আহমেদ জামিল, সিলেট

  ০৩ মার্চ, ২০২১

বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন

মার্চেই ডিফেন্স গড়ে তুলি আখাউড়ায়

বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন আঙ্গুর। ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ

যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন আঙ্গুর ১৯৬৯ সালে ২১ বছর বয়সে সিপাহি পদে যোগ দিয়েছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে (ইবিআর)। সিলেটের দক্ষিণ সুরমার হাজরাই গ্রামের মৃত আরজদ আলীর ছেলে আনোয়ার হোসেন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আখাউড়ায় প্রতিরক্ষা ঘাঁটির দুই নম্বর প্লাটুনের সদস্য ছিলেন। ওই প্লাটুনের ল্যান্স নায়েকের দায়িত্বে ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তাফা কামাল। যুদ্ধের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন আনোয়ার।

আনোয়ার হোসেন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বাড়িতে অসুস্থ মাকে দেখতে আসার জন্য ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল থেকে ছুটি মঞ্জুর হয়েছিল তার। এর আগেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সব পাল্টে দেয়। তখন তিনি কুমিল্লায় ইবিআর হেডকোয়ার্টারে। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর ২৪ মার্চ আমিসহ কোয়ার্টার গার্ড ম্যাগাজিন ডিউটিওয়ালাদের কাছ থেকে সব অস্ত্র নিয়ে নেয় পাঞ্জাবিরা। তখন আমাদের লাঠি দিয়ে লাইনে ও বাউন্ডারিতে ডিউটি করতে বলা হলো। আর আমাদের পেছনে পাঞ্জাবিরা ডিউটি শুরু করে। পাঞ্জাবিদের অবস্থান দেখে আমাদের সন্দেহ হলো। আমরা বাঙালিরা বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে। ২৫ মার্চ রাত ৯টার দিকে বাঙালিদের কাছ থেকে সব রেডিও ছিনিয়ে নিয়ে যায় পাঞ্জাবিরা, যাতে বাইরের কোনো খবর আমাদের কাছে না পৌঁছায়। আমি সিনিয়র একজনকে বললাম আসলে কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। সিনিয়র বললেন, দেশের অবস্থা ভালো না।’

আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘২৮ মার্চ ভোরে আমরা ৭-৮ জন বাঙালি হেডকোয়ার্টার থেকে পালিয়ে যাই। ৩০ মার্চ সন্ধ্যা ৬টার দিকে আমরা কুমিল্লা থেকে আখাউড়ায় পৌঁছাই। এখানে এসে দেখি আমাদের কোম্পানির আরো সিপাহি রয়েছে। সব বিওপি ছেড়ে একত্রে মিলিত হয়েছে। আমাদের দেখে ওরা আরো খুশি। আমরা পুরো ঘটনার বর্ণনা দিলাম। তখন ওখানে ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন কোম্পানির সিনিয়র কমান্ডার নায়েব সুবেদার গোলাম আম্বিয়া। আমাদের সাতজনকে বিভিন্ন প্লাটুনের সঙ্গে যোগ করে দেওয়া হলো। আমাকে দেওয়া হয় আখাউড়ার গঙ্গাসাগরে ল্যান্স নায়েক বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তাফা কামালের নেতৃত্বাধীন ২ নম্বর প্লাটুনের সঙ্গে। আরো একটি প্লাটুনকে পাঠানো হলো আখাউড়ার উজানি শহরে। ল্যান্স নায়েক মোস্তাফা কামাল আমাকেসহ কয়েকজন আনসার নিয়ে গঙ্গাসাগর রেলওয়ে ব্রিজের মুখে শক্ত ডিফেন্স নিতে নির্দেশ দেন। আমাদের সাপোর্ট দেওয়ার জন্য রেলওয়ে ব্রিজের পূর্ব ও পশ্চিমে আরো দুটি প্লাটুন ডিফেন্স নেয়। প্রতিদিন ইমামবাড়ি থেকে রেলওয়ে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত টহল দিতে থাকি আমরা। ১৪ এপ্রিল রাত ১০টার পর উজানি শহর থেকে গুলির শব্দ আমাদের কানে আসে। সিক্স পাউন্ড আর্টিলারির আওয়াজে চারপাশ কেঁপে উঠছিল।’

আনোয়ার বলেন, ‘১৫ এপ্রিল সোর্সের মাধ্যমে খবর পেলাম পাঞ্জাবিরা উজানি শহর থেকে পেছনের দিকে ফিরে যাচ্ছে। তখন পাঞ্জাবিরা ওই পথে না এসে আমাদের পূর্বের ফাঁদ পেতে থাকা রাস্তা (গঙ্গাসাগর রেলওয়ে ব্রিজ) দিয়ে সামনের দিকের অগ্রসর হয়। তখন আমরা আমাদের বাংকারে এসেই পজিশন নিই। ল্যান্স নায়েক মোস্তাফা কামালের পরিকল্পনায় রেলওয়ে ব্রিজটার মাঝের অংশ এমনভাবে ভেঙে রাখা হয়েছিল যাতে শত্রু পক্ষ ভাঙা অংশ থেকে উঠতেই ফায়ার করা যায়।’

