হাফিজ উদ্দীন আহমদ

  ৩১ জুলাই, ২০২০

ভ্রমণ

বিজ্ঞানের জাদুঘরে

ছোটবেলা বাবা আমাকে আবদুল্লাহ আল মুতীর লেখা ‘এসো বিজ্ঞানের রাজ্যে’ বইটি কিনে উপহার দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানের প্রতি তখন থেকেই আকর্ষণ জন্মে। আর আজ সত্যি সত্যি বিজ্ঞানের রাজ্যে এসে পড়েছি। ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে একটু পরেই এক্সিভিশন রোডে সায়েন্স মিউজিয়াম। ১৮৫৭ সালে স্থাপিত। এ ইমারতটিও বিশাল, কিন্তু বাইরে রাজকীয় জৌলুস নেই। জায়গায় জায়গায় সায়েন্স কথাটা লেখা। প্রবেশ করতে এখানেও টিকিট লাগে না, তবে দান সাদরে গৃহীত হয়।

ভেতরে ঢুকে নজরে পড়ল আয়তনে এটাও বিশাল। এক এক তলায় একেকটি বিষয়ের প্রদর্শনী। নিচতলায় ভারী ভারী যন্ত্রে সজ্জিত এনার্জি বিভাগ। প্রায় ৩০০ বছর থেকে আমাদের কল-কারখানা, জাহাজ, রেলগাড়ি এমনকি স্টিম টারবাইন দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাষ্প সীমাহীন ভূমিকা রাখছে। কেটলিতে পানি সেদ্ধ করলে বাষ্পের ধাক্কায় বন্ধ ঢাকনা খুলে পড়ে যায়, এটা দেখে যে বিজ্ঞানী বাষ্পের শক্তি আবিষ্কার করে দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলেন, সেই বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটের ছবি এক স্থানে। বার্নলি আয়রন ওয়ার্কশপে তৈরি জেমস ওয়াটের এক বিরাট লাল স্টিম ইঞ্জিন সামনে। ১৮১৯ সালে জেমস ওয়াট মারা গেলে জেমস ওয়াট অ্যান্ড আওয়ার ওয়ার্ল্ড নামে তার কার্যাবলি প্রদর্শনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ১৭৬৩-১৭৭৭ সালে তিনি কার্যকর বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন, যা শিল্প বিপ্লব নিয়ে আসে। এ বাষ্প শক্তিকে ভিত্তি করে জর্জ স্টিফেনসন ১৮১৪ সালে ব্লোচার নামে কয়লা বহনের জন্য প্রথম রেলগাড়ি তৈরি করেন, যার গতি ছিল কম। ১৮২৯-এ তিনি রকেট নামে উন্নত ইঞ্জিন বানিয়ে শেষে পুরস্কার অর্জন করেন। আমার সামনেই সেই ঐতিহাসিক রকেট দেখতে পাচ্ছি। রয়েছে ১৮৬৮ সালের সেই প্রাথমিক যুগের রেল ইঞ্জিন। রয়েছে ১৮১৪ সালের পাফিং বিলি লোকোমোটিভ পুরোনো স্টিম ইঞ্জিন, যা হাঁটার চেয়ে একটু দ্রুত চলে। তাতে প্যাসেঞ্জার নয়, কয়লা বহন করা হতো।

