প্রতীক ইজাজ

  ১০ এপ্রিল, ২০১৮

পরিধি বাড়লেও সংস্কার হয়নি কোটা পদ্ধতির

দেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রচলিত বর্তমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা। বেশ কিছুদিন ধরে রাজধানীসহ দেশের বেশকিছু জেলায় এ আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে চললেও গত রোববার রাতে হঠাৎ করেই রাজধানীতে আন্দোলন বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে ওঠে। পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। ঘটে গ্রেফতার ও হতাহতের ঘটনা। বিশেষ করে গভীর রাতে হঠাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা উদ্বিগ্ন করে তোলে সবাইকে। গতকালও জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলন করেছেন শিক্ষার্থীরা।

অবশ্য শেষপর্যন্ত বিদ্যমান কোটার বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে, সরকার এমন আশ্বাস দিয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে চলমান আন্দোলন আগামী ৭ মে পর্যন্ত স্থগিত করে আন্দোলনকারীরা। পরবর্তী সময়ে আন্দোলনকারীদের একাংশ আন্দোলন চালিয়ে যাওযার ঘোষণা দেন। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার (গতকাল) বৈঠকের পর আরেকটি বিশেষ বৈঠকে কোটার বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। কোটা সংস্কারের ব্যাপারে সরকার অনড় অবস্থানে নেই। আন্দোলনকারীদের দাবির যৌক্তিকতা ইতিবাচকভাবেই দেখা হচ্ছে।

এমন প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনায় মুখর গোটা দেশ। কী এই কোটা পদ্ধতি, কেন এই আন্দোলন, আন্দোলনকারীরা যে সংস্কারের কথা বলছেন তার যৌক্তিকতাইবা কতটুকু—এ প্রশ্ন যেমন উঠেছে; তেমনি কোটা পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা ও কী উদ্দেশ্যে, কবে থেকে এই কোটা পদ্ধতি—সে বিষয়েও পরিষ্কার ধারণা পেতে চান সবাই। সরাসরি নিয়োগে কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধা তালিকায় থাকা প্রার্থীদের মধ্য থেকে সেসব পদ কীভাবে পূরণ করতে হবে, সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দেওয়া এমন ব্যাখ্যা নিয়েও অস্পষ্টতা বা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে কি না—এমন প্রসঙ্গ নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে চালু থাকা কোটা পদ্ধতি পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও সময়ের সঙ্গে কতটুকু যুক্তিযুক্ত—সে ভাবনাও ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মধ্যে। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে কোটা থাকা উচিত ও কতটা থাকা উচিত—সে প্রশ্নও উঠছে।

এর আগে অবশ্য বিভিন্ন সময় সরকারি কর্মকমিশন—পিএসসিসহ বিশেষজ্ঞরা কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সুপারিশ করলেও কোনো সরকারই এ সুপারিশ বাস্তবায়নের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন সূত্র। সূত্রগুলো জানায়, খোদ পিএসসি এই পদ্ধতিকে সরলীকরণের তাগাদা দিয়ে বলেছে, এটি অত্যন্ত জটিল, দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ। শতভাগ নিখুঁতভাবে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন এর মাধ্যমে প্রায় অসম্ভব।

এই নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশের সাবেক সচিব, শিক্ষাবিদসহ বিশেষজ্ঞরা। এদের সবাই কোটা সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছেন। তাদের মতে, কোটা পদ্ধতি চালুর পর এর পরিধি বাড়লেও পদ্ধতির সংস্কার হয়নি। এর ফলে মেধাবীরা চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রশাসনও দক্ষতা হারাচ্ছে। এমনকি কোটা পদ্ধতিকে পুঁজি করে সরকারি কর্মকর্তারা কোনো অসৎ সুবিধা নিচ্ছেন কি না বা কোটাবাণিজ্য হচ্ছে কি না—সরকারকে সেই দিকটাও খেয়াল রাখতে হবে।

জনপ্রশাসন সূত্র মতে, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের সুবিধা দিতে ১৯৭২ সালে দেশে প্রথম সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি চালু হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের অনগ্রসর মানুষকে সুবিধা দেওয়া। ক্রমান্বয়ে এই কোটার পরিধি বেড়েছে। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের জন্য এ কোটা প্রযোজ্য হচ্ছে। ৬৪টি জেলার জন্য কোটা আছে। সব মিলিয়ে দেশের সরকারি চাকরিতে এখন ২৫৮ ধরনের কোটা বিদ্যমান। প্রথম শ্রেণির চাকরিতে মোট পাঁচটি ক্যাটাগরিতে কোটা পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কোটায়।

জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটা আছে। ফলে ১০০ জন নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা থেকে নিয়োগ হয় ৫৬ জন। অবশিষ্ট ৪৪ জনকে নেওয়া হয় মেধা থেকে। আর যদি কোটা থেকে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না যায়, তাহলে তা শূন্য রাখা হয়। এই ৫৬ শতাংশ কোটার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও তাদের নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ ৫ শতাংশ। এ ছাড়া প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা রয়েছে ১ শতাংশ, যা পূরণ করা হয় সাধারণত উপরের যেকোনো একটি কোটা থেকে। অর্থাৎ কোনো কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেখান থেকে প্রতিবন্ধী কোটা পূরণ হয়।

