জালাল সুমন আহমেদ

  ১৫ মে, ২০১৭

রূপকল্প ২০২১ ও ২০৩০

আমার পাশের গ্রামে একটি নির্বাচনী জনসভা হয়েছিল (নির্বাচনী আচরণবিধি থাকায় এখন আমরা উঠানবৈঠক বা পরামর্শসভা হিসেবে চালিয়ে দিয়ে থাকি)। এমন একটি সভাতে এলাকার একজন দাদা সম্পর্কিত সরদার ধরনের লোক ভোট দেওয়ার জন্য প্রার্থী নির্বাচন করার সুবিধার্থে উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে একটি গল্প বলেছিলেন। সেটি হলো—এক জমিদারের এক অতি আদুরে কন্যা ছিল। তিনি তার কন্যাকে বিয়ে দেবেন। খুব ধুমধাম করে বিয়েও দিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরই কন্যা পিত্রালয়ে ফিরে এসে পিতার কাছে অভিযোগ করল, যে পাত্রে তিনি কন্যাদান করেছেন সেই পাত্রটির আচারব্যবহার খুবই কর্কশ, একেবারে বেরসিক। তাই উক্ত পাত্রের সঙ্গে কন্যা আর ঘর করতে চায় না। অতি আদুরে মেয়ে বলে কথা! জমিদার কন্যাকে আবার বিয়ে দিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর কন্যা আবার ফিরে এলো। এবারের অভিযোগ, পাত্রের আচরণ মিষ্টি। চিনির মতো মোটামুটি তবে...। একটি মাত্র আদুরে মেয়ে বলে কথা! জমিদার আবার আয়োজন করে যোগ্যপাত্রে কন্যাদান করলেন। কিছুদিন পর কন্যা ফিরে এসে একটি অভিযোগ এবং আরেকটি দাবি করল। অভিযোগটি ছিল—তার বর্তমান জামাতার আচার-ব্যবহার মধুর মতো মিষ্টি। তবে, জমিদারের কন্যা হিসেবে সে আরেকটু মিষ্টি বর পেতেই পারে! রাস্তা দিয়ে আসার পথে সে মধুর চেয়েও মিষ্টি একজন পাত্র দেখে এসেছে। তার দাবিটি হচ্ছে তাকে যেন উক্ত মধুর চেয়েও মিষ্টি পাত্রের কাছে আবার বিয়ে দেওয়া হয়। তখন জমিদার কন্যাকে বলল, মাগো মধুর চেয়ে আর মিষ্টি কিছু হতে পারে না। কেউ যদি নিজেকে মধুর চেয়েও মিষ্টি বলে দাবি করে তবে বুঝতে হবে সে শয়তান, তোমাকে ধোঁকা দিচ্ছে। যাও মা মধুর মতো মিষ্টি যে পাত্রের কাছে তোমাকে বিয়ে দিয়েছি তার কাছে ফিরে যাও। এখানেই গল্পের শেষ এবং বাস্তবতার শুরু।

বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া তার দলের ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করেছেন অনেক আয়োজন করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনা তার দলের নির্বাচনী ইশতেহারে দিনবদলের সনদ রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করেন। ভিশন বা রূপকল্প ২০২১ বাংলাদেশের মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম খুব আকৃষ্ট হয়েছিল সেই রূপকল্পে। আর জনগণ যে সাড়া দিয়েছিল তার প্রমাণ আমরা সেই নির্বাচনের ফলাফলে দেখেছিলাম। সেই রূপকল্প ২০২১-এ গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রতিশ্রুতি ছিল, যা ভোটারদের খুব বেশি প্রভাবিত করেছিল—

