মোহাম্মদ আল এমরান

  ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে মতবিনিময়

ছবি : প্রতিদিনের সংবাদ।

সরকারের সুশাসন নিশ্চিতকরণে শাসন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ সময়ের দাবী। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির পরিবর্তন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নিয়েই করতে হবে। এক শ্রেণীর মানুষ দরিদ্র, অবহেলিত ও দারিদ্রতার গ্রাস হতে বেরিয়ে আসতে পারছেনা, তাদের কথা না ভেবে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। সরকারের তেমন কোন দৃশ্যমান কর্মসূচি চোখে পড়ছে না, যে কর্মসূচি দেশের দরিদ্র মানুষদের জীবনমানকে উন্নত করছে।

অন্তবর্তীকালীন সরকার কাগজে কলমে সংস্কার করতে চাইলে তা করতে দু্ই আড়াই বছর সময় লাগেনা। কাগজে কলমে সংস্কারের জন্য ৬ মাস হতে ১ বছরের বেশি সময় প্রয়োজন হয়না। বর্তমান সরকার যদি কোন একটি এজেন্ডা নিয়ে কাজ করত তাহলে খুব সহজে সেই এজেন্ডার বাস্তবায়ন করতে পারত। তাই এখনও সময় আছে শুধু মাত্র গরীব ও সাধারণের মানুষের কথা চিন্তা করে তাদের নতুন কোন এজেন্ডা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করলে বর্তমান সরকারের গ্রহনযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যাবে।

সাধারণ মানুষ সম্পদের সুষম বন্টন চায়। কেউ দুর্নীতি করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিবে আর সাধারণ মানুষগুলো সৎ, সততার মাধ্যমে জীবনধারণ করে তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতেও হিমশিম খাবে তা হতে দেওয়া যাবে না।

অর্থনীতিতে সুফলতা আনতে হলে সাধারণ খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষের কথা প্রাধান্য দিয়ে দেশের অর্থনীতি শক্ত ও মজবুত করা উচিত এবং দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এখনই জেলাভিত্তিক বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিয়ে অতি দ্রুত জেলা প্রশাসকদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা উচিত, জেলা প্রশাসকদের সাথে মতবিনিময় এর এক অনুষ্ঠানে যার ধারণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস।

মতের ভেদাভেদ থাকতে পারে কিন্তু দেশটা আমাদের সবার। পাশের জেলার গ্রামের মানুষগুলো দূর্যোগ ও বন্যা এবং নদী ভাঙ্গন কবলিত হয়ে নিজেদের শেষ আশ্রয়টুকুও হারিয়ে ফেলছে আর কতিপয় লেভাঁজধারী ভদ্র লোক শত শত কোটি টাকার অবৈধ মালিক হয়ে নিজের গ্রামের মানুষের কথাও ভুলে যাচ্ছে, আর নিছক মানবতা দেখাচ্ছে এ ধরণের সভ্য লেভাঁজধারী মানুষের সংখ্যা নেহাত আমাদের সমাজে কম না। এ ধরণের মানুষগুলো নিজের শিকড়কে ভুলে ইট পাথরের দালান কোঠায় সভ্য, ভদ্র মানুষ সেজে বসে বসে ভাবছে কার কাছ থেকে কত টাকা ঘুষ, আর দুর্নীতি করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া যায়। দুর্নীতি, ঘুষ এর টাকায় ডজন ডজন বাড়ি, গাড়ি ও ফ্ল্যাট তো হয়েছে এখন বাকি আছে- কিভাবে বিদেশে সেকেন্ড হোম বানাবে এবং আরও অর্থ পাচার করবে। এমন অনেক লোকজন আছে যাদের গ্রামে পৈতৃক ভিটাও ছিলনা কিন্তু রাজধানীতে নাম করা মস্ত বড় ব্যবসায়ি, শিল্পপতি, কোটিপতি শ্রেণীর লোক। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা গেছে- শত শত কোটি টাকা দুর্নীতি, ঘুষ খেয়ে হজম করে সেই টাকায় রাজনীতি করার খায়েশ দেখা দিয়েছে। এমন শ্রেণীর লোকজনের গ্রামে রাজমহল, ডুপ্লেক্স বাড়ি লাগবে, সাধারণ মানুষদের দেখাতে হবে কত টাকা হয়েছে এছাড়াও নিজ এলাকা হতে সংসদীয় আসনে নির্বাচনও করতে ইচ্ছুক হয়ে থাকে। কিন্তু ভুলে যায় তাদের গ্রামের আশেপাশের বাড়ির মানুষগুলোর কথা, যাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই এখন পর্যন্ত হয়নি।

