সৈয়দ মনজুর মোরশেদ

  ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮

‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’: বিস্মৃতির বিরুদ্ধে কেন লড়িতে হইবে

‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র সৃষ্টিতে বাঙ্গালি জাতির এক রক্তাক্ত কালপর্ব রহিয়াছে। পৃথিবীর ইতিহাস রচনা করিতে বসিলে তাহাও চিহ্নিত করিতে হইবে। যদিও কেহ কেহ লিখিবেন একদা এদেশে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ হইয়াছিল তথাপি একদিন এ জাতি মুক্তিযুদ্ধের কথা বিস্মৃত হইবেÑএমন আশংকা করা অমূলক হইবে না। উনিশশ একাত্তর সালে এদেশে মুক্তির জন্য যুদ্ধ হইয়াছিল। এদেশের জনগণ রক্ত ঝরাইয়া স্বাধীনতা আনিয়াছিল। তো এখন এই জাতীয় বিস্মৃতির কথা উঠিতেছে কেন? এ জাতির আপন ইতিহাস বিস্মৃত হইবার কি কারণ রহিয়াছে? যদি স্মৃতির লড়াই চিরজাগরুক থাকে তাহা হইলে এ আশংকা হইবে কেন? যদি উনিশশ একাত্তর পরবর্তী কিছু রাষ্ট্র বিপ্লবের যৎসামান্য পরিচয় লই তো কথাটা ভাবিতে বিশেষ বেগ পাইতে হইবে না।

উনিশশ পঁচাত্তরের পরে স্বাধীনতার লড়াইয়ে শামিল রাজনৈতিক শক্তি রাষ্ট্রকাঠামোর বাহিরে ছিটকাইয়া পড়িল, ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল। প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি চমক ব্যবহার করিয়া রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করিল। ইহার ইতিহাস আরও বেদনাদায়ক। ধর্মনিরপেক্ষ ভাবাদর্শ লুটাইয়া পড়িল। পাকিস্তানী সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তা ধর্মীয় গ্রহণে সবকিছুকে পুনরপি গ্রাস করিল। প্রশ্ন হইল তাহার কাল কি এখন শেষ হইয়াছে? উত্তরে কোনো ধ্বনি কিংবা প্রতিধ্বনি পাইতেছি না।

এখন বিচার করিয়া দেখিতে হইবে সেদিনের এই পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলির ভাবাদর্শ কতটুকু দায়ী ছিল। কথাটা খোলাসা করি। ফ্যাসিবাদের উত্থানের পিছনে ইতালি আর জার্মানিতে রাজনৈতিক দলগুলির রাজনৈতিক আদর্শ বহুলাংশে দায়ী ছিল। আজ যতই উচ্চকণ্ঠে রাজনৈতিক দলগুলির আদর্শ লইয়া প্রশ্ন তুলি না কেনÑস্বীকার করিতে হইবে সেদিন বুদ্ধিজীবীদের রাষ্ট্রচিন্তা ও দর্শনÑসর্বোপরি সংস্কৃতিচর্চাÑইহার জন্য কম দায়ী ছিল না। কি রকম দায়? সেদিন বেশি দূরের কথা নয়। সে সময়ের পত্রিকা উল্টাইলে দেখা যাইবে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্ম লইয়া বাড়াবাড়ি তখনওÑএকাত্তর হইতে পঁচাত্তর অবধিÑকম হয় নাই কিন্তু। পঁচাত্তরের পরের কথা তো আকাশে বাতাসেই পাইতেছি।

সে সময় বুদ্ধিজীবীরা ধর্ম লইয়া যাহা চিন্তা করিতেছিলেন তাহা খুঁজিয়া দেখিলে সমূহ নজির পাইব। রাষ্ট্রক্ষমতায় মিলিটারির আসোয়ার হওয়ার কি কারণ ছিল? সমাজের সবচেয়ে সংবেদনশীল জনগোষ্ঠীÑযাহাদের বুদ্ধিজীবী ভাবিÑতখন তাঁহারা দুঃসময় রুখিবার জন্য কয়টি কলম হাতে ধরিয়াছিলেন! আমরা রুশো, ভলতেয়ার প্রমুখের কথা ভুলিয়া গিয়াছি। অতদূর যাইব কেন। আমরা কি ইত্তেফাকের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার রাজনৈতিক মঞ্চের রচনার লেলিহান আগুন কি দেখি নাই? রবীন্দ্রনাথ কেন বলিয়াছিলেন, ‘আমার’ চেতনার রঙ্গে পান্না হল সবুজÑসে কথা অনেকদিন ভাবিয়াছি। ছয় দফা হইতে সাতই মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান যে রাজনৈতিক জমিনে লড়াই চালাইলেন সেই মানবজমিনে রক্তের আগুন কি ‘রাজনৈতিক মঞ্চের’ রচনাবলী ছড়ায় নাই?

