মাসউদুল কাদির

  ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

রাশি রাশি আনন্দ

—আল্লাহ হাফিজ বাবা

—হুঁ, আল্লাহ হাফিজ।

—বাবা, শোনো। আজকে আমার জন্য কী আনবা? জুস, আইসক্রিম, চকোলেট আরো আরো সব আনবা।

এবার আর না হেসে পারলেন না নাবিল মুরতাজা। অফিসে যাওয়ার জন তৈরি হলেই আদরের সন্তান রাইয়ান তাকে এ রকম নিজের বায়নার কথাগুলো শোনায়। ঘরের ভেতরে থাকতে রাইয়ানের আম্মু ঘরের প্রয়োজনীয় সবকিছুর একটা ফিরিস্তি শুনিয়ে দেন। কখনো কখনো অসহ্য মনে হয় তার স্ত্রীর কথা। আবার কখনো কখনো ভালো লাগে। পকেটের অবস্থা ভালো থাকলে সবকিছু শুনতে মন চায়। ভালো লাগে। খানিক আগে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে রাগারাগি করে এলেও রাইয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে না হেসে পারলেন না।

আবারও আল্লাহ হাফিজ বলে পথ ধরলেন নাবিল মুরতাজা। মনে মনে ভাবেন, বাড়িওয়ালার সঙ্গে যেন সাক্ষাৎ না হয়। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত পোহায়—একটা কথা আছে না। আয়াতুল কুরসি জপতে জপতে অকস্মাৎ ডাক শুনলেন, নাবিল সাহেব, কী খবর? কেমন আছেন? আজকে তো ১৭ তারিখ।

নাবিল মুরতাজা মাথা উঁচু করে বাড়িওয়ালার দিকে তাকালেন। ভাড়া চাইলে একটুও খারাপ লাগে না। পাওনা টাকা চাইবে তাতে রাগ-অভিমানের কিছু নেই। লোকটা যখন কথায় কথায় নোটিস দেয়, বাসা ছাড়তে বলে তখন আর মেজাজ ধরে রাখতে পারেন না নাবিল সাহেব।

আবার বাড়িওয়ালার আওয়াজ। প্রতি মাসেই তো ভাড়া নিয়ে ক্যাচাল হয়। গত মাসে দিছেন ২৫ তারিখ। এর আগের মাসেও তেমনি। আমি টু-লেট লাগিয়ে দিয়েছি। কাউকে পাইলেই আপনাকে বাসা ছাড়তে হবে।

নাবিল মুরতাজার ঠিকই রাগ উঠে গেল। উত্তেজিত হয়ে বললেন, আপনার কোন মাসের ভাড়া আমি দিইনি। আপনার কাছে তো অগ্রিম আরো দুই মাসের ভাড়ার টাকা জমা আছে। আপনার লজ্জা হয় না? মুখে যা আসে তাই বলেন। শুনেন ভাই, আমরা ভাড়া থাকি, সারা শহরটা আমাদের। আর আপনাদের এই কবুতরের খোপ ছাড়া উপায় নেই। আমরা যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারব।

বাড়িওয়ালা আর কথা বাড়াল না। ১০ তারিখ হলেই যার সঙ্গে দেখা হবে, তার ভাড়ার বিষয় ছাড়া আর কথা নেই।

নাবিল মুরতাজা প্রচণ্ড তিক্ততা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলেন। গলিটা পার হওয়াই বড় সমস্যা। ডান দিকের গলিপথের দোকান থেকে চালের বস্তা এনেছিলেন। এখনো কিছু টাকা বাকি। বাম দিক দিয়েও যাওয়া যায়। কিন্তু ওদিককার একটা দোকান থেকেও তেল-সাবান কিনেছিলেন। তবু ডানপথেই পা বাড়ালেন। দোকানের সামনে যেতে তার খারাপ লাগে। দোকানি আবার কী বলে বসে।

তখনই ফোন বেজে উঠল; প্লিজ পেঁয়াজ নেই। এক কেজি পেঁয়াজ দিয়ে যাও। ব্যালেন্ডার করে রাখতে হবে। মানি ব্যাগে গাড়ি ভাড়াটাই সার। এ মুহূর্তে মেজাজটা তার আরো বেশি খারাপ হলো। চড়ে গেল। নিজেকে সংযত করলেন। একটু আগে বাসায় রাগারাগির পরও তার স্ত্রী ফোন করে যেহেতু পেঁয়াজ চেয়েছে, নাবিল মুরতাজা ভাবলেন, নিশ্চয়ই প্রয়োজন বলেই ফোন দিয়েছে। পজেলিটিভলি চিন্তা করে নিজেকে শান্ত করলেন। স্ত্রীকে জানালেন, আমি বাসায় ফেরার সময় নিয়ে আসব।


রাইয়ানের আম্মুর কি যেন মনে হলো, চটপটি খাওয়ার ফাঁকে বাসায় কেউ ঢুকেছিল। বারান্দায় গেলেন। চিৎকার দিয়ে উঠলেন তিনি। আমার মাটির ব্যাংক ভেঙে চটপটি?


ভাই, আপনার তো ৪টায় আসার কথা।

—হয়েছেটা কী? আপনি নিউজ এডিটর, অন্যরাও তো লেট করে আসে, তাই না? অ্যাকাউন্সের খবর কী? সেটা বলেন? আজকে বেতন হবে?

