সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

  ৩১ জুলাই, ২০২০

জতুগৃহের ভস্ম

পুরাণ ছুঁয়ে কবিতার বর্তমান

জতুগৃহের ভস্ম আসলে কী? মহাভারতে বর্ণিত পান্ডবদের পুড়িয়ে মারার জন্য দুর্যোধনের আদেশে নির্মিত গৃহ হচ্ছে জতুগৃহ। শকুনির কুচক্রে পান্ডবগণকে জতুগৃহে ভস্ম করার পরিকল্পনা বিদুরের সূক্ষ দূরদর্শিতার প্রভাবে নস্যাৎ হয়। পান্ডবগণ মাতা কুন্তীসহ জতুগৃহ থেকে রক্ষা পান। জতুগৃহের অগ্নি থেকে রক্ষা পাওয়ার পর পান্ডবগণ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে বনে ঘুরে বেড়ান। তাই ‘জতুগৃহের ভস্ম’ গ্রন্থের কবিতাগুলো পাঠের আগে মিথ বা পুরাণ নিয়ে একটু পড়াশোনা করলে পাঠকের জন্য ভালো হয়।

গ্রন্থটি বীরেন মুখার্জী তিন কবিকে উৎসর্গ করেছেন। তারা হলেন জীবনানন্দ দাশ, বিনয় মজুমদার ও আবু হাসান শাহরিয়ার। বাংলা কবিতা ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করে। বীরেনের কবিতাও এ পরম্পরায় ভাস্বর। তিনি কবিতায় চমৎকার গল্প বলে যান। অনেকটা জীবনানন্দের মতো। কিন্তু এটাকে ঠিক জীবনানন্দীয় প্রভাব বলা যায় না। তার কবিতায় অরণ্য দেখতে পাই। দেখি হলুদ হাওয়া, হলুদাভ দিন, গোধূলিসারস, অচেনা সন্ধ্যা, সাপিনী প্রেম, ঘুমের জীবাশ্ম, একমুঠো নির্জন, হলুদের দিন, মেঘের হিজল, চিরহরিৎ ছায়া, ভাতফুল প্রভৃতি। তবে হলুদের প্রতি কবির বিশেষ দুর্বলতা বা আকর্ষণ রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এ ক্ষেত্রে তিন আধুনিক কবিকে গ্রন্থ উৎসর্গ বেমানান মনে হয় না।

বীরেন মুখার্জীর কবিতার প্রতিটি শব্দ যেন একে অপরের পরিপূরক। এ ধাবমান শব্দগুলোই টেনে নিয়ে যায় পাঠককে। কবিতায় তার বক্তব্য সুস্পষ্ট এবং গভীর। জীবনকে অবলোকন করেছেন কঠিন আবহে। কবি বলেন, ‘যেভাবেই দেখো জীবন এক প্ররোচনাময় টগবগ, কতিপয় ঘোরেই সুস্থির!’ তার কবিতা সমকাল এবং যাপনের বিবিধ অনুষঙ্গজারিত; যা বহুস্তরিক চিন্তা উৎসারণকারী, কখনো শূন্যতার ঘোরে নির্বাসনকারী। তিনি ‘জতুগৃহের ভস্ম’ গ্রন্থের কবিতায় পান্ডবদের মতোই জীবনের নানা গ্লানি-ক্লেদ ও বেদনার কথা, শঠতার শিকার হয়ে কলঙ্কিত হওয়ার কথা, প্রেম ও প্রতারণার যুগল দীর্ঘশ্বাস থরে থরে সাজিয়েছেন। নিজের হৃদয়কে জতুগৃহের সঙ্গে তুলনা-প্রতিতুলনা করেছেন। ফলে জীবনের জটিল তত্ত্ব সন্ধান করতে হলে পাঠককে তার কবিতার সমীপেই উপনীত হতে হয়।

