সাইফুল বিন শরীফ

  ০৪ অক্টোবর, ২০২০

ধর্ষণ নামক ঘৃণ্য ব্যাধি থেকে নারী সমাজকে বাঁচাতে হবে

মানুষ হিসেবে মানুষের বিবেক ও মনুষ্যত্ববোধ থাকবে এটাইতো স্বাভাবিক। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মানুষের যে আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা একান্ত প্রয়োজন আধুনিক সমাজে এসে তা দিন দিন লোপ পাচ্ছে। কিছু মানুষের আচরণ হয়ে যাচ্ছে বর্বর হায়েনার মত। একুশ শতকে এসে সভ্য সমাজের দোহায় দিয়ে় কিছু রক্তপিপাসু হায়েনা নিজেদের লালসা চরিতার্থ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ছে নারী সমাজের ওপর। তারা বিবেকবোধ কবর দিয়ে নিজেকে ইতিহাসের নির্লজ্জ আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করছে প্রতি মুহূর্ত।

বর্তমান সময়ে যেসব সামাজিক ব্যাধি আমাদের সমাজকে প্রতি মুহূর্তে গ্রাস করে চলছে তারমধ্যে মারাত্মক হলো ধর্ষণ। ধর্ষণের প্রকোপ বর্তমান সময়ে এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে তা যেকোনো সময়ের তুলনায় ঢের বেশি।

ধর্ষিত মেয়েটি বিচার চাইতে গিয়ে পদে পদে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে । বিচার চাইতে গিয়ে কখনো কখনো মেয়েটি ও তার পরিবার হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কেউ কেউ মান সম্মানের কথা ভেবে বিচারও চান না।

করোনাকালে পৃথিবী নিথর-নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। সেই মুহূর্তেওে থেমে নেই ধর্ষকরা। তাদের নিষ্ঠুর আচরণ থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না আবাল-বৃদ্ধা-বনিতা। ধর্ষণের মত মারাত্মক ব্যাধি প্রতি নিয়ত এই সভ্য সমাজকে কলুষিত করছে। ধর্ষকের বিবেকবর্জিত, রুচিহীন এমন কর্মকাণ্ডে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে পুরো বাংলাদেশ। নারীর প্রতি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকানো শকুনদের এখনই থামাতে না পারলে রাষ্ট্রকে চরম মূল্য দিতে হবে।

বাংলাদেশের মতো সভ্য একটি রাষ্ট্রে ধর্ষণের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান দেখলে চোখ কপালে উঠার মত অবস্থা। স্বাধীন সার্বভৌম একটি সভ্য রাষ্ট্রের মানুষের পক্ষে এমন গর্হিত কাজ কিভাবে সম্ভব? মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৮১৮ জন নারী। ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৭৩২ জন৷ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জন নারীকে। ২০১৯ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৪১৩ জন, যা ২০১৮ এর তুলনায় দ্বিগুণ। হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে।

চলতি বছরের প্রথম ১০দিনে দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১২৮টি। আসকের হিসাব অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর এর ২৫ তারিখ পর্যন্ত দেশে সর্বমোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৪৮টি। ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে ৪১ জন নারীকে। এবং এ ঘটনায় আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন নারী।

আমেরিকায় ধর্ষণের ঘটনায় সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। রাশিয়ায় ২০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড। চীনে কোনো ট্রায়াল নেই, মেডিকেল পরীক্ষার পর মৃত্যুদণ্ড। পোল্যান্ডে হিংস্র বুনো শুয়োরের খাঁচায় ফেলে মৃত্যুদণ্ড। সৌদি আরবে জনসম্মুখে শিরচ্ছেদ। দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০ বছরের কারাদণ্ড। তৎকালীন বর্বর জাতি মঙ্গোলিয়ায় ধর্ষণের শিকার নারীর হাত দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আফগানিস্তানে ৪ দিনের ভেতর গুলি করে হত্যা। মালেশিয়ায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।

বাংলাদেশে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংস্কারের প্রয়োজন আছে। আইনটিতে বলা আছে ধর্ষণের পর যদি হত্যা করা হয়, সে ক্ষেত্রে ধর্ষককে আইনে থাকা সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। ধর্ষক যদি স্বীকার করে যে তিনি ধর্ষণ করেছেন, সেক্ষেত্রে তার শাস্তি হবে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড। ধর্ষণের চেষ্টা করলে অনধিক ১০ বছর ও অন্যূন পাঁচ সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান আছে। ১০ বছরের সাজা পরে কমে কমে গিয়ে দাঁড়ায় পাঁচ বছরে। এই হলো আইনে ধর্ষকের শাস্তি। এই আইন সংস্কারের প্রয়োজন।

ইন্দোনেশিয়ায় শিশু ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। শিশু ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে দেশটির আইনে সংশোধন করেছে। তবে ২০১৬ সালের এক আইনে ইন্দোনেশিয়ায় যৌন নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের রাসায়নিক উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে নপুংসক করা হবে বলে ডিক্রি জারি করা হয়।

বাংলাদেশে একটা সময় এমন ছিল যে এসিড সন্ত্রাস ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর আইন করার পরে এই ধরণের অপরাধ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। তাই ধর্ষকদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা নপুংসক করার বিধান রেখে আইন পাশ করলে বাংলাদেশে ধর্ষণের ভয়াবহতা অনেক কমে যাবে বলে অপরাধ বিজ্ঞানীরা মনে করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনের মতে নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে শক্ত আইন আছে৷ ‘কিন্তু শাস্তি দিয়ে খুব বেশি অপরাধ কমানো যায় না৷ আর এটা ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷ আমাদের এখানে সমাজের ভিতরে অসংখ্য উপাদান আছে যা ধর্ষণ বা নারীর প্রতি সহিংসতাকে উসকে দেয়৷ আমাদের সমাজে এখানো নারীকে ভোগের সামগ্রী মনে করা হয়৷ তাকে সেভাবে উপস্থাপনও করা হয় বিভিন্ন মাধ্যমে,’ বলেন তিনি৷

আমাদের দেশে আরেকটা বড় সমস্যা ধর্ষণ হওয়ার পর কোনো দলই ধর্ষকের অপরাধের ভার নিতে চায়না। বিরোধী দল সরকারি দলের উপর দায় চাপায়, আর সরকারি দল বিরোধী দলের উপর। যার কারণে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়। ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত সময়ে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে খুব দ্রুততার সাথে রায় কার্যকর করলে অপরাধ প্রবণতা কমবে বলে আমার বিশ্বাস। যদিও অপরাধীর উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ থাকে। কিন্তু সেই আপিলের রায়ের সময় দীর্ঘায়িত না করে ২/৩ কার্যদিবসের রায় ঘোষণা করা প্রয়োজন। যে সব অপরাধীর অপরাধ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় সেগুলো কিন্তু প্রাথমিক প্রমাণই বটে। তাই রায় ঘোষণা দীর্ঘায়িত না করাই উত্তম।

ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ও লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে আমরা আর কোনো মা বোনের সম্ভ্রম হারাতে চাইনা। সম্প্রীতির বাংলাদেশে আমরা সৌহার্দ্য সম্প্রীতি বজায় রেখে চলতে চাই। স্বামী যেনো স্ত্রীকে হারিয়ে নিঃস্ব না হয়। মা তার মেয়েকে হারিয়ে পাগল না হয়। ভাইকে যেনো তার কোনো ধর্ষণের শিকার বোনের বিচার চাইতে না হয়।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ধর্ষণ,ধর্ষণের শিকার,নারী
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close