শাহ্জাহান সাজু

  ০৬ অক্টোবর, ২০১৮

১০ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২৫ হাজার কোটি টাকা

মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে দেশের সরকারি-বেসরকারি ১০ ব্যাংক। গত জুন প্রান্তিক শেষে এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি খাতের সাতটি ও বেসরকারি খাতের তিনটি ব্যাংক রয়েছে। কতিপয় ক্ষেত্রে অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়া ঋণ আদায় না হওয়ায় মূলধনে এই টান পড়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই হালনাগাদ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি বছরের জুন শেষে সরকারি-বেসরকারি ১০ ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। এই ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। এদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সাতটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি প্রায় ২৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকা।

এই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতিতে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি প্রায় ৮ হাজার ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সোনালী ব্যাংক। ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি প্রায় ৬ হাজার ৬০১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এ ছাড়া বেসিক ব্যাংকের প্রায় ৩ হাজার ১০৬ কোটি ২২ লাখ, জনতা ব্যাংকের প্রায় ২ হাজার ১৯৫ কোটি ২৫ লাখ, অগ্রণী ব্যাংকের প্রায় এক হাজার ৪১৯ কোটি ২৯ লাখ, রূপালী ব্যাংকের প্রায় এক হাজার ২৯৩ কোটি ১৯ লাখ এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) প্রায় ৬৪৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে।

অন্যদিকে বেসরকারি খাতের তিন ব্যাংকের মোট মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় এক হাজার ৮৭২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতি রয়েছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের। ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি প্রায় এক হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। ঘাটতিতে থাকা অন্য দুই ব্যাংক হলো বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক এবং সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল)। এর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের প্রায় ৩০১ কোটি ৯৯ লাখ এবং এসআইবিএলের প্রায় ৪৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।

জানা গেছে, সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি তৈরি হলে বাজেট থেকে তার জোগান দিতে হয়। জনগণের করের টাকায় বিভিন্ন সময় মূলধন ঘাটতিতে পড়া ব্যাংকগুলোতে অর্থ জোগান দেয় সরকার। তবে করের টাকায় মূলধন জোগানের বিরোধিতা বরাবরই করে আসছেন অর্থনীতিবিদরা। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের জোগান দেওয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। এটি কমাতে ইতিবাচক কোনো উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে না। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ব্যাংকগুলোকে কোনো নিয়মের মধ্যে আনা যাচ্ছে না। সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করেন, তাদের কোনো সমস্যা হবে না। এসব নীতি থেকে ব্যাংকারদের বেরিয়ে আসতে হবে।

এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, ‘সরকারি ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের একটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দিতে হবে। যত টাকা ঋণ আদায় করতে পারবে, তত টাকা ঋণ দিতে পারবে। এর বেশি নয়। তাহলে ওরা উল্টাপাল্টা ঋণ দেবে না। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক ও আমলাদের প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।’

‘প্রতি বছরই বাজেট থেকে ব্যাংকগুলোর মূলধন জোগান দেয়। এটি জনগণের করের টাকা। সরকারি টাকা দিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানকে মূলধন সরবরাহ করা ঠিক নয়। এ উদ্যোগ রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা এবং দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। তাই এ নীতি থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে’Ñ এমন পরামর্শও দেন এই অর্থনীতিবিদ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন শেষে ব্যাংকগুলোর মূলধন সংরক্ষণের আবশ্যকতা ছিল ৯৫ হাজার ১২৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো সংরক্ষণ করেছে ৯২ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। সামগ্রিকভাবে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার ৫৫৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট লাখ ৫৮ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। আর রাইটঅফ বা অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ যোগ করা হলে খেলাপি ঋণ দাঁড়াবে এক লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। আলোচিত সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ এসব ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে দেশের সরকারি ও বেসরকারি খাতের ১৩ ব্যাংক। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। যার সিংহভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের।

জানা যায়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই না করে ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া হয়েছে; যা পরবর্তীতে খেলাপি হয়ে পড়ছে। এসব ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। বাড়তি অর্থ জোগাতে হাত দিতে হচ্ছে মূলধনে। এতেই সৃষ্টি হচ্ছে সংকট। বর্তমানে ব্যাংকগুলোকে ৪০০ কোটি টাকা অথবা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশের মধ্যে, যা বেশি সেই পরিমাণ অর্থ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়।

এমনকি ঝুঁকি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মানদন্ড ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে ১০ শতাংশ ন্যূনতম মূলধনের পাশাপাশি দশমিক ৬২ শতাংশ হারে অতিরিক্ত মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু গত সেপ্টম্বর শেষে ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে এই ১০ ব্যাংক।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মূলধন ঘাটতি,কেন্দ্রীয় ব্যাংক,সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক,খেলাপি ঋণ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close