১. দিনবদলের সনদ ২. ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়, ৩. মধ্যম আয়ের দেশ গড়ে তোলা, ৪. দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, ৫. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার অঙ্গীকার, ৬. নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়া, ৭. দারিদ্র্য বিমোচন, ৮. মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়া প্রতিশ্রুতি ছিল সেই রূপকল্পে। সেই রূপকল্প ২০২১-এর সময় পূর্ণ হতে সামনে আরও চার বছর বাকি। রূপকল্প ২০২১ এই আট বছর শেষে দৃশ্যমান। যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে, হচ্ছে। সারাদেশে ডিজিটালাইজেশন চলছে। এখন আর বাংলাদেশ বিদেশের দয়ার দেশ নেই, বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করে নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবতার মুখ দেখেছে। দারিদ্র্যতা কমে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড গড়েছে। বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে। ওয়ান থেকে টুয়েলভ ক্লাস পর্যন্ত বিনামূল্যে বই দেওয়া হচ্ছে। পিছিয়ে পড়া শিশুদের নয় শুধু তাদের মায়েদেরও উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। কৃষি উপকরণ সারের জন্য আর কৃষককে প্রাণ দিতে হচ্ছে না। যানজট নিরসনে ডজন ডজন ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন ইতিহাসের সর্বোচ্চ। কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা স্বীকৃতি পেয়েছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দক্ষতার সঙ্গে শক্ত হস্তে জঙ্গিবাদ দমন করে চলেছেন। এখন আর গলিপথের গালকাটা কামাল, নাককাটা বাবুল, টাইগার মাস্তানদের উৎপাত না থাকলেও অভিজাত এলাকায় নতুন রূপে তা আবির্ভূত হচ্ছে। এতকিছুর পরও সামনের চার বছরে আমরা আশা করতেই পারি যে, বাকি কাজগুলোও পূর্ণতা পাবে।


যানজট নিরসনে ডজন ডজন ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন ইতিহাসের সর্বোচ্চ। কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা স্বীকৃতি পেয়েছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দক্ষতার সঙ্গে শক্ত হস্তে জঙ্গিবাদ দমন করে চলেছেন। এখন আর গলিপথের গালকাটা কামাল, নাককাটা বাবুল, টাইগার মাস্তানদের উৎপাত না থাকলেও অভিজাত এলাকায় নতুন রূপে তা আবির্ভূত হচ্ছে


বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার দলের রূপকল্প ২০৩০ নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। তিনি বলেছেন, জাতীয় সংসদকে সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু করা হবে। বলেছেন, তিনি এক দিনের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নন, বরং জনগণকে আজীবন গণতন্ত্র দেবেন। নির্বাচিত সরকারের অধীনে জরুরি আইন জারি করা হয়েছিল এই শতাব্দীতে তার সরকারের আমলেই। গণভোট পুনঃস্থাপন করার কথা তিনি বলেছেন! তারপর তিনি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলেছেন। সাংবিধানিক ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা, বিচারবিভাগ, পুলিশ, কারাগার, ঢেলে সাজানো এই বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে গল্প শোনানোর মতো মনে হয়েছে। তিনি শিল্পের উন্নয়নের কথা বলেছেন, কিভাবে করবেন তা বলেননি। অনেকটা শিল্পবিপ্লবের মতো শুনিয়েছে! কিন্তু এই বিপ্লবে তারেক-মামুনদের ভূমিকা কী হবে সেটি কিন্তু বলেননি! মধ্যম আয়ের দেশ হবে, কিন্তু কিভাবে হবে তার কোনো রোডম্যাপ তিনি দেননি। মাথাপিছু আয় ৫০০০ ডলারে উন্নীত করবেন বলেছেন, কিন্তু কিভাবে করবেন তার নির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা ছিল না। তিনি একটি রেইনবো নেশন গড়ার কথা বলেছেন, রংধনুর সাতটি রঙের মতো একটি জাতি গঠনে তার দল আগ্রহী, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ তারা দমন করবেন! কিন্তু তিনি বলেননি এখানে বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমান, মুফতি হান্নানদের ভূমিকা কী হবে!

রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র পুনঃপরীক্ষা করবেন, প্রয়োজনে বাতিল করবেন, ৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি করবেন বলেছেন, খাম্বাগুলো (বিদ্যুৎ তার সংযোগ খুঁটি) কি তারেকের কোম্পানিরই হবে কি না সেটা কিন্তু বলেননি! সুতরাং এই বিষয়গুলোর উত্তর প্রয়োজন ছিল। এ ছাড়া এই রূপকল্প ২০৩০-এ বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের দাবির বিষয়গুলো উঠে আসেনি। যাতে করে আসলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মতামত,রূপকল্প,ভিশন ২০৩০
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist