লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান, এমফিল, এমপিএইচ

  ৩০ এপ্রিল, ২০২২

ঈদ ও ঈদযাত্রায় সুস্বাস্থ্য এবং সুস্থ্য খাদ্যাভ্যাস

ফাইল ছবি

করোনার ছোবলে গত দু'বছর অনেকটা আতঙ্কের মধ্যে উদযাপিত হয়েছে আমাদের ঈদ। এবারের চিত্রটা কিছুটা ভিন্ন। করোনার সংক্রমণের হার নিম্নগতি এবং বেশ ক’দিন মৃত্যু শূন্য থাকায় অনেকটা স্বস্তিতে ঈদ কাটানোর আশা দেশবাসীর। ইতোমধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ পরিবারের সাথে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে নিজ নিজ গন্তব্যেও দিকে রওনা হয়েছেন। জনসংখ্যার আধিক্যে নুহ্য আমাদের দেশে এ যাত্রা যে খুব সুখকর হয়না, এটা আমাদের সবারই জানা। তবুও আমাদের জাতীয় এবং ধর্মীয় সবচেয়ে বড় উৎসবটি নিকটজনের সাথে কাটাতে আমরা সারাবছর উদগ্রীব হয়ে থাকি। তবে ঈদযাত্রা এবং ঈদের দিনগুলোতে যাতে আমরা শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে পারি; সেদিকেও নজর রাখা অত্যাবশ্যকীয়।

ঈদযাত্রায় আমাদের অনেকেরই লম্বা পথ ও দীর্ঘ সময় পাড়ি দিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে হয়। এ সময় পথিমধ্যে রাস্তাঘাট ও বাস স্টেশন, ফেরিঘাট, রেস্টুরেন্টে বিভিন্ন ধরনের স্ট্রিট ফুড খাওয়া হয় আমাদের। ফলে অনেকেই পথিমধ্যে কিংবা গন্তব্যে পৌঁছার পর বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতায় ভুগতে দেখা যায়। ঈদ আনন্দের চেয়ে বরং শারীরিক সুস্থতাটাই তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। মূলত রাস্তাঘাটে, খোলা রেস্টুরেন্ট বা হকারদের খোলা খাবার সর্বদাই স্বাস্থ্যহানির ঝুঁকি থেকে যায়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব খাবার প্রস্ততিতে যথাযথ পরিষ্কার পরিছন্নতা মানা হয়না; খোলা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে বিক্রি করা হয়; খাবার প্রস্তুতের সময় বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করা হয়না এবং খাবার পরিবেশনের সময়ও একই পানি বারবার ব্যবহার করা হয়। ফলে নানা ধরনের পেটের পীড়ার ঝুঁকি থেকে যায়।

আইসিডিডিআর’বির বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যে, এসব অপরিচ্ছন্ন খাবার ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েডসহ পরিপাকতন্ত্রেও অন্যান্য রোগের মূল কারণ। এসব খাবারের অধিকাংশের মধ্যেই খাদ্যনালীতে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া যথা : E.Coli, Norovirus, Vibrio cholenae, Shigella, Salmonella I Giardia রয়েছে। এসব জীবাণু ডায়রিয়া, কলেরা ছাড়াও টাইফয়েড ও হেপাটাইটিস রোগের উৎপন্ন করে।

বিভিন্ন গবেষনায় দেখা গেছে যে, খোলা স্থানে বিক্রয়কৃত ১৩০ ধরনের খাবারের মধ্যে কাবাব, খিচুরি, তেহারি, চিতইপিঠা, ভাপাপিঠা, ছোলাভুনা, হালিম, আলুর চপ, বেগুনি, ডালপুরি, পেয়াজু, পেটিস, চিকেনফ্রাই, ফ্রেঞ্চফ্রাই, রোল অন্যতম। ফুটপাত বাস ও ট্রেন স্টেশন, লঞ্চঘাট ইত্যাদিতে বিক্রয়কৃত এসব সকল খাবারই ঝুঁকিপূর্ণ। জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় প্রায় সকল খাবারেই পাকস্থলী ও খাদ্যনালীর রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ইস্ট, ফাঙ্গাসসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্যহানিকর জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সুতরাং ঈদ উৎসব পালনের জন্য বাড়িতে গমনকারীদের যতটা সম্ভব রাস্তাঘাটের এসব খোলা খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। তাহলে সুস্থ্য অবস্থায় গন্তব্যে গমন এবং আত্মীয়-স্বজনের সাথে ঈদ উৎসবের আনন্দটি ভাগ করে নেওয়া সম্ভব।

