শাহ্জাহান সাজু

  ০১ জানুয়ারি, ২০২০

বিদায়ী বছর

বেড়েছে প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়, অর্থনীতি চাঙা

গত কয়েক বছরে বিশ্বের যে কয়েকটি দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ধারাবাহিকভাবে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে বাংলাদেশের। অর্থনীতির আকারও বাড়ছে ক্রমবর্ধমান হারে। গত বছর (২০১৯) পুরোটাজুড়েই সুবাতাস ছিল প্রবাসী আয়ে। মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। এ খাতে চলতি বছরে আলোচিত বিষয় ছিল রেমিট্যান্সে প্রণোদনার ঘোষণা এবং ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা প্রদান। নতুন তিনটি ব্যাংক অনুমোদনের বিষয়টিও ছিল আলোচনায়।

এ ছাড়া প্রতি বছরই ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে দেশের জাতীয় বাজেটের আকার। মাথাপিছু আয়ের সূচকে গত কয়েক বছরের মতো বিদায়ী বছরেও বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। অন্যদিকে, রাজস্ব আয়, রফতানি আয় ও আমদানিতে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি আসেনি। একইসঙ্গে বছরের শেষ দিকে মূল্যস্ফীতিও ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এই সময়ে সরকারের ঋণ করার প্রবণতা বেড়েছে। কমেছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ।

রেমিট্যান্সে সুবাতাস : রেমিট্যান্স নিয়ে স্বস্তিতে আছে সরকার। প্রবাসীদের আয় বৈধপথে দেশে আনা বাড়াতে জুলাই থেকে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা চালু করা হয়েছে। অর্থাৎ ১০০ টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠালে তিনি ১০২ টাকা পাবেন। এরপর থেকে রেমিট্যান্স বাড়তে থাকে। এরই ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রবৃদ্ধিতে। গত নভেম্বর শেষে প্রবাসী আয় দাঁড়িয়েছে ৭৭১ কোটি ৪১ লাখ ডলার। প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধির হার ২২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের এ সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ শতাংশ। এছাড়া নভেম্বর মাসে ১৫৫ কোটি ৫২ লাখ (১.৫৫ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা ছিল আগের বছরের নভেম্বরের চেয়ে ৩১ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি। প্রবাসী আয়কে উৎসাহ দিতে সরকার এখন ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে। এরই ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রবৃদ্ধিতে।

মাথাপিছু আয় : দেশের সামগ্রিক আর্থিক অবস্থা ভালো হওয়ায় প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বাংলাদেশে মানুষের বার্ষিক মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ৯০৯ ডলার। এটি আগের বছরে ছিল ১ হাজার ৭৫১ ডলার। আর এতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিও বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। ২০১৮ সালে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতি : খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত এই দুই ধরনের পণ্যেই মূল্যস্ফীতি বছরজুড়ে ভুগিয়েছে ভোক্তাদের। বিশেষ করে পেঁয়াজের রেকর্ড মূল্য মানুষ মনে রাখবে দীর্ঘ সময়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। আগের বছরে এ সময়ে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলেন, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য হ্রাস, চীন ও ভারতসহ বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি আমাদের চাপ বাড়িয়েছে। টাকার মূল্যমান কমে যাওয়ায় খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে বেড়েছে মূল্য। প্রতি বছর আমদানি খাতে ৫ হাজার ৭৫৫ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় হচ্ছে। টাকার অবমূল্যায়নে এ ব্যয় বেড়েছে।

রিজার্ভ : বছরের মাঝামাঝি থেকে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। গত অক্টোবর মাস শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৪৩ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। গত ১৪ নভেম্বর এটি কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৬৫ কোটি ডলারে। আর নভেম্বর মাসে মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৭২ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১১ ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২১৯ কোটি ৮৭ লাখ ডলার, ৬ মাস আগে গত জুনে যা ছিল ৩ হাজার ২৭১ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। ৬ মাসের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ৫১ কোটি ৭৮ লাখ ডলার।

রাজস্ব আয়ে ঘাটতি : সামগ্রিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি প্রায় ২০ হাজার ২২০ কোটি টাকা। এই চার মাসের প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের সামান্য বেশি, অথচ এবার গত অর্থবছরের তুলনায় ৪৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। প্রতিবারই বছরের প্রথম দিকে রাজস্ব আদায় কিছুটা কম হয়। তবে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে রাজস্ব আদায় বাড়বে বলে আশা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