কালক্ষেপ না করিয়া বলিব সেদিনও অনেক বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী ইতিহাসের উল্টাস্রোতে দাঁড় টানিয়াছিলেন। উনিশশ বাহান্ন সালে হাসান হাফিজুর রহমান ‘একুশের সংকলন’ সম্পাদনা করেন। তিনি যুগের দাবিতে সাড়া দিয়াছিলেন। স্বাধীনতার প্রাককালে কি দেখি? বুদ্ধিজীবী শিল্পী সংস্কৃতিসেবীরা আধুনিকতার চেতনা লইয়া এদেশের মাটি, জনগণ, মনুষ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতেছেন। কবি জসিমউদ্দীনের নকশি কাঁথার মাঠ আর সোজনবাদিয়ার ঘাট গ্রাম্য বলিয়া পরিত্যাজ্য হইল। ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর সেতার, আব্বাসউদ্দীনের গান, লালনের গান বুড়িগঙ্গা ধারের বুদ্ধিজীবীদের টানিল না। টানিল শার্ল বোদলেয়ার। টানিল টিএস এলিয়টের লিরিক। কালিদাস মেঘে মেঘে বর্ষা পার করিয়া দিলেন। আহা, আহা, একটা জাতি জাগিয়া উঠিতেছে অথচ চৈতন্য কানুর দেশে ‘আধুনিকতা’ খুঁজিয়া মরিতেছে। কি অদ্ভুত! যে সাহিত্য যে সংস্কৃতি পরিত্যাজ্যÑজাতীয় জাগরণে ভূমিকা রাখিবে সে সাহিত্য! সেদিন সাহিত্য উটপাখি হইয়া বালিতে মুখ গুঁজিয়াই ছিল।

পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি একদিন বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করিয়াছিল। সংস্কৃতিসেবীরা নিষেধ রুখিয়া দাঁড়াইলেন। গঠিলেন ‘ছায়ানট’। লেখকদের লইয়া আহমদ ছফা ‘রবীন্দ্রনাথ’ সংকলন প্রকাশের আয়োজন করিলেন। লেখকরা কি বিস্মৃত হইয়াছিলেন দেশবিভাগের পর পরই বাংলা ভাষার উপর পাকিস্তানী হামলা চলিয়াছিল? ভাষার উপর আক্রমণ হইল। বাংলা ভাষার হরফ পর্যন্ত বদল ঘটাইবার ষড়যন্ত্র হইল। এদিকে মাত্র এক দশকেই বাংলা ভাষার উপর বিজাতীয় আগ্রাসন ভুলিয়া গেলেন বুদ্ধিজীবীরা। সংস্কৃতির সংগ্রামে সেদিন কাহারা মাঠে-ময়দানে ছিলেন? সমাজের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠির মাথাওয়ালা লোকজন ছিলেন না। দেখি পাকিস্তানের শাসন কাঠামোর বাঁচিতে চাহিবার বাসনা উদগ্র হইয়া উঠিয়াছিল উঁহাদের।

এদেশের মুক্তির জন্য কৃষক ও শ্রমিক ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিল। বুদ্ধিজীবীরা বড় বেশি সংগ্রামবিমুখ ছিলেন। কেহ কেহ পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ডের পয়সাকড়ি গুণিয়া তর্জমা করিতেছিলেন। কেহ কেহ পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের পারিতোষিক লইয়া দেশ ছাড়িতেছিলেন। আর কেহ তো করাচি বিমানবন্দর হইয়া লন্ডন পাড়ি দিলেন। অথচ বেশিদিন না যাইতেই এদেশের নিরীহ জনগণের উপর পাকিস্তানী মিলিটারি ঝাঁপাইয়া পড়িল। নির্বিচারে গণহত্যা করিল। দেশময় ছড়াইয়া পড়িল রক্ত জল বারুদ। আর বুদ্ধিজীবীরা গভর্নর হাউসে গিয়া বৈঠক করিলেন। ইতিহাসে এসব ঘটনাও বাদ যাইবে না।

অথচ উনিশশ একাত্তরের গোড়ায় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কেহ কেহ টের পাইয়াছিলেন ঘড়ির কাঁটা ঘুরিতেছে। তাঁহাদের মধ্যে আহমদ ছফা। সেদিন লেখক শিল্পী সংস্কৃতিসেবীদের সংগঠিত করার জন্য সারা ঢাকা চষিয়া বেড়াইতেছিলেন তিনি। ‘স্বদেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করিতেছিলেন। অথচ এ যুদ্ধ বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই এড়াইয়া গিয়াছিলেন। সেটা স্বাভাবিক। স্বার্থহানি ঘটিবার শংকা ছিল। তার চেয়ে বেশি অটুট ছিল পরাধীন থাকিবার গোলামী মানসিকতা। না হইলে সারা দেশের জনগণ যেভাবে লড়াই চালাইতেছিল বুদ্ধিজীবীরা কি তার মর্ম একটুও বুঝিতে পারেন নাই? সৌভাগ্যের মধ্যে, দেশের জনগণ বুদ্ধিজীবীদের কথা শোনে নাই। তাহারা স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিল।

আমাদের গ্রামদেশে একটা কথা আছে: ‘আজান দিয়ে দিয়ে অনেক খেয়েছ এখন কাতার ধর’। এখন কাতার ধরিয়া লড়িতে হইবেÑএ সত্যটি অন্তত আহমদ ছফা বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তিনি জীবন দিয়া শিখিয়াছিলেন জাতির সামনে পরিষ্কার জবানটি তুলিয়া ধরিতে হইবে। পাকিস্তান জমানায় আহমদ ছফা লড়িয়াছিলেন আর স্বাধীন দেশে বুদ্ধিজীবীদের মুখোশ ছিন্নভিন্ন করিয়াছিলেন। বুদ্ধিবৃত্তির উপর এক প্রাণঘাতী প্রবন্ধ রচনা করিয়াছিলেন। দেশ ও জাতিকে সজাগ করার প্রবল তাগিদ হইতে লড়াই চালাইয়া গেলেন।

পাকিস্তানের পরাধীন রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ লড়াই চালাইয়াছিল। দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের মধ্যে যাহারা মার্কিন রাজনৈতিক নীতির সাথে একাত্ম হইয়া পাকিস্তানের সহিত কনফেডারেশন গঠনের ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন তাহারাই পঁচাত্তরের মর্মন্তুদ হত্যাকা-ের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইলেন। প্রবাসী সরকারের মন্ত্রীসভায় ঠাঁই লইয়া যাহারা বাংলাদেশবিরোধী কার্যকলাপ অব্যাহত রাখিয়াছিলেন পঁচাত্তরের রাষ্ট্রবিপ্লবের পরে তাহারা সামরিক সরকারের অক্টোপাসে জাতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিয়া ফেলিলেন। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বদলাইয়া গেল। রাষ্ট্রধর্ম রাষ্ট্র হইয়া গেল।

আজ যতই জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব কি জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব বলি না কেনÑগণতন্ত্রের সংগ্রামে বুদ্ধিজীবীরা সেদিন নিরব নিশ্চুপ ছিলেন। কেন ছিলেন? সেটা কি চিন্তাহীনতা? আপোষকামিতা? সুবিধাবাদিতা? না, তা নয়? ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন। তাঁহারা প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। পাকিস্তান আমলেও বুদ্ধিজীবীদের কেহ কেহ প্রতিবাদী ভূমিকায় দেখা দিয়াছিলেন।

বাংলাদেশ আমলে বুদ্ধিজীবীরা জাতীয় জীবন বা জাতীয় অস্তিত্ব লইয়া মোটেও ভাবিত ছিলেন না। বুদ্ধিজীবীদের অবস্থান দেখিয়া আহমদ ছফা সত্যই বিচলিত হইয়াছিলেন। যুদ্ধের সময়কার প্রবাসী দিনগুলিতে আহমদ ছফা খোদ বাংলাদেশ সরকারেরই ভেতরে বাংলাদেশবিরোধী কার্যকলাপ যেমন প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন তেমনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তাহাদের অবাধ বিচরণ দেখিয়া ব্যথিত হইয়াছিলেন। তুলিয়া ধরিয়াছিলেন সঠিক চিত্র। স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা স্বাধীনতাবিরোধীরা দখল করিল। স্বাধীনতার মূল্যবোধ জাতির সামনে ধ্বংস হইয়া গেল। কি রাষ্ট্র, কি সমাজ, কি রাজনীতি, কি সংস্কৃতিÑচতুর্দিকে সর্বত্র সর্বগ্রাসী দৈত্য ছড়াইয়া পড়িল। কেহ কি ভাবিয়াছিল স্বাধীনতা এত অল্প সময়ে বিপন্ন হইবে? অথচ দেখি সে সময় বুদ্ধিজীবীরা পেঁচার স্বভাব রাষ্ট্র করিয়া জাতির দুর্দিন ঘনাইয়া আনিলেন। সেদিন পাকিস্তান (অর্থাৎ পরবর্তীতে বাংলাদেশ) অবজার্ভার সম্পাদক আবদুস সালাম, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের পুরোধাÑ ‘রাঙ্গা প্রভাত’ আর ‘মানবতন্ত্র’ লেখকÑআবুল ফজল আর ‘আমার পূর্ব বাংলা’র সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ সেনাশাসকের দোসর হইলেন।

আজ এদেশের চিন্তাশীল লেখক বুদ্ধিজীবীদের জাতিকে লইয়াÑবিশ্বের অভিমুখে আগাইয়া যাইবার অভিপ্রায়েÑনতুনভাবে সৃষ্টিশীল চিন্তাভাবনা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সংস্কৃতিচর্চাÑএক কথায় জীবনচর্চা করিতে হইবে। নতুবা এদেশে একদা মুক্তিযুদ্ধ হইয়াছিলÑএই কথাটি একশ বছর পরে রূপকথার বুড়ির গল্প বলিয়া শোনা যাইবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close