বিভিন্ন ধরনের খাবার-দাবারের আয়োজন ঈদ উৎসবের অন্যতম উপাদান। তবে এ বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট সতর্ক থাকা উচিত। বিশেষ করে ঈদুল-ফিতরের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন কারণ, দীর্ঘ ১ মাস রোজা থাকার পর আমাদের পরিপাকতন্ত্রের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে একটু সময় প্রয়োজন হয়। সুতরাং ঈদেও দিন গুলিতে হঠাৎ করে বিভিন্ন ধরনের খাবার বেশি পরিমাণ খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এতে পরিপাকতন্ত্র বিভিন্ন ধরনের ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে থাকে, যেমন : ডায়রিয়া, বদহজম, পেটেব্যাথা, ফুলে থাকা, অ্যাসিডিটি ইত্যাদি।

ঈদুল ফিতরের দিনে সকালে নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে মিষ্টি জাতীয় খাবার যেমন : সেমাই বা পায়েস ইত্যাদি খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে আমাদের। পরিমাণ মতো খেলে সমস্যা নেই, তবে ডায়াবেটিস বা আইবিএস রোগ রয়েছে এমন ব্যক্তিদের সতর্কতার সাথে এসব দুধ ও মিষ্টি জাতীয় খাবার গ্রহণ করা উচিত। নামাজ থেকে ফেরার পর নাস্তাতে থাকে তেল ও মসলা জাতীয় খাবার যথা : পরাটা, লুচি, ভুনাখিচুরি, তেহারি ইত্যাদি। দিনের প্রথমেই ভরপেট না খেয়ে পরিমাণ মতো খাওয়াই ভালো। মাসব্যাপী রোজা এবং গরমের কারণে শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি হয়। এ সময় প্রয়োজন অনুযায়ী পানি, বোরহানি, ফলের জুস বা শরবত পান শরীরের জন্য উপকারী।

দুপুরে সবার ঘরেই ভারী খাবারের আয়োজন থাকে। এর মধ্যে পোলাও, কাচ্চি বিরিয়ানি, মুরগি, খাসি কিংবা গরুর মাংস, কাবাব ইত্যাদির আধিক্য থাকে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে। এ সকল খাবার হজমে বেশ সময় নেয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং এসব খাবারের সাথে সবজি এবং সালাদ থাকাটা জরুরি। অনেকেই এ সময় কোমল পানীয় পান করে থাকেন। এটি কোনক্রমেই হজম বা স্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক নয়। এর পরিবর্তে সাধারণ পানি, বোরহানি বা লাবাং জাতীয় পানীয় শরীরের জন্য উপকারী।

রাতের খাবারের তালিকায় সাধারণত ভাত, মাছ, মুরগী, গরুর মাংস, শাক/সবজি ও ডাল এগুলোতে সীমাবদ্ধ থাকাই ভালো। এ সময় যারা বয়স্ক কিংবা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ, আলসার, আইবিএস, গাউট প্রভৃতি রোগে ভোগেন; তাদের অবশ্যই নিয়ম মেনে পরিমাণমত খেতে হবে। ঘরে এ সময় এন্টাসিড ও মিপ্রাজল, প্যানটোপ্রাজল, ইসোমিপ্রাজল জাতীয় ঔষধ রাখা উচিত। সুযোগ মতো হালকা ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করলে হজমে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

আমরা নাড়ি, বাড়ি ও স্বজনের টানে ঈদ উৎসব করতে যাত্রাপথে বিভিন্ন স্থানে খোলা খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকব এবং ঈদেও দিনে খাবারের যতই বাহার থাকুক না কেন শরীরের সুস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে স্বাস্থ্য সম্মত খাবার গ্রহণ করব। তৈলাক্ত, ঝাল ও অধিক মসলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলব। পরিচ্ছন্নভাবে তৈরি, সহজে হজমযোগ্য এবং পরিমিত খাবার গ্রহণ করে ঈদযাত্রায় ও ঈদে সুস্থ থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ই-মেইল : [email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান,এমফিল,এমপিএইচ,সুস্থ্য খাদ্যাভ্যাস,ঈদ,ঈদযাত্রা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close