কোটার ফলে সাধারণ মেধাবী চাকরিপ্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন—জানিয়ে জনপ্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়াদের মধ্যে সিংহভাগেরই কোটার সুবিধা থাকে না। অথচ সেখান থেকে কম প্রার্থী নিয়োগ দেওয়া হয়। অন্যদিকে কোটার সুবিধা নিয়ে যারা নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন, তারা সংখ্যায় কম হলেও তাদের জন্য পদ থাকে বেশি। ফলে দেখা যায়, কোটার পদ পূরণের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য প্রার্থী থাকছেন না। এতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা সব পদ পূরণ করা সম্ভব হয় না। এতে দুই ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। এক. ওই পদ সংরক্ষিত থাকার কারণে মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। দুই. সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় জনবল পাচ্ছে না।

অস্পষ্টতা দেখা দিয়েছে কোটার ফাঁকা পদ পূরণে সম্প্রতি দেওয়া জনপ্রশাসনের ব্যাখ্যা নিয়েও। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকালের মন্ত্রিসভার বৈঠকে কোটা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন বলে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে। গত মার্চে কোটার ফাঁকা পদ পূরণ নিয়ে এক ব্যাখ্যায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানায়, সব ধরনের সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটার কোনো পদ যোগ্য প্রার্থীর অভাবে পূরণ করা না গেলে সেগুলো মেধাতালিকার শীর্ষে থাকা প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করা হবে। এক মাস পর গত বৃহস্পতিবার ওই সিদ্ধান্ত অনুসরণের ব্যাখ্যা দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট নিয়োগের জন্য নারী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটার কোনো কৃতকার্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে ওই পদগুলো অবশিষ্ট কোটা অর্থাৎ জেলার সাধারণ প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করতে হবে। এই দুই পদ্ধতি অনুসরণ করার পরও কোনো বিশেষ কোটার কোনো পদ পূরণ করা সম্ভব না হলে অপূরণকৃত পদগুলো জাতীয় মেধাতালিকার শীর্ষে থাকা প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করতে হবে।

যদিও মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. শফিউল আলম ‘এ কারণে মেধাবীরা খুব একটা বঞ্চিত হন না’ বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, কোটার ফাঁকা পদ কোটা দিয়ে পূরণ করা ঠিক হবে না। এখানে মেধা তালিকায় থাকা উত্তীর্ণদের দিয়ে পূরণ করা উচিত।

জনপ্রশাসন সূত্র জানায়, এর আগে ২০০৯ ও ২০১১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে পিএসসি বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সুপারিশ করেছিল। ওই সুপারিশে বর্তমানের কোটা সংক্রান্ত নীতিমালা প্রয়োগ অত্যন্ত জটিল, দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বলে উল্লেখ করা হয়। সুপারিশে আরো বলা হয়, প্রচলিত কোটা পদ্ধতির জটিলতার কারণে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন শতভাগ নিখুঁতভাবে সম্পাদন করা প্রায় অসম্ভব।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খানও বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি বলেন, অধিকাংশ কোটাই অসাংবিধানিক ও ন্যায়নীতির পরিপন্থি। মেধা কোটা ৫০ শতাংশের কম হওয়া উচিত নয় বলেও মনে করেন তিনি। তার মতে, কোনো কোটাই চিরদিন থাকতে পারে না। প্রত্যেক কোটার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। দেশে যখন ১৭ জেলা ছিল তখন চালু হয় ‘জেলা কোটা’। পরে ১৭ জেলা ভেঙে ৬৪টি করা হলেও সেই কোটাই রয়ে গেছে। অন্যদিকে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে উপজাতি ও প্রতিবন্ধী কোটা সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। এমনকি সংবিধানে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির কথা বলা হলেও সেই অনগ্রসর জনগোষ্ঠী কারা এবং কত দিন ধরে তাদের কোটা দেওয়া যেতে পারে তা নতুন করে ভাবতে হবে।

এ ব্যাপারে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, কোটা উঠিয়ে দেওয়ার দাবি করছি না। তবে কোটা পদ্ধতির সংস্কার চাই। পিএসসি ২০০৮ সালে ইউএনডিপির আর্থিক সহায়তায় দুজন সাবেক অভিজ্ঞ কর্মকর্তার মাধ্যমে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। তারা গোটা ব্যবস্থাটিকে অন্যায্য এবং জনপ্রশাসনের জন্য ক্ষতিকর বলে মতামত দেয়। সুপারিশ রাখে প্রাধিকার কোটায় বড় ধরনের হ্রাসের। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইজিএস একটি গবেষণামূলক নিবন্ধেও অনুরূপ সুপারিশ রয়েছে। কিন্তু কিছুই বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

৫৬ শতাংশ কোটা রাখার যুক্তি নেই বলে মত দিয়েছেন বিশিষ্ট লেখক এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, আমি কোটার বিপক্ষে নই। কিন্তু আমি যা শুনেছি তা হলো বর্তমানে মেধাবীদের থেকে বিভিন্ন জায়গায় কোটাপ্রাপ্তদের সংখ্যা বেশি। চাকরি ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ এমনকি আরো বেশি কোটা রাখা হয়েছে যা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। এই অনুপাতটাকে কমিয়ে আনা প্রয়োজন। তা না হলে মেধাবীদের মূল্যায়ন হবে না।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কোটা পদ্ধতি সংস্কার,জনপ্রশাসন,শিক্ষার্থীদের আন্দোলন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist