫,০০০ টাকা একই থাকবে।

কর্মকর্তা বলেন, করযোগ্য আয় নেই এমন লোকদের তাদের টিআইএন বাতিল করার বিকল্প থাকবে। প্রায় ৮.৮ মিলিয়ন টিআইএন-ধারক আছে, কিন্তু মাত্র তিন মিলিয়ন তাদের রিটার্ন জমা দেয়। যারা রিটার্ন জমা দেন তাদের অনেকেই কর দেন না। কারণ তাদের আয় করযোগ্য নয়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, তারা রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য আরো ইলেকট্রনিক ফিসকাল ডিভাইস (ইএফডি) ইনস্টল করবেন। আগামী তিন বছরে তিন লাখ ইএফডি স্থাপন করা হবে। বর্তমানে ৯,০০০ ইএফডি চালু আছে।

পিডিএসও/এমএ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বাজেট,জাতীয় বাজেট
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close