কবি বীরেন সামাজিক অনুষঙ্গকে কবিতায় অঙ্গীভূত করেছেন সমাজকর্মী ও সমাজচিন্তকের যুগ্ম-অভিজ্ঞানে। সামাজিক বিকারকেও কখনো করে তুলেছেন কবিতার বিষয়। কবির সামাজিক দায়িত্ব পালনে সবার সঙ্গে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের যুক্তি অবান্তর। কবি দায় পালন করেন সাধারণ মানুষের অলক্ষ্যে ও দৃশ্যের অন্তরালে। তবু কবিকে দেখা যায়, যাবতীয় অনৈতিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে। তাতে একধরনের প্রত্যাশার আলোর দিশা দেন তিনি। কবি বলেন, ‘বিষাদঋতুর এমনই ঘোর, চারুÑ সংযতধ্বনি বিবৃতি-ব্যঞ্জনা শুনবে কে?’ এমনকি তার কবিতায় মানুষ ও প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। মানুষের মনে সব সময় কীসের যেন ভয়, তবু ভালো লাগে না ‘তাকে’ ছাড়া। এই ‘তাকে’ বলতে কবি হয়তো ‘প্রত্যাশা’ বুঝিয়েছেন। প্রত্যাশা আছে বলেই এর নাম বেঁচে থাকা। কবির ভাষায়, ‘মহামতি, এবার কাঠামো ভাঙো, নাগিনী সরাও; হলুদাভ দিন ফুঁড়ে জেগে উঠতে দাও ভবিষ্যকুসুম!’ এ ছাড়া নিসর্গ চেতনা ও মানব প্রজাতির হার্দিক টানাপড়েন, যৌন চেতনা, ক্ষুধা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধও বীরেন মুখার্জীর কবিতার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

বীরেনের কবিতার পঙক্তিতে দারুণ মোটিভেশন! কবির ‘জীবন ও কাল-পর্যবেক্ষণ’ অন্তরে আশা জাগায়, বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়, জেগে ওঠার তুমুল প্রণোদনা দেয়। কিছু পঙক্তি যেন প্রবাদ বাক্যের মতো অন্তরে প্রোথিত হয়ে যায় ১. প্রতিটি হাতেই যুক্ত থাকে জেগে ওঠার প্রবল প্রতিভা! ২. চোখ থাকার পরও কেউ কেউ অন্ধ অজগর। ৩. আরোগ্যসদনে এসেও দাঁড়িয়ে থাকে জীবন। ৪. দৃষ্টির গভীরে ফুটতে থাকে অজস্র দৃশ্যভোর। ৫. অপেক্ষাপ্রহরের পাশেই পোড়ে প্রত্যাশাখচিত ধূপ।

বীরেন মুখার্জীর কবিতায় প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি পুরাণ ও ইতিহাস যুগলবন্দি হয়ে উঠে আসে। কবি বলেন, ‘বায়ান্নো কিংবা একাত্তরের মতো উজ্জ্বল প্রেম উঁকি দিয়ে যাবে আবারও, অন্ধকার চূর্ণ করে জ্বলে উঠবে প্রগতির আলো’। তার উপমা প্রয়োগ বা তুলনাও পাঠককে ভাবিত করে। জটিল বিষয়কে তিনি খুবই সাবলীলভাবে উপমায়িত করেন। কবিভাষ্য ১. আগামীর চেতনা খুব গোপনে, অন্ধকারের দাস হয়ে উঠবে না তো! ২. পৃথিবীও রং পাল্টাচ্ছে অবিরাম। ৩. মসৃণ পৃষ্ঠায় লিখিত যে গোপন বন্ধুতা। ৪. এ-জীবন আতশবাজির মতো ফুটছে অপার। ৫. লোকালয়, জনপদে বাড়ছে বনসাই দিন।

সব মিলিয়ে কবির শব্দচয়ন, বাক্যবিন্যাস, অলঙ্কার, উপমা, ছন্দ, কথার মাধুর্য হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তার সহজবোধ্য কথামালার মধ্যে জীবনের জটিল ও গভীরতর রহস্য লুকিয়ে থাকে। যে কারণে তার কবিতা পুনঃপাঠে ভিন্ন ভিন্ন রসের সন্ধান মেলে। কবির হৃদয় নিঃসৃত কথামালা পাঠককে বিমোহিত করে। কবি যেন পাঠককেই বলেন ‘কখনো যদি শনাক্ত করো স্মৃতিভবিষ্যের ক্ষত,/নক্ষত্রপুষ্পের হাসি দেখবে পুনর্জন্মেও, অসম দূরত্বে/যে স্বপ্ন এবং গুঞ্জরন ধ্বনিত হবে, তা আমারই প্রণীত/জীবনসমগ্র খুঁজে সঞ্চয় করেছি সেই মহামন্ত্র!’

একজন প্রকৃত কবি তার যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই নির্মাণ করেন কাব্যসৌধ। ফলে এ কথা বলা দোষের হয় না যে, সমকালীন কাব্য সাহিত্যে বীরেন মুখার্জী উজ্জ্বল দীপ্তি ছড়াবেন। এ প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close