পরিবর্তন হতে চাইলে সোজা কথা দেশের কেরানির চাকুরি হতে শুরু করে উচ্চ পদস্থ সরকারি কোন কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঘুষ ও দুর্নীতি করতে পারবে না। ভবিষ্যতে যারা রাজনীতি করবে সেই সকল রাজনীতিবিদরাও কোন দুর্নীতি, অনিয়ম ও সরকারের প্রশাসনে কোন ধরণের হস্তক্ষেপ করতে না পারে। সকল ক্ষেত্রে সুযোগের সমতা ও সমান ক্ষমতা থাকবে সকল স্তরে। ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবে তাদের সমাজের নিম্ন স্তরের জনপ্রতিনিধি মেম্বার হতে শুরু করে সংসদের এমপি মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী সকলকেই নিচের দিকে তাকিয়ে দেশ চালাতে হবে। তাহলে হয়ত দেশের গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় উন্নয়ন তাদের হাত ধরেই সম্ভব হবে।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন ছাড়া সামগ্রিক অর্থনৈতিতে কোনভাবে সুফলতা আসেনা। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমানে পরিবর্তন শুধুই সম্ভব হবে যদি সম্পদের সুসষম বন্টন নিশ্চিত করা যায়। দেশের মাথাপিছু আয় আনুপাতিক হারে বাড়ছে কিন্তু এর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে না। দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের উন্নয়ন নিশ্চিত সম্ভব নয়, যদি তাদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব না হয়ে থাকে। প্রতিটি দরিদ্র, হত দরিদ্র পরিবারকে সনাক্ত করা যেমনি জরুরি, তেমনি তাদের জীবন মানে পরিবর্তন আনতে সকল সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। দরিদ্র শ্রেণীর মানুষগুলোর আয়ের উৎস নিশ্চিত করতে হবে। দরিদ্র পরিবারে উপার্জনে সক্ষম এমন মানুষগুলোকে আর্থিক সুবিধা প্রদান করে তাদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করতে হবে। তাদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি ছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে জেলাভিত্তিক বাজেট পরিকল্পনা তৈরি এবং সেই বাজেট দারিদ্রতার আনুপাতিকহারে যে জেলায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যত বেশি সেই জেলায় বাজেটের অর্থের পরিমান অন্যান্য জেলার চেয়ে বেশি নির্ধারণ করে দরিদ্র মানুষের আয়ের উৎস সৃষ্টির লক্ষ্যে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় বিনিয়োগ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষিকর্মী, খামারি ও প্রযুক্তি নির্ভর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির আবশ্যকতা রয়েছে।

প্রতিটি জেলার ডিসি (জেলা প্রশাসক) এমন একজন ব্যক্তি হবেন যিনি পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক, সৎ, সাহসী হিসেবে শান্তির দূত হয়ে নতুন বাংলাদেশ গঠনে কাজ করবেন। তাদের অন্যতম কাজ হবে জেলাভিত্তিক প্রত্যেক জেলার কৃষিজমি, জমি হতে উৎপাদিত পণ্য, পণ্যের বাজারজাতকরণ, পণ্যের নির্ভরশীলতা, জনসংখ্যানুপাতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ ও তালিকা এবং ছক করে কি কি ফসল ও পণ্য উৎপাদন সম্ভব ও কি কি পণ্য অন্য জেলা হতে ক্রয় করতে হবে, ক্রয়কৃত পণ্য কি ঐ জেলায় উৎপাদন সম্ভব কিনা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যেতে হলে কি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেই প্রতিবন্ধকতা হতে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে বের করে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদনে কৃষকসহ সকল আবাদযোগ্য ভূমির মালিকদের এগিয়ে আসতে খোলা চিঠি, মেলা, সেমিনার, প্রচার ও প্রসার চালিয়ে যাওয়ার জন্য নতুনভাবে কাজ করা উচিত। এভাবে জেলা প্রশাসকদের দেশের প্রতিটি জেলাকে উৎপাদনমুখী সাবলম্বী জেলা হিসেবে করে গড়ে তোলার আবশ্যকতা ও প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করা উচিত। প্রতিটি জেলা যদি তাদের নিজস্ব খামার ও ফসলের উপর নির্ভরশীল হয়ে যায় তাহলে দেশে কোন অভাব থাকবে না।

প্রতিটি জেলায় সকল ধরণের ফসল উৎপন্ন হবে তা বাস্তব নহে, সেক্ষেত্রে যে জেলায় যে ফসল বেশি উৎপন্ন হয়, সেই জেলা অন্য জেলা হতে ফসল ক্রয় করে চাহিদা পূরণ করবে। পণ্যের ঘাটতি মেটাতে সেই জেলা যে সকল পণ্য ও ফসল, সেবা প্রদান ও উৎপাদনে সক্ষম তা বিনিময়ের মাধ্যমে অন্য জেলা সাথে ঘাটতি সমন্বয় করবে।

এভাবে জেলা প্রশাসকের সুষ্ঠু তদারকির মাধ্যমে প্রতিটি জেলাকে উৎপাদনমুখী জেলা হিসেবে পরিনত করা ও এ ধরণের উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে সরকারের সকল ধরণের সুযোগ সুবিধা জেলার সকল পর্যায়ের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে কাজ করা উচিত।

জেলাভিত্তিক সংস্কার ও পরিকল্পনা ছাড়া দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির পরিবর্তন সম্ভব নয়। সরকারের সকল কার্যক্রম জেলাভিত্তিক নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হলে কেন্দ্রের উপর চাপ কমবে। সরকারের শাসন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ ও সকল ধরণের সুযোগ সুবিধা জেলাভিত্তিক নিশ্চিতকরণ ছাড়া অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার ও সম্ভাবনা দুয়ার উম্মোচিত হবে না।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
অর্থনীতির পরিবর্তন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close