শরীফুল রুকন, চট্টগ্রাম

  ১১ ডিসেম্বর, ২০১৭

ছিলেন ‘রাজাকার’ এখন ক্ষমতাবান ও ত্রাস!

মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া বাড়ি দখলের অভিযোগও আছে এই বিহারির বিরুদ্ধে। সরকারি অফিসকে দোকান হিসেবে ভাড়াও দিচ্ছেন তিনি। চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামি থানাধীন ‘রৌফাবাদ কলোনির ত্রাস’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া কে এই আবদুল মান্নান ওরফে রাজাকার মান্নান?

বাহাত্তরের দালাল আইনে অভিযুক্ত রাজাকারের তালিকায় ১৪২ নম্বরে নাম রয়েছে আবদুল মান্নান ওরফে রাজাকার মান্নান ওরফে কসাই মান্নানের। ২০১৬ সালে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার লিখিত অনুমোদনে রৌফাবাদ বিহারি কলোনির এডহক কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পান মান্নান। সেই সুবাদে রৌফাবাদের মাজার ও মসজিদ কমিটি এবং সমাজ কমিটির দায়িত্বেও আছেন তিনি। মান্নানের ছেলে এস এম জসিম উদ্দিন ফাহিম যুবদলের রাজনীতিতে যুক্ত।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নিজেকে মহল্লা কমিটির সর্দার দাবি করে আসছেন আবদুল মান্নান। এলাকাজুড়ে বিবাহসহ যেকোনো অনুষ্ঠান হলে দেড় হাজার থেকে তিন হাজার টাকা তাকে বাধ্যতামূলক ‘সর্দারি’ দিতে হয়। নাজমা বেগম নামের এক অসহায় নারীর সম্পত্তি সঠিকভাবে ভাগ না করে বিচার মানতে বাধ্য করেন মান্নান। ছয় মাস আগে ওই নারী প্রতিকার চেয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার নামে অভিযোগ করেন। এরপর বিষয়টি তদন্তের জন্য রৌফাবাদ বিহারি কলোনির চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু চেয়ারম্যান এখনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেননি।

এর আগে ২০১২ সালে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে মান্নানের বিরুদ্ধে মামলা করেন এক নারী। পরে ওই মামলাটি জোর করে আপসে সমাধান করা হয়। টাকার বিনিময়ে বিচার করার ঘটনায় ২০১১ সালে মান্নানের বিরুদ্ধে একটি মামলা হলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ওই মামলায় ১৫ দিন তিনি কারাগারে ছিলেন। এরপর থেকে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন মান্নান। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতার অনুসারী হিসেবে পরিচিত তিনি। তার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেওয়া দূরের কথা প্রকাশ্যে কিছু বলার সাহসও পান না স্থানীয়রা।

এ বিষয়ে নগরের ৩নং পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের সৈয়দপাড়ার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা মো. আবু তাহের বলেন, ‘মান্নান বিহারি হলেও রৌফাবাদের বাসিন্দা নন। তিনি মির্দাপাড়ার বাসিন্দা। মুক্তিযুদ্ধের সময় মান্নান ও তার ভাইরা রাজাকার হিসেবে কাজ করেন। তাদের বহু স্বাধীনতাবিরোধী কাজ আমি দেখেছি। রাজাকারের তালিকায় ১৪২ নম্বরে মান্নানের ও ১৪৩ নম্বরে তার ভাই সুলতান আহমদের নাম রয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর সুলতান পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। কিছুদিন আগে তিনি মারা যান।’

তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের পর তার কয়েকজন স্বজন পাকিস্তানে চলে যান। আর বাঙালিদের রোষানল থেকে রক্ষা পেতে পরিবারের অন্যদের নিয়ে রৌফাবাদ বিহারি কলোনিতে আশ্রয় নেন মান্নান। বিহারিদের ফেলে যাওয়া বাড়িও তিনি দখল করে ভোগ করছেন। এখন তিনি পুরো রৌফাবাদ কলোনি শাসন করছেন। তার কথার বাইরে কেউ যেতে পারেন না।’

মুক্তিযোদ্ধা মো. আবু তাহের বলেন, ‘রৌফাবাদ কলোনির চেয়ারম্যান কার্যালয় দখল করে মান্নান দোকান ভাড়া দেওয়ার জন্য অগ্রিম টাকা নিয়েছেন, চুক্তি করেছেন। অথচ ওই স্থাপনার মালিক সরকার। অনেক নারীর প্রতিও তিনি নীরব নির্যাতন চালাচ্ছেন। কুখ্যাত দেশদ্রোহী মান্নানকে প্রশাসন দায়িত্ব দিয়েছেন—এটা দুঃখজনক। তাকে সব ধরনের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে আমি জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রৌফাবাদ বিহারি কলোনির এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমাদের কলোনিতে চেয়ারম্যান কার্যালয় নামে একটি অফিস আছে। সরকার এটি তৈরি করে দিয়েছিল, সেখান থেকে কলোনির দেখভাল করার জন্য। আর এই কার্যালয়ের জায়গায় দোকান ভাড়া দিতে অগ্রিম টাকা নিয়ে ফেলেছেন মান্নান। তিনি যা ইচ্ছে করছেন। তার অপকর্মের কারণে আমরা অতিষ্ঠ। কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারে না।’

রৌফাবাদ বিহারি কলোনির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ছেলে মুন্না ফোন ধরেন; তিনি জানান, ‘তার বাবা মানবাধিকার বিষয়ে মিটিং নিয়ে ব্যস্ত। এখন কথা বলতে পারছেন না।’ অভিযোগের বিষয়ে আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমার সঙ্গে শত্রুতা করছে অনেকে। রাজাকারের তালিকায় যে মান্নানের নাম উল্লেখ আছে সেটা আমি না। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কমিশনারের কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। কিন্তু তারা তদন্ত করে সত্যতা পায়নি। এখন আপনি তদন্ত করে দেখুন। আমার সঙ্গে দেখা করুন। আমি সব বুঝিয়ে বলব।’ রৌফাবাদ বিহারি কলোনি তদারকির দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘মান্নানের ব্যাপারে আমি অবগত। তার ব্যাপারে বহু অভিযোগ এসেছে আমার কাছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। এরপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মানবতাবিরোধী অপরাধ,রাজাকার মান্নান,রৌফাবাদ কলোনি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist