এস এইচ এম তরিকুল, রাজশাহী

  ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণে মৃত্যু বাড়ছেই

খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট একটি অযাচিত উপাদান এবং তা নিত্য খাদ্যদ্রব্যের সাথে গ্রহণের ফলে যে সকল স্বাস্থ্যক্ষতি ও মৃত্যু সংঘটিত হচ্ছে, তা পুরোপুরিভাবে প্রতিরোধ করতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে নীতি প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে, যা একটি সময়পোযোগী এবং অত্যন্ত প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে বছরে অন্তত ৫৭৭৬ জন মানুষ শুধু ট্রান্সফ্যাটের কারণেই মৃত্যুবরণ করছে, অর্থাৎ মাসে ৪৮০ জন। যতই বিলম্বিত হচ্ছে ট্রান্সফ্যাটবিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন, ততই অনাকাঙ্খিত প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা বিবেচনায় ইতোমধ্যে বিএফএসএ দ্বারা প্রাথমিক খসড়া নীতিমালা প্রায় প্রস্তুত হয়ে গেছে। আর প্রাথমিক খসড়ার কাজ শেষ হলে মতামতের জন্য সেটি তাদের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হবে। যেখানে ৪০ দিন পর্যন্ত খসড়া নীতিমালা সম্পর্কে সকলের মতামত গ্রহণ করা হবে। তারপর তা চূড়ান্ত নীতিমালা আকারে প্রণয়নের জন্য পাঠানো হবে মন্ত্রণালয়ে। তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের অভিমত, চূড়ান্ত নীতিমালা প্রণয়নের অগ্রগতি মন্থর গতিতে এগোচ্ছে।

সূত্র জানায়, সাধারণত প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার ও বেকারি পণ্যে বিদ্যমান ট্রান্স ফ্যাটি এসিড (টিএফএ) বা ট্রান্সফ্যাট এক ধরণের ফ্যাট বা স্নেহ জাতীয় খাদ্য উপাদান যা রক্তের এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে। অপরদিকে এইচডিএল বা ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয়। অতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণে খারাপ কোলেস্টেরল রক্তবাহী ধমনিতে জমা হয়ে রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ। অথচ ট্রান্সফ্যাটের ক্ষতি সম্পর্কে দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষেরই ধারণা নেই। উচ্চমাত্রায় ট্রান্সফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) গ্রহণ হার্ট অ্যাটাকসহ হৃদরোগজনিত মৃত্যুঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন মতে, বিশ্বে ট্রান্সফ্যাট ঘটিত হৃদরোগে মৃত্যুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ঘটে ১৫টি দেশে। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ৩১ হাজার মানুষ সার্বিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। যার মধ্যে ৪.৪১ শতাংশ অর্থাৎ ৫৭৭৬ জনের মৃত্যুর জন্য দায়ি ট্রান্সফ্যাট। শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট নির্মূলে সর্বোত্তম নীতি অর্থাৎ সকল ফ্যাট, তেল এবং খাবারে প্রতি ১০০ গ্রাম ফ্যাটে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ পরিমাণ ২ গ্রামে সীমিত করা, অথবা পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল-পিএইচও’র উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। একই সাথে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট নির্মূলের জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

খাদ্যের সাথে ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের ফলে দীর্ঘদিন দিন ধরে জনস্বাস্থ্যের এত ক্ষতিসাধন হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নীরব ভূমিকায় রয়েছে।

এ বিষয়ে ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অফ বাংলাদেশ, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ক্যাব) এবং অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই)-এর সহযোগিতায় ‘ট্রান্সফ্যাট নির্মূল করি, হৃদরোগের ঝুঁকি কমাই’ শীর্ষক একটি অ্যাডভোকেসি ক্যাম্পেইন উদ্বোধন হয়।

ওই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি বলেছিলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাট নির্মূল করতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হবে। তিনি বলেন, খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা ২ শতাংশ নির্ধারণ করতে নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করাও জরুরি। অথচ পরবর্তী এক বছর সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনও রকম পদক্ষেপগ্রহণ করার তথ্য পাওয়া যায়নি।

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত এমপি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় আমরা নিশ্চয় ২০২৩ সালের মধ্যে খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারব। একজন সংসদ সদস্য হিসেবে ট্রান্সফ্যাট নির্মূল করতে নীতি প্রণয়নে পূর্ণ সহযোগিতারও আশ্বাস দেন তিনি।

অন্যদিকে ভোক্তা সাধারণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাট নির্মূল করতে করণীয় এবং ভোক্তা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ৯ দফা ভোক্তা দাবিনামা তুলে ধরে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে সিরডাপ মিলনায়তনে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এবং প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) সম্মিলিতভাবে গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই)-এর সহযোগিতায় ‘খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট, হৃদরোগ ঝুঁকি এবং করণীয়: ভোক্তা পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা আয়োজন করে। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন এমপি বলেছিলেন, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাট নির্মূলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ৯ দফা ভোক্তা দাবিনামা বাস্তবায়ন করা হবে। আর ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে পুরাতন আইন সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযোগী করা হবে।

তবে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই) গত ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে স্বাক্ষরিত এক সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি জারি করে, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিএসটিআই ইতোমধ্যে পরীক্ষণ সুবিধাদি সৃষ্টিসহ ট্রান্সফ্যাট প্যারামিটারটি সংশ্লিষ্ট পণ্যের জাতীয় মানে অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) রাজশাহী শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম মোস্তফা মামুন প্রতিবেদককে বলেন, বাংলাদেশে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা না থাকায় জনস্বাস্থ্যমারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এমতাবস্থায়, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবধরনের ফ্যাট, তেল এবং খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চসীমা মোট ফ্যাটের ২ শতাংশ নির্ধারণ পূর্বক কার্যকর করা অতীব জরুরি।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মৃত্যু,বিএফএসএ,অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণ,ট্রান্সফ্যাট
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close