জান্নাতুল মাওয়া নাজ

  ২৩ জুলাই, ২০২০

সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য

সকল সুখের ও সৌন্দর্যের মূল হচ্ছে সুস্বাস্থ্য। সুস্বাস্থ্য ছাড়া জীবনের সব অর্জনই বৃথা। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য যেমন প্রয়োজন, সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ খাদ্য। যে খাদ্য দেহের জন্য ক্ষতিকর নয় বরং দেহের বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ ও রোগ প্রতিরোধ করে তাই স্বাস্থ্যসম্মত বা নিরাপদ খাদ্য। নিরাপদ খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেকসই জীবন ও সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নেই। অনিরাপদ খাদ্য শুধু স্বাস্থ্যের ঝুঁকিরই কারণ নয়, বরং দেহে রোগের বাসা বাঁধারও অন্যতম কারণ। বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার সুস্থ ও সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনে একান্ত অপরিহার্য।

আধুনিক জীবনে শিল্পজাত খাদ্য একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। এ খাদ্যকে স্বাভাবিক এবং ভেজাল ও অন্যান্য দূষণ থেকে নিরাপদ অবস্থায় বিতরণ এখন একটি বিশ্ব সমস্যা। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, দেশের প্রায় সব খাদ্যেই ভেজাল রয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার আজ আমাদের নাগালের বাইরে। দেশের সব মানুষ আজ খাদ্যে ভেজালের আতঙ্কে। খাদ্যে ভেজালের দৌরাত্ম্যে জনজীবন আজ হুমকির সম্মুখীন।

নিরাপদ খাবার উপহার দিতে না পারলে একসময় জাতি পঙ্গু হয়ে যাবে। শুধু খাদ্যে ভেজালের কারণে দেশে প্রতি বছর তিন লাখ লোক ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা দেশে প্রায় ১৫ লাখ। খাদ্যে ভেজাল ও নকল ওষুধ প্রস্তুত দেশে মহামারি আকার ধারণ করেছে। ঢাকা শহরের ৭০ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে ৫০ শতাংশ খাদ্যে ভেজাল। এক গবেষণা সূত্রে জানা যায়, আমাদের শরীরে ৩৩ শতাংশ রোগ হওয়ার পেছনে রয়েছে ভেজাল খাদ্য। রাষ্ট্রকে এখনই ভেজাল খাদ্য ও নকল ওষুধের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। খাদ্যে ভেজাল শুধু যে শারীরিক ক্ষতি তা নয়, খাদ্যে ভেজালের কারণে জাতীয় উন্নতিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। খাদ্যে ভেজালের কারণেই দেশে বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেইলউর, হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানি ইত্যাদি জটিল রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তায় ২০১৩ সালে আইন হয়েছে। ২০১৫ সালে গঠন করা হয়েছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। ভেজালবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি তারা কাজ করছে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে। আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেজালবিরোধী অভিযান। তার পরও কমছে না ভেজালের ব্যাপকতা। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া এবং ভেজাল খাদ্য বিক্রির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ১৪ বছরের কারাদন্ড বিধান রাখা হয়েছে। আমরা আশা করব, ভেজালবিরোধী অভিযান কঠোর হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত হবে। ভেজালপণ্য ও অসাধু ব্যবসায়ীদের ঠেকাতে অভিযান নিয়মিত থাকলে ভেজালকারীদের দৌরাত্ম্য অনেকাংশে কমে আসবে বলে আশা করা যায়। তবে ভেজাল ঠেকাতে সচেতনতার বিকল্প নেই। শুধু আইন দিয়ে ভেজাল ঠেকানো সম্ভব নয়। এজন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ২৫ লাখ ক্ষুদ্র বা অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসায়ী ও ১৮টি মন্ত্রণালয় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় জড়িত। এ ছাড়া দেশে প্রায় ৪৮৬টি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে স¤পৃক্ত। এসব প্রতিষ্ঠানের অধীন প্রায় ১২০টি আইন ও নীতিমালা রয়েছে। সর্বস্তরে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যত আইন রয়েছে, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সেগুলো কার্যকর করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ ছাড়াও ৬৪টি জেলায় ও আটটি বিভাগীয় শহরে ৭৪টি নিরাপদ খাদ্য আদালত প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় গুণগত পরিবর্তন আবশ্যক। আধুনিক ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে চাষাবাদের জন্য কৃষককে আগ্রহী করতে হবে। এ ছাড়া এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ ও স¤পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিরাপদ খাদ্য স¤পর্কে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। সচেতনতার মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্যের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করতে হবে।

