হাসান ইমন

  ১৭ জানুয়ারি, ২০২১

ফ্লাইওভারের নিচে হতে পারে বিনোদনের স্থান

উন্নয়নের ছোঁয়ায় রাজধানীর অনেক বড় বড় সড়কের ওপর দিয়ে চলে গেছে ফ্লাইওভার। এতে ওপরটা কাজে লাগলেও বিশাল এসব স্থাপনার নিচে খালি পড়ে থাকছে বিপুল পরিমাণ জায়গা। যা পরিণত হয়েছে মাদকসেবীদের আড্ডাখানায়, হকার ও চা-পান বিক্রেতার দোকান, পিকআপ-ট্রাকের স্ট্যান্ড এবং আবর্জনার ভাগাড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে এসব জায়গা খালি পড়ে আছে, চলে যাচ্ছে অবৈধ দখলে, পরিণত হচ্ছে ময়লার ভাগাড়ে। তাই জায়গা বুঝে বিনোদনের স্থান, মাঠ ও সবুজায়ন করার পরামর্শ দিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। যদিও আপাতত সৌন্দর্যবর্ধনের দিকে নজর নগর কর্তৃপক্ষের।

এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মোহাম্মদ খান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ফ্লাইওভারের নিচে উঁচু বিভাজকে সৌন্দর্যবর্ধনের পরিকল্পনা ছিল মূল নকশায়। সেখানে ফুলের গাছ লাগানোর কথা ছিল। সেই পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত হয়নি। ফ্লাইওভারের নিচে ফাঁকা জায়গায় বাগান, বসার জায়গার জন্য ব্যবস্থা ছাড়াও নানা রকম নান্দনিক স্থাপনা তৈরির পরিকল্পনা ছিল। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় সেই ফাঁকা জায়গাগুলো গিলে খাচ্ছে দখলদাররা।

এ ব্যাপারে স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, এসব জায়গায় গণমানুষের বিভিন্ন বিনোদন কার্যক্রম ছাড়াও পথচারীবান্ধব হকারদের জায়গা তৈরি করা সবচেয়ে সেরা বিকল্প। তিনি আরো বলেন, ভারত, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের বড় শহরগুলোতে ফ্লাইওভারের নিচের জায়গাকে এমন দৃষ্টিনন্দন করে তোলা হয়েছে। সেখানে আছে পার্ক, লাইব্রেরি, জলাশয়সহ নানা আয়োজন।

যানজটের লাগাম টেনে ধরতে রাজধানী ঢাকায় সাতটি ফ্লাইওভার চালু রয়েছে। ২০০১ সালে দেশের সর্বপ্রথম খিলগাঁও ফ্লাইওভার নির্মাণ শুরু হলেও মহাখালী ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ আগে শেষ হয় এবং এটি খিলগাঁও ফ্লাইওভারের আগেই উদ্বোধন করা হয়। এরপরই একে একে বিজয় সরণি ফ্লাইওভার, কুড়িল ফ্লাইওভার, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, বনানী ও মগবাজার এলাকায় ফ্লাইওভার চালু হয়। যানজট কমাতে এগুলো বিশেষ ভূমিকা রাখলেও ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের রাস্তার প্রায় ২৮ কিলোমিটারজুড়ে রয়েছে ফ্লাইওভারগুলো।

সরেজমিন দেখা যায়, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে শনির আখড়া-যাত্রাবাড়ী অংশ ফলের দোকান, রিকশাভ্যানের স্ট্যান্ড, চায়ের দোকান, রুমাল-টুপির দোকানের দখলে। পুরোনো প্যাকিং বাক্স, ডাবের খোসা, পলিথিনের স্তর ঢেকে ফেলেছে নিচের বিভাজকের মেঝে।