বাষ্পের জগৎ পার হতেই এলাম গতির অন্য জগতে। সাজিয়ে রাখা আছে প্রাথমিক যুগের কালো অস্টিন গাড়ি। দর্শকের মাথার ঊর্ধেŸ প্রমাণ সাইজের ভাসমান প্লেন আর তার নিচে অসংখ্য তাকের ওপর একটির পর একটি অধুনালুপ্ত গাড়ি রাখা। ১৮৯৫ সালে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত পৃথিবীর প্রথম মোটর রেসে প্যানহার্ড এবং লেভাসর গাড়ি জয়লাভ করে তার ছবি লাগিয়ে রাখা আছে। চমৎকার লাগছে দেখতে। তিন চাকার ছোট লালগাড়ি একটা মেঝেতে। মাত্র একজন চড়তে পারে। হেনরি সেগ্রেডের জন্য ১৯২৮ সালে তৈরি সবচেয়ে দ্রুতগামী স্পিডবোট ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে আবার বানিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। নাম হলো মিস ইংল্যান্ড। আরো কিছু আকর্ষণীয় গাড়ি রয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম। দোতলা-তিনতলায় মানুষের দেহ ও স্বাস্থ্য এবং মহাশূন্য নিয়ে অসংখ্য মূল্যবান তথ্যবহুল নিদর্শন আছে। ১৯৫৩ সালে বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিকসের তৈরি জোড়া হেলিক্স দিয়ে গঠিত ডিএনের একটি বড় মলিকুলার মডেল রেখে দেওয়া আছে। রয়েছে মানুষের গর্ভস্থ ভ্রƒণের বেড়ে ওঠার পর্যায়ক্রমিক দৃশ্য। সোজা কথায় ভ্রƒণতত্ত্ব। কোন সপ্তাহে ভ্রƒণের সঠিক আকার কেমন হয় আমি চিকিৎসক বলে জানা আছে, কিন্তু সাধারণ লোক কিছুই জানে না, তাই তাদের কাজে লাগবে। রয়েছে মায়ের পেটের বাইরে ভ্রƒণ জন্ম দেওয়ার কাহিনি, যেটাকে বলা হয় আইভিএফ বা বহিঃস্থ গর্ভ সঞ্চার। ১৯৭৮ সালে লুইস ব্রাউন নামে একটি মেয়ে সর্বপ্রথম গবেষণাগারে এ পদ্ধতিতে জন্ম নেয়Ñ রবার্ট এডওয়ার্ড, জিন পার্ডি ও প্যাট্রিক স্টেপটোর যৌথ গবেষণার ফলে। গোড়াতে এটাকে অমানবিক আখ্যা দিলেও আজ লাখ লাখ নিঃসন্তান দম্পতি এর দ্বারা উপকৃত হচ্ছেন। এরপর নজরে এলো মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের সবাই উপভোগ করার মতো কৌতুক। আমরা জানি, ক্যাঙ্গারু তার পেটের থলিতে শাবক বহন করে। কিন্তু মহিলাদের যদি এ রকম সুবিধা থাকত, কী সুবিধাই না হতো, কষ্ট করে বাচ্চা কোলে নিয়ে বয়ে বেড়াতে হতো না। কথাগুলোর পাশেই একটি তরুণীর মূর্তি। তার পেটের থলিতে মাথা বের করে আরামে বসে আছে তার সন্তান। দর্শনার্থীরা মজা করে এটা দেখছে আর দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে।