বিনিয়োগ : দেশি-বিদেশি দুই ধরনের বিনিয়োগেই দীর্ঘদিন ধরে মন্দা চলছে। তবে বিদেশি বিনিয়োগে মন্দা কাটাতে বিশেষ উদ্যোগের ফল মিলছে। চলতি অর্থবছরে জুলাই-আগস্টে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৭৫ কোটি মার্কিন ডলারের। এটি বিগত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১২ শতাংশ বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে একই সময়ে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসে ৭০ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু দেশি বিনিয়োগে সুখবর নেই। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে যেখানে দেশি বিনিয়োগ হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা, সেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকায়। সংশ্লিষ্টরা বলেন, মূলত ঋণের সুদ হার এক অংকে নেমে না আসায় এবং ব্যাংকে ঋণখেলাপি বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগে আসতে পারেননি দেশি উদ্যোক্তারা।

রফতানি আয় : প্রায় পাঁচ মাস ধরে দেশের রফতনি আয় কমছে। এই রফতানি খাতই দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৫ মাস অর্থাৎ নভেম্বর শেষে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রফতানি আয় কমেছে প্রায় ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এ সময়ে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৮০৫ কোটি ডলার। এর বিপরীতে রফতানিতে আয় হয়েছে ১ হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার। নভেম্বরে রফতানি আয় কমেছে ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ। আর আগের অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছর রফতানি কমেছে প্রায় ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

আমদানি ব্যয় : ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাণিজ্য ঘাটতির ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুলাই-অক্টোবর ৪ মাসে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১৯ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা, এর বিপরীতে রফতানি আয় হয়েছে ১২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর মাস পর্যন্ত আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ।

ডলারের দাম : গত কয়েক মাস ধরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগের বছরের ৪ ডিসেম্বর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার পেতে যেখানে ব্যয় করতে হতো ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা, চলতি মাসের একই সময়ে তা বেড়ে হয়েছে ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। তবে আমদানি পর্যায়ে করপোরেট ডিলিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে ৮৬ টাকা পর্যন্ত।

বাণিজ্য ঘাটতি : আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে বাণিজ্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৬২ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

খেলাপি ঋণ : গত ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত ৯ মাসে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ৯ কোটি টাকা।

সরকারের ব্যাংক ঋণ : ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। চলতি অর্থবছরের পুরো সময়ে যে ঋণ নেওয়ার কথা ছিল তার প্রায় পুরোটা গত ৫ মাসেই নিয়ে ফেলেছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ বা ধার নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, ৫ মাস ৯ দিনেই (১ জুলাই থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা নিয়েছে সরকার।

নিত্যপণ্যের বাজার : বছরের ব্যবধানে পেঁয়াজের মূল্য ৫৩৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের হিসাবে ১ মাসের ব্যবধানে সরু চালের মূল্য ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ, মাঝারি চাল ৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ ও মোটা চালের দাম ৪ দশমিক ১৯ শতাংশ বেড়েছে। অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম বছরজুড়েই প্রায় স্থিতিশীল ছিল।

অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন : খাদ্যপণ্যের উৎপাদন আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সময়ে আউশ উৎপাদন বেড়েছে ২ দশমিক ৪ শতাংশ, আমন শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ ও বোরো ধান বেড়েছে ৪ দশমিক ২ শতাংশ। এ প্রবণতা থেকে চলতি অর্থবছরে মোট খাদ্য শস্যের উৎপাদন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ কোটি ৮৭ লাখ টন। এর মধ্যে আউশ ২৯ লাখ ৩০ হাজার টন, আমন ১ কোটি ৫৩ লাখ টন ও বোরো ২ কোটি ৪ লাখ টন। পর্যাপ্ত উৎপাদন হওয়ায় চালের বাজার স্থিতিশীল থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।

রাজস্ব আয় : প্রায় ১৬ দশমিক ২৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল। যা মোট জিডিপির ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। যেখানে মোট কর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। অথচ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই থেকে অক্টোবর) প্রবৃদ্ধি মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ। এ সময় রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬৫ হাজার ৯৬ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা কম। সবচেয়ে বেশি আয়করে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১১ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আমদানি-রফতানি,প্রবৃদ্ধি,মাথাপিছু আয়,অর্থনীতি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close