টিকাটুলীর রাজধানী সুপার মার্কেট এলাকায় ফ্লাইওভারের নিচে ছিন্নমূল মানুষের বাস। কাপ্তানবাজার অংশে মুরগির খাঁচা ও বর্জ্যরে কারণে দুর্গন্ধে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে চলাই দায়। গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া অংশে ফ্লাইওভারকে ছাদ বানিয়ে জুতার দোকান, ফলের দোকান, ভাতের হোটেল বসানো হয়েছে। ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডের সামনে ফ্লাইওভারের নিচে বাসচালকদের ক্লাবঘরও গড়ে উঠেছে। বঙ্গবাজার থেকে নিমতলী গেটের আগ পর্যন্ত ঘোড়ার আস্তাবল আর ময়লার ভাগাড়। ঘোড়ার বিষ্ঠা আর পাশের মুরগির বাজারের বর্জ্যে প্রচন্ড দুর্গন্ধ ছড়িয়ে থাকে এলাকাজুড়েই। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের সায়েদাবাদের একটি বড় অংশ ইজারা দেওয়া হয়েছে বাসসহ বিভিন্ন যানবাহন রাখার জন্য। ফলে জায়গাটি অনেকটাই পরিণত হয়েছে বাস-ট্রাকের স্ট্যান্ডে। এই ফ্লাইওভারের ওয়ারী বিসিসি রোড অংশের চিত্র আরো অদ্ভুত। এখানে অস্থায়ীভাবে বসবাস করতে দেওয়া হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটির কয়েকশ পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে।

ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে চলাচল করেন যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘ময়লা আবর্জনার গন্ধে নিচ দিয়ে চলাই যায় না। সবাই ফ্লাইওভারের নিচে ময়লা ফেলে। কিন্তু কেউ পরিষ্কার করে বলে মনে হয় না।’

রাজধানীর মালিবাগ-মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচের ফাঁকা জায়গা দখল করে ভাতের হোটেল, গাড়ির গ্যারেজ, কুঁড়েঘর তৈরি করে চলছে ভাড়া খাটানোর জমজমাট ব্যবসা। এ ছাড়া মগবাজার রেলগেটে ফ্লাইওভারের নিচে জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে মোটরসাইকেলের গ্যারেজ। ফ্লাইওভারের মালিবাগ ও মগবাজার অংশের নিচে লোহার ব্যারিকেডের মধ্যেই নিরিবিলি আড্ডা ও মাদকের কারবারের স্পট বানিয়ে ফেলেছে মাদকাসক্তরা। দিনে প্রকাশ্যে এসব স্পটে মাদকের বেচাকেনা চলে। রাতে চলে যৌনকর্মীদের অবাধ বিচরণ। উত্তর শাহজাহানপুরে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচের অংশে চলছে রীতিমতো আসবাবপত্রের ব্যবসা। কয়েকজন দোকানদার জানান, এলাকার প্রভাবশালীদের খুশি রেখেই দোকান পেতেছেন তারা।

এফডিসির কর্মচারী রাশেদ বলেন, মাঝে মধ্যেই তিনি কাজ শেষে গভীর রাতে এফডিসি থেকে ফেরেন। তখন চোখে পড়ে যৌনকর্মীদের আনাগোনা। তিনি বলেন, ফ্লাইওভারের ব্যারিকেডের ভেতরেই পলিথিন দিয়ে ঘরের মতো আস্তানা তৈরি করে রেখেছে তারা। এ ছাড়া ফ্লাইওভারের নিচে মাদকাসক্ত ও ভবঘুরেদের আড্ডা এবং প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনা চলে। রাতে নিচ দিয়ে চলতে গেলে গা ছমছম করে।

এসব বিষয়ে ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ট্রাফিক) কাজী মো. বোরহান উদ্দিন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তা দখলমুক্ত করার জন্য অভিযান শুরু হয়েছে। এখন থেকে কাউকে আর নিচের রাস্তা দখল করতে দেওয়া হবে না। মাদকসেবী ও হকারদের হটিয়ে কিছু জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছিল। এই কাঁটাতারের বেড়া যেখানে নষ্ট হয়ে গেছে, সেগুলো ঠিক করা হবে। তিনি আরো বলেন, সিটি করপোরেশনের নজর আপাতত সৌন্দর্যবর্ধনের দিকে। ছোট প্রজাতির গাছ, ফুলের গাছসহ নানা প্রজাতির গাছ লাগানো হবে।

তবে নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান মনে করেন, শহরের বুকে অত্যন্ত মূলবান এসব জায়গা। বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ভারত, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের বড় বড় শহরে ফ্লাইওভারের নিচের জায়গাকে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে আছে পার্ক, লাইব্রেরি, জলাশয়সহ নানা আয়োজন। তিনি বলেন, কেবল ফুলের গাছ লাগানোই যথেষ্ট নয়, স্থানভেদে সেখানে হতে পারে নান্দনিক পার্ক, হকারদের কর্মসংস্থান এবং পথশিশুদের বিনোদনকেন্দ্র।

পিডিএসও/ জিজাক

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বিনোদনের স্থান,ফ্লাইওভার
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close