তিনি বলেন, ‘৫০-৬০ জন অস্ত্রধারী পাঞ্জাবি গঙ্গাসাগর রেলওয়ে ব্রিজে উঠে। ল্যান্স নায়েক মোস্তাফা কামালের নেতৃত্বে আমরা ৮ জন এলএমজি হাতে প্রস্তুত। পাকিস্তানিরা ব্রিজের ভাঙা অংশ থেকে উঠতেই আমরা একসঙ্গে ব্রাশফায়ার শুরু করি। আমাদের ডান-বাম থেকেও শুরু হয় ফায়ার। তিন দিক থেকে আমাদের অতর্কিত ফায়ারে পাখির মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা। পেছনের ১০-১২ জন অবস্থা বেগতিক দেখে পালিয়ে চলে যায়। মরদেহ উদ্ধার করতে দিনভর চেষ্ঠা করেও ব্যর্থ হয় পাঞ্জাবিরা। রাত ১২টা পর্যন্ত পাঞ্জাবিরা থেমে থেমে গুলিবর্ষণ করে। ওই অপারেশনের নাম ছিল মেরাশ্বরি অপারেশন। অপারেশনে আমাদের সহযোগিতা করেছিলেন মেজর খালেদ মোশররফ ও ব্যাটালিয়ান কমান্ডার আইন উদ্দিন।’

এরপর ১৭ এপ্রিলের নৃশংসতার কথা আজও ভুলতে পারেননি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার। ওই নৃশংস ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ল্যান্স নায়েক মোস্তাফা কামাল। একই ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়েছে আনোয়ারকে। মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার বলেন, ‘১৭ এপ্রিল সকাল থেকেই আকাশের অবস্থা খারাপ ছিল। খবর পেলাম কুমিল্লা-আখাউড়া রেললাইন ধরে উত্তর দিকে আসছে পাকিস্তান সৈন্যরা। সকাল ১০টার দিকে শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির সঙ্গে শত্রুরা শুরু করে গুলিবর্ষণ। মেঘের গর্জন ও বৃষ্টির শব্দে আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। সাড়ে ১১টার দিকে গঙ্গাসাগরের দিকে শত্রুর অবস্থান থেকে ভারী গুলি বর্ষিত হতে থাকে। ১২টার দিকে আসে পশ্চিম দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ। এ সময় আমাদের পূর্ব দিকের সৈন্যরা পেছনে সরে যেতে থাকে এবং মোস্তাফা ভাইসহ আমাদের পিছু হটতে বলেন। কিন্তু মোস্তাফা ভাইকে আমরা কোনো অবস্থায় রাজি করতে পারছিলাম না। তখন আমাদের বাংকার থেকে শত্রুরা ২০০ গজ দূরে। শত্রুর অবস্থান শনাক্ত করতে বাংকারে উঠলে আর্টিলারি গুলির একটি টুকরো আমার কব্জির মধ্যে এসে পড়ে। ধীরে ধীরে হাত খুলে পড়ছে এমন অবস্থা দেখে মোস্তাফা ভাই একটি গামছা এনে আমার হাতে বেঁধে দিলেন। তখন আমার সহযোদ্ধা কয়েকজন আমাকে পেছনের দিকে নিয়ে যান। কিন্তু তাদের সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে দিলেও মোস্তাফা ভাই এলএমজি থেকে গুলি চালাতে থাকেন। তার সঙ্গে ছিলেন আমাদের সিলেটের সুফি কামাল ভাই। একাই মোকাবিলা করেন শত্রুদের। এরই মধ্যে শত্রুরা একেবারে কাছে চলে আসে। এরপর আমি আর কিছু বুঝতে পারিনি।’

তিনি বলেন, ‘তিন দিন পর জ্ঞান ফিরে দেখি আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আমি জানতে চাইলাম কোথায়? কর্তব্যরত এক নার্স বলল, আমি ভারতের আগরতলা জিপিও হাসপাতালে ভর্তি। এই খবর শুনে আমি আবারো অজ্ঞান হয়ে পড়ি। কারণ আমি তখন জানতাম না যে ভারত আমাদের মিত্র। ফের জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম আমার কয়েকজন সহযোদ্ধা আছেন পাশে। খবর পেলাম আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ওই হাসপাতালে ভর্তি আছেন। সেদিন খবর পেলাম মোস্তাফা ভাই তখনই পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিলেন।’

আনোয়ার বলেন, ‘আমাদের দেখতে তখন হাসপাতালে আসেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকে।’

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আখাউড়া,মার্চ,বীর মুক্তিযোদ্ধা,আনোয়ার হোসেন আঙ্গুর
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close