শরীফুল রুকন, চট্টগ্রাম
চট্রগ্রাম সিটির ৩০০ কিমি সড়ক বেহাল
গত জুন-জুলাইয়ে স্মরণকালের অতিবৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় ডুবে গিয়েছিল চট্টগ্রামের অধিকাংশ এলাকা। পানি নেমে যাওয়ার পর নগরীর সড়কগুলো জেগে ওঠে কঙ্কালসার কাঠামো নিয়ে। একই রুপ নেয় রাজধানীর সড়কগুলোও। বৃষ্টি-বন্যাতে ব্যাপক ক্ষতি হয় সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কের। বৃষ্টি ও বন্যা শেষ হলেও এখনো এসব সড়ক সংস্কারের কাজ শুরু হয়নি। কর্তৃপক্ষ বলছে, জানুয়ারির আগে কাজে হাত দেওয়া সম্ভব নয়। অথচ এসব ভাঙাচোরা সড়ক নিয়ে ভীষণ দুর্ভোগে রয়েছে মানুষ।
চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট-কালুরঘাট পর্যন্ত আরাকান সড়কের এক পাশ খুঁড়েছে ওয়াসা। সড়কের বহদ্দারহাট অংশে উড়াল সড়কের র্যাম্প নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। চার বছর আগে নির্মিত এ সড়কের বেশির ভাগ অংশে এখন পিচের অস্তিত্ব নেই। সড়কজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় গর্ত। গর্তে গাড়ি আটকে প্রায় সময় লেগে থাকছে যানজট। চরম ঝুঁকি নিয়ে বিপজ্জনক এ সড়কে করছে যান চলাচল। এতে প্রতিদিন ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ফয়সাল আলম এ সড়ক দিয়ে নিয়মিত অফিসে যাতায়াত করেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হয় নরক পার হচ্ছি। রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। গর্তে গাড়ি আটকে সব সময় যানজট লেগে থাকছে। এক কিলোমিটার সড়ক পাড়ি দিতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগছে। মানুষের এত দুর্ভোগের পরও সংস্কারের কোনো পদক্ষেপ দেখছি না।
গত জুন-জুলাইয়ে স্মরণকালের অতিবৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে প্রায় পুরো চট্টগ্রামই পানির নিচে তলিয়ে যায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সড়ক। পানি নেমে গেলে সড়কগুলো জেগে ওঠে কঙ্কালসার কাঠামো নিয়ে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, শুধু বহদ্দারহাট-কালুরঘাট সড়কই নয়, তখন চট্টগ্রাম নগরের মোট এক হাজার ১৭৪ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার সড়ক বেহাল রূপ নেয়। এসব সড়ক সংস্কার করতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা লাগবে বলে ধারণা করছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। অতিবৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে ভাঙা সড়কের কোথাও পিচঢালাই উঠে গিয়ে বড় গর্ত, কোথাও খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে।
সিটি করপোরেশন বলেছিল, পানি নামার পরপরই রাস্তার কাজে হাত দেবে। কিন্তু গত তিন মাসেও ভাঙাচোরা সড়ক মেরামত শুরু হয়নি। কেবল দরপত্র আহ্বান করেছে কর্তৃপক্ষ। তাৎক্ষণিকভাবে ইট-বালি দিয়ে সড়কের ভাঙা অংশ সংস্কার করলেও বেশিদিন টেকেনি। ফলে এখনো চরম দুর্ভোগ নিয়েই এসব ভাঙাচোরা সড়ক দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
সরেজমিন দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরাকান সড়কের বহদ্দারহাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত অংশ। চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে এ সড়কটি। এ সড়কের জায়গায় জায়গায় বড় গর্ত। প্রতিনিয়ত এসব গর্তে পড়ে যানবাহন বিকল ও নষ্ট হয়ে যায়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে যানবাহন। বিভিন্ন স্থানে একমুখী যান চলাচলের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট। বহদ্দারহাট থেকে শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়কের অবস্থাও বেহাল। বহদ্দারহাট মোড়, বহদ্দার বাড়ি পুকুরপাড়, এক কিলোমিটার, রাহাত্তার পুল, কালামিয়া বাজার, বাকলিয়া থানা, তুলাতলী, রাজাখালী সেতুসহ একাধিক স্থানে গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। সড়কের ওপরের পিচ নেই বললেই চলে।