জনগণের নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণ বাংলাদেশের জন্য এখন দুটি চ্যালেঞ্জ। কৃষি উৎপাদন বাড়লে নিরাপদ ও পুষ্টিমান স¤পন্ন খাদ্যের জোগান নিশ্চিত হবে। উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবস¤পদে পরিণত করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে মূল্য সংযোজন ও রফতানি বাড়াতে পারলে দেশের বাজারও সম্প্রসারণ হবে। কৃষক তার ফসলের ন্যায্য দাম পাবেন। দেশের ১৬ কোটি মানুষের অধিকাংশই তাদের আয় দিয়ে সবজি, ডিম ও দুধসহ প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য কিনে খেতে পারেন না। তাই সম্ভাবনা থাকলেও দেশের অভ্যন্তরের কাাঙ্ক্ষত কৃষিপণ্যের বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে না।

সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কাজ করতে হবে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে। উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ এবং বিপণনের এবং খাবার টেবিলে পরিবেশন পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে নিরাপদ খাবার নিশ্চিতকরণের বিধিবিধানগুলো পুরোপুরিভাবে অনুসরণ করা দরকার। না হলে নিরাপদ খাদ্যও অনিরাপদ হয়ে যেতে পারে। সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য স্বাস্থ্যবান ও কর্মক্ষম জনশক্তির বিকল্প নেই। আর কর্মক্ষম জনশক্তির জন্য পুষ্টি-সমৃদ্ধ নিরাপদ খাবারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এ ছাড়া উৎপাদক থেকে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত ভ্যালু চেইন সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা হলে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাবে। এই চেইন বাস্তবায়ন নারী-পুরুষ সবার জন্যই বাজারে সরাসরি পণ্য বিক্রয় সহজ হবে। কৃষক তার ফসলের ন্যায্য দাম পাবেন। এতে বৃদ্ধি পাবে মুনাফার পরিমাণ এবং কৃষি উৎপাদনও বাড়বে। সেই সঙ্গে নিশ্চিত হবে নিরাপদ ও পুষ্টি মানসম্পন্ন খাদ্যের জোগান।

নিরাপদ খাদ্যের প্রচার শহর, নগর ও প্রতিটি গ্রামে করতে হবে। পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ হলে সভ্যতার ক্রমবিকাশও সহজ হয়। পুষ্টির অভাবে মানুষের স্বাভাবিক চিন্তাচেতনার বিকাশ ব্যাহত হয়। মানুষকে স্বাভাবিক কর্মচাঞ্চল্যে ফিরিয়ে আনতে সুস্থ মানুষের প্রয়োজন। এ সুস্থ মানুষ সৃষ্টির জন্য পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ জরুরি। যা ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প’ ধারণার বাস্তবায়ন থেকে সহজ প্রাপ্য। একটি বাড়ি বা খামারের আকার কী হবে, এটা চিন্তা না করে তার প্রতি ইঞ্চি জমিকে কাজে লাগিয়ে নিজস্ব পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা যায় এবং বাড়তি আয়-রোজগারের মাধ্যমে উন্নত মননশীলতার চর্চায় সে অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে। আকার-আকৃতি বিবেচনায় না এনে আলোক চাহিদা, মাটি ও বেড়ে ওঠার প্রকৃতিকে বিশ্লেষণপূর্বক স্থান ও সময়ানুযায়ী ডিজাইন করে শাকসবজি, ফল, ফুল, ঔষধিগাছ, মাছ চাষ ও সংরক্ষণ, হাঁস-মুরগি, কোয়েলপাখি, কবুতর এবং গরু-ছাগল, খরগোশ ও মৌমাছি লালনপালনসহ বাড়তি কর্মসংস্থানের জন্য কুটির শিল্প, মাশরুম চাষ ও প্রক্রিয়াজাত করা, সেলাই, মুড়ি, খৈ, চিড়া, দই ও আচার তৈরি ইত্যাদি কাজকর্মগুলো করা যেতে পারে। এভাবে গ্রাম বাংলার খাদ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থ ও সংস্কৃতি প্রবাহের মূল স্রোতধারা হতে পারে পারিবারিক কৃষি। উপজেলা চেয়ারম্যান বা উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে বাজারে ভেজাল খাদ্যের তদারকির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চাষাবাদে রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে জৈব সার প্রস্তুত করে ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।

নিরাপদ খাদ্য যেমন সবার জন্য প্রয়োজন। তেমনি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সবাইকে সচেতনতার সঙ্গে স্বীয় দায়িত্ব পালন করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য পণ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, সরবরাহ ও বিপণন প্রতিটি পর্যায়ে সচেতনতা প্রয়োজন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব। নিরাপদ খাদ্য আমাদের অর্জনের পেছনে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে, কারণ নিরাপদ খাদ্যের মাধ্যমেই আমরা পাব অর্থনীতির চালিকাশক্তি এবং সুস্থ, সবল, কর্মঠ ও দক্ষ মানবসম্পদ।

লেখক : শিক্ষার্থী

এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
নিরাপদ খাদ্য,খাদ্যে ভেজাল,সচেতনতা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close