এবার সবচেয়ে সমৃদ্ধ আর আকর্ষণীয় মহাকাশ অঞ্চলে পা রাখলাম। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে শূন্যে ঝুলে আছে পৃথিবীর এক বিরাট মডেল। মহাকাশের মডেলও সভা পাচ্ছে। পৃথিবীর চারদিকে ভাসমান সব গ্রহ-উপগ্রহ তথা কৃত্রিম উপগ্রহ। চমৎকার লাগছে দেখতে। প্রথম মহাশূন্যচারী মানব রাশিয়ার বিমানবাহিনীর পাইলট ইউরি আলেক্সিভিচ গ্যাগারিনের ছবি ও পরিচিতি দেওয়া অন্যত্র। ভোস্টক-১ ক্যাপসুলে ১২ এপ্রিল ১৯৬১ সালে মহাকাশে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে দুনিয়াকে স্তম্ভিত করে দেন তিনি। অভিভূত রানি এলিজাবেথ ১৯৬১-এর জুলাইয়ে তাকে রাজপ্রাসাদে দাওয়াত করে একসঙ্গে আহার করেন। অদূরে অ্যাপোলো-১০ লুনার কমান্ড মডিউল। মে ১৯৬৯ সালে ৩১ বার চাঁদের কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করে ফেরত আসে। শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এটা অনেক ভারী, তাই চাঁদে অবতরণ করলে বিধ্বস্ত হতে পারে। পরে অ্যাপোলো-১১ অভিযানে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই কমান্ডার নেইল আর্মস্ট্রং-এর নেতৃত্বে মাইকেল কলিন্স ও এডুইন অলড্রিন চাঁদে পৌঁছেন। মাইকেল কলিন্স মূল চন্দ্রযান কলাম্বিয়াতে থেকে যান আর সর্বপ্রথম আর্মস্ট্রং এবং পরে লুনার মডিউল ঈগলের পাইলট অলড্রিন চাঁদে অবতরণ করেন। অদূরে ঈগল ও চাঁদে অবতরণের সেই ঐতিহাসিক দৃশ্য প্রমাণ সাইজের মডেল বানিয়ে জীবন্ত করে রাখা হয়েছে। মিসাইল-রকেটও দেখতে পাচ্ছি। পাশের পোস্টারে লেখাÑ হিটলার ক্ষমতায় এসেই সেনাবাহিনীকে ঘণ্টায় ৩০০ কিমি গতির মিসাইল বানাতে আর্থিক সাহায্য দেন। ১৯৩৬ সালে বাল্টিক সমুদ্রের তীরে পিনেমুন্ডেতে বিরাট রকেট কেন্দ্র গড়ে উঠে। পরবর্তী ৭ বছরে এগ্রেগেট-৪ মিসাইল তৈরিতে ১-২ বিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করা হয়, যার নাম শেষে বদলে ভি-২ রাখা হয়। এই ভি-২ রকেট দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে এক আতঙ্কের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিল। ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম ও ফ্রান্সে ৩০০০-এরও বেশি ভি-২ ছোড়া হয়েছিল। আজও তার চিহ্ন কোনো ইমারতে বিদ্যমান।

আমরা কি সত্যি গ্রহান্তরে পৌঁছতে পারব? আমরা কি সত্যি মহাশূন্যে বসবাস করতে পারব? এ প্রশ্নগুলো বড় বড় করে লিখে রাখা। মহাশূন্যে রয়েছে মধ্যাকর্ষণের অভাব অর্থাৎ ভারশূন্যতা অথবা নামমাত্র মধ্যাকর্ষণ বা মাইক্রোগ্রাভিটি। আরেকটি বড় বিপদ হলো, উচ্চমাত্রার তাপ। আর সব ছাপিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে, মহাকাশ যানে নভোচারীরা প্রাকৃতিক কাজকর্মগুলো কীভাবে সারেন। যেখানে মধ্যাকর্ষণ নেই, সেখানে টয়লেট করলে কি বিশ্রী ব্যাপার হবে ভেবে দেখুন তো! মলমূত্র চোখের সামনে ভাসবে। তাই বিশেষ ভ্যাকুয়াম সিস্টেমে মলত্যাগ করতে হয় ও বর্জ্য শোষণ করে নিচের দিকে টেনে নেওয়া হয়। ঘুমানোটাও বিপদ। ভারশূন্যতার জন্য সিøপিং ব্যাগে ঢুকে নিজেকে ফিতা দিয়ে বিছানার সঙ্গে বেঁধে রাখতে হয়, যাতে ভেসে না যায়। আর সে স্থানে ওপর-নিচ বলে কিছু নেই, যেখানে খুশি ঘুমানো যায়। তাছাড়া আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, মহাকাশযানের দ্রুত (কমপক্ষে প্রতি ঘণ্টায় ২৮০০০ কিমি) প্রদক্ষিণের ফলে কিছুক্ষণ পরপরই রাত-দিন হতে থাকে। তাই মহাকাশচারীকে এক নাগাড়ে কয়েক দিন ঘুমাতে হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close