এছাড়া ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত সৃষ্টি হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্র্যাংক রোডের কদমতলী থেকে অলংকার মোড় পর্যন্ত অংশে। জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সড়কটির বিভিন্ন অংশে দেবে গেছে। ক্ষতবিক্ষত সড়ক দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল অব্যাহত থাকায় দিন দিন তা নাজুক অবস্থায় পরিণত হয়েছে। একই অবস্থা আগ্রাবাদ এক্সেস রোড ও চৌমুহনী থেকে হালিশহর রোডের। পোর্ট কানেকটিং রোড, ডিটি রোড, সদরঘাট-মাঝিরঘাট রোডে ভারী যানবাহন চলাচল করে। এতে এসব সড়কের দুরবস্থা আরো নাজুক হচ্ছে।
একইভাবে শেখ মুজিব সড়কের লালখান বাজার থেকে আগ্রাবাদ অংশ, বারিক বিল্ডিং মোড়, নিমতলা, সল্টগোলা ক্রসিং, স্টিলমিল বাজার, কাঠগড় অংশে, পোর্ট কানেকটিং সড়কের পিসি স্কুল, নিমতলা ট্রাক স্ট্যান্ড, নয়া বাজার মোড়, সিডিএ মার্কেট মোড় এলাকায়, অক্সিজেন-মুরাদপুর, বহদ্দারহাট-বলিরহাট, ষোলশহর-অক্সিজেন, চক সুপার মার্কেট-ধুনীরপুল, বহদ্দারহাট-নতুন ব্রিজ, ফইল্যাতলী বাজার-দেওয়ানহাট সড়ক, নিমতলা, পোর্ট কলোনি ও বড়পোল এলাকায় সড়কের অবস্থা খুবই নাজুক।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, পানির পাইপ বসানোর জন্য ওয়াসা সারা বছরই খোঁড়াখুঁড়ি করছে। সড়ক সংস্কারের এক থেকে দুই মাস যেতে না যেতেই দেখা যাচ্ছে ওয়াসা সেটি কেটে ফেলেছে। সিডিএর কিছু প্রকল্পের জন্যও সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৃষ্টি-জলাবদ্ধতার কারণে সড়কের ক্ষতি তো আছেই। সড়ক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ৭শ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
তবে নভেম্বরের আগে এসব ভাঙাচোরা সড়ক সংস্কারে হাত দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, চার বছরের মধ্যে এবারই সড়কের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। টানা বৃষ্টি এবং জলাবদ্ধতার কারণে নগরের অন্তত ৩০০ কিলোমিটার সড়ক ভেঙেছে। এর মধ্যে মূল সড়ক দেড় শ কিলোমিটার আর অলিগলির সড়ক দেড় শ কিলোমিটার। তিনি আরো বলেন, এসড়কগুলো সংস্কার করতে ৫০০ কোটি টাকা লাগবে। ইতোমধ্যে কিছু সড়ক সংস্কার করার জন্য ওয়ার্ক অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। আশা করি নভেম্বরের মধ্যে টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারব।
সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্টরা জানান, সড়ক সংস্কার ও উন্নয়নে সিটি করপোরেশন প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১২৫ কোটি টাকা খরচ করে। বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত ৩০০ কিলোমিটার সড়ক সংস্কারের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীকে গত ৩ জুলাই চিঠি দেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। ওই চিঠিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ১৫টি সড়কের নামও উল্লেখ করা হয়। সড়কগুলো হচ্ছে আরকান রোড, পোর্ট কানেকটিং রোড, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, ডিটি রোড, স্ট্র্যান্ড রোড, আগ্রাবাদ শেখ মুজিব রোড, সিডিএ অ্যাভিনিউ রোড, হাটহাজারী রোড, বায়েজিদ বোস্তামী রোড, কাপাসগোলা রোড, ফিরিঙ্গিবাজার মেরিনার্স রোড, জুবিলী রোড, খাজা রোড, মিয়াখান রোড এবং হালিশহর রোড।
পিডিএসও/হেলাল