গাজী শাহনেওয়াজ

  ২১ ডিসেম্বর, ২০১৮

ইসিতে অভিযোগের স্তূপ, নিষ্পত্তি নিয়ে হিমশিম

নির্বাচন কমিশনে (ইসি) অভিযোগের স্তূপ জমেছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ বিরোধী প্রার্থীদের তরফ থেকে প্রতিদিনই আসছে অভিযোগ। আর মহাজোট প্রার্থীদের তরফ থেকেও আসছে পাল্টা অভিযোগ। এর নিষ্পত্তি নিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে সাংবিধানিক সংস্থাটি। মহাজোটের প্রধান আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের অভিযোগ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আর বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের শরিক প্রার্থীদের অভিযোগ প্রধানত পুলিশ ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে।

গত ১০ ডিসেম্বর থেকে প্রচারণা শুরু হওয়ার পর এ অভিযোগ বাড়তে থাকে। অভিযোগের স্তূপে চাপা পড়ে ইসি দিশাহারা অবস্থায় পড়ার মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার এক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) খান মো. নুরুল হুদা প্রার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, অভিযোগ সরাসরি কমিশনে না দিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে দিলেও প্রতিকার দ্রুত পাওয়া যাবে।

এদিকে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কত অভিযোগ জমা পড়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান জানাতে পারেনি ইসি সচিবালয়। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে এ পর্যন্ত চার শতাধিক অভিযোগ ইসি সচিবালয়ে এসেছে। এছাড়া দেশের রিটার্নিং কর্মকর্তার দফতরেও জমা পড়া অভিযোগের সংখ্যা আরো কয়েকগুণ বেশি। তবে সব অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না ইসি। এর ধরন বুঝে বাছাই করা কিছু অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে ইসি।

আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘন সংক্রান্ত ৫০টির বেশি অভিযোগ সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী তদন্ত কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। ৩৪টির ঘটনায় তদন্ত কমিটি ইসির কাছে প্রতিবেদন পাঠালেও সেখানে কারো বিরুদ্ধে অপরাধের সুনির্দিষ্ট তথ্য ও সাজার সুপারিশ নেই। এছাড়া প্রশাসন ও পুলিশের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয়া হলেও এর মধ্যে ১৪ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ১৪টির মধ্যে কয়েকটি রিটার্নিং কর্মকর্তা ও প্রশাসনের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর বাইরে বিএনপিসহ কয়েকটি দল ও প্রার্থীর অভিযোগের বিষয়ে কমিশন সরাসরি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সেগুলো ‘আইনানুগ’ ও ‘প্রয়োজনীয়’ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রিটার্নিং ও পুলিশ সুপারদের চিঠি দেয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির পাঁচজন কর্মকর্তা জানান, যেসব অভিযোগ আমলে না নিলেই নয়, এমনগুলোর বিষয়ে কঠোর হচ্ছে ইসি। এটি ইসির মুখ রক্ষার পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করেন তারা।

ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, এখন পর্যন্ত অভিযোগ কত এসেছে এ মুহূর্তে আমি সঠিক পরিসংখ্যা বলতে পারছি না। তবে অভিযোগের মেরিট বিবেচনা ও ধারণা বিশেষে আমরা অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছি। কিছু অভিযোগ পুলিশের আইজি, কিছু ডিআইজি, কিছু রিটার্নিং অফিসার, পুলিশ সুপার ও নির্বাচনী তদন্ত কমিটির কাছে পাঠিয়েছি। পাশাপাশি টেলিফোন করেও এসব অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানিয়েছি। কোনো অভিযোগই পেন্ডিং রাখি না।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে সব অভিযোগই খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হাফিজ। তিনি বলেন, ইসিতে যেসব অভিযোগ জমা পড়ছে সেগুলোর বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে অ্যাকশনে যাওয়া উচিত। এতে নির্বাচনী পরিবেশ ভালো থাকবে। তিনি বলেন, প্রশাসন ও পুলিশের কারো বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা থাকলে তাকে সরিয়ে দেয়া এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

ইসি সংশ্লিষ্টরা জানান, কয়েকটি কমিটির প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা উঠে এলেও সেগুলো ফৌজদারি অপরাধ উল্লেখ করে এর ব্যবস্থা নেওয়ার ভার পুলিশের ওপর ছেড়ে দিচ্ছে।

প্রশাসন ও পুলিশের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : ইসি সূত্রে জানা গেছে, রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, পুলিশ সুপার ও থানার ওসির বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে প্রায় ২০০ অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগকারীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও স্বতন্ত্রসহ কয়েকটি দলের প্রার্থী রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার দোহার থানার ওসি সাজ্জাদ হোসেনের বিরুদ্ধে সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে সরাসরি ভোট চাওয়ার অভিযোগ করেছেন ঢাকা-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি। এর আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নোয়াখালী-৫ আসনের প্রার্থী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ওই আসনের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ করে তাদের বদলি করতে কমিশনে আবেদন করেন। অপরদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার টি এম মোজাহিদুল ইসলাম ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহবুব আলম খানের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. আবদুল ওদুদ। পুলিশের এ দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষক লীগের সহ-সভাপতি মু. খুরশিদ আলম (বাচ্চু)।

আরো জানা গেছে, যশোর-৪ আসনের বিএনপির প্রার্থী টি এস আইয়ুব এক অভিযোগে বাঘারপাড়ার ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। সাতক্ষীরা-১ আসনের বিএনপির সাবেক এমপি হাবিবুল ইসলাম হাবিব তার থানার ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার ওসিকে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মো. শফিকুল ইসলাম শফি।

সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত অন্তত আটজন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রতিবেদনের কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার ওসি, রিটার্নিং কর্মকর্তার প্রতিবেদনের আলোকে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানার ওসি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রতিবেদনের আলোকে রংপুরের মিঠাপুকুর থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর বাইরে অন্যান্য কারণে খুলনার পুলিশ কমিশনারকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছে ইসি।

প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের যত অভিযোগ : কোনো কোনো অভিযোগের ক্ষেত্রে কমিশন ব্যবস্থা নিতে বলেছে। অভিযোগকারীদের মধ্যে রয়েছেন নীলফামারী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, নোয়াখালীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বিএনপি প্রার্থী মোহাম্মদ ফজলুল আজিম, একই দলের কক্সবাজারের মো. সরোয়ার কামাল, ঢাকা-১০ আসনের আবদুল মান্নান, গাজীপুর-৪ আসনের শাহ রিয়াজুল হান্নান, ঢাকা-৯ আসনের আফরোজা আব্বাস ও ঢাকা-১৯ আসনের দেওয়ান মো. সালাহউদ্দিন। অপরদিকে আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রতিপক্ষ বিএনপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে ঢাকা-৯ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবের হোসেন চৌধুরীর পক্ষে তার প্রধান সমন্বয়কারী আবদুল মান্নান সিইসির কাছে অভিযোগ করেছেন। এতে তিনি প্রতিপক্ষ আফরোজা আব্বাসের বিরুদ্ধে আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘন করে প্রচার চালানোর অভিযোগ আনেন।

ইসির কর্মকর্তারা জানান, সারা দেশে ১২২টি নির্বাচনী তদন্ত কমিটি কাজ করছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৩৪টি ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন এসেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
অভিযোগ,ইসি,নির্বাচন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close