—অনেক বেশি সম্ভাবনা।

নাবিল মুরতাজা ডেইলি পত্রিকার সিটি এডিটর। প্রতিদিন পাতাটা করেন খুব মন দিয়ে। আজকে বাড়িওয়ালা মাথা থেকে যাচ্ছেই না। পাতায় মনও বসছে না। তবু ডেস্কে জমা নিউজগুলো সম্পাদনা করে একটা পাতা দাঁড় করালেন। তখন মফস্বল সম্পাদক আতাব ভাই নাবিল সাহেবের কাছে এলেন। কাগজে-কলমে তিনি মফস্বল সম্পাদক হলেও মেইল নামানোর দায়িত্ব তার কাছে নেই। হাই-হ্যালোর ঝামেলাও তার পোহাতে হয় না। লাভ-লোকশানের হিসাব থেকে তিনি বঞ্চিত। এই হাউসের অনেকের কাছেই তিনি টাকা ধার নিয়ে রেখেছেন। তবে নাবিল সাহেব বাকি। আজকে তার কিছু টাকা লাগবেই।

ঠিকমতো বেতন না হলে সবারই সমস্যা দেখা দেয়। আবার কিছু মানুষ আছে যারা নিজেরাই অনেক সমস্যা তৈরি করেন। আতাব ভাই অনেকটা এমনই। টাকা হাতে এলে গজ গজ করে খরচ করেন। আতাব ভাইয়ের মাথায় হাত। আজকে দুই হাজার টাকা না হলে তার মেয়েটা কাল পরীক্ষা দিতে পারবে না। চার মাসের বেতন বাকি। এ বেতনেই তো শিক্ষকদের যৎসামান্য ভাতা দেওয়া হয়। আতাব ভাইকে বারবার বুঝিয়ে বলার পরও তিনি টাকাটা দেননি।

আতাব সাহেব অনেক আশা নিয়ে নাবিল মুরতাজার কাছে বিষয়টা বুঝিয়ে বললেন। তিনি প্রথমে আমলে না নিয়ে বললেন, আপনি অ্যাকাউন্সে বলেন। এই টাকা তো সব সময় অ্যাকাউন্স দেয়। আতাব সাহেব বললেন, ভাই, আমাকে কবার দেবে, অলরেডি আমি দুবার নিয়েছি।

এই বলে আতাব সাহেব এদিক-ওদিক তাকিয়ে নাবিল মুরতাজার পায়ে ধরে ফেললেন। লজ্জায় লাল হয়ে আতাব সাহেবকে আশ^স্ত করে বললেন, দাঁড়ান দেখছি।

এখন যেন তার দায়িত্ব হয়ে গেল টাকাটা জোগাড় করে দিতে হবে। তার নিজেরই নুন আনতে পান্তা ফুরায়। আবার অ্যাকাউন্সে হানা দিলেন নাবিল মুরতাজা। অ্যাকাউন্স জানাল, আজকে কোনো অগ্রিম টাকা দেওয়া যাবে না। আর চেক পাস না হওয়ায় আজকে বেতনও হচ্ছে না।

এবার মাথা দিয়ে ভাঁপ উঠছে নাবিল মুরতাজার। তিনি আতাব সাহেবের মেয়েটাকে দেখেছেন। কী ফুটফুটে চমৎকার। এই মেয়েটা অল্প টাকার জন্য পরীক্ষা দিতে পারবে না—এটা ভাবতেই পারছেন না তিনি।

নাবিল মুরতাজা বাসায় ফোন দিলেন। তার প্রিয়তমা স্ত্রী খুশি খুশি ফোন ধরলেন। এ রকম ফোনের কিছু তরজমা থাকে। বেতন পেলে এ রকম খুশি খুশি ফোন আসে। রাইয়ানের আম্মু জানতে চাইলেন, অসময়ে কিসের জন্য ফোন?

—আরে না, কিছুই না। আজকে রাইয়ানকে নিয়ে ১০টায় একটু হাতিরঝিলের চটপটির দোকানে আসো। চটপটি খেতে মন চাচ্ছে।

—তুমি বাসায় আসো, একসঙ্গে বের হই।

—না, পারব না। আমি সরাসরি লাল মিয়ার চটপটির দোকানে চলে আসব।

—ওকে।

চটপটির দোকানে বসে একটু আনমনাও মনে হলো নাবিলকে। এ রকম দেখে না তাকে। তবে চোখেমুখে অদ্ভুত এক আনন্দ কাজ করছে। খেলা করছে যেন। রাইয়ানকে ধরে বারবার চুমু খাচ্ছে। মাঝে মাঝে তার চোখ যেন ছলছল করছে। যতই রাগারাগি হোক, দুজনের মধ্যের ভালোবাসাটুকু তো আর কেউ কেড়ে নিতে পারে না। রাইয়ানের আম্মু ভাবলেন, যা বলার বাসায় গিয়েই বলবে।

বাসার কাছাকাছি নাবিল মুরতাজা সবার সঙ্গে ওপরে উঠলেন না। বললেন, যাও তোমরা। আমি পেঁয়াজ নিয়ে আসি। রাইয়ানরা উঠে গেল। রাইয়ানের আম্মুর কি যেন মনে হলো, চটপটি খাওয়ার ফাঁকে বাসায় কেউ ঢুকেছিল। বারান্দায় গেলেন। চিৎকার দিয়ে উঠলেন তিনি। আমার মাটির ব্যাংক ভেঙে চটপটি? তার চোখে জল চলে এলো। গোস্বায় ঠোঁট কামরাতে লাগলেন। বারান্দায় নাবিল মুরতাজার আগমনের পথে তাকালেন। ভেসে উঠল আরেক চিত্রকল্প। নাবিল মুরতাজার বুকে পড়ে একটা লোক কান্না করছে। তবে বোঝা যাচ্ছে খুব খুশির কান্না। যে কান্নায় রাশি রাশি আনন্দ।

লেখক : শিক্ষক ও সাংবাদিক [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আনন্দ,মাসউদুল কাদির,গল্প,রাশি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close