হাফিজ উদ্দীন আহমদ

  ১৭ জুলাই, ২০২০

ভিক্টোরিয়া আলবার্ট মিউজিয়াম

বিলাতের সব জাদুঘরই বিশাল রাজপ্রাসাদের মতো দেখতে। নাম লেখা না থাকলে যে কেউ রাজবাড়ী বলে ভুল করবে। তবে এ ইমারত বানানোই হয়েছে জাদুঘর হিসেবে। এখানে সর্বোচ্চে স্থাপিত ভাস্কর্যটি প্রিন্স আলবার্টের। তার নিচেই লেখা : ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়াম। ১৮৫২ সালে রানি ভিক্টোরিয়া ও রাজপুত্র প্রিন্স আলবার্টের নামে নামকরণ হয়েছে। ভাস্কর্য, স্থাপত্য, সাজসজ্জার বিষয়, ফ্যাশন, তৈজসপত্র, শিল্পকলা ইত্যাদি নানা বিষয়ে ২.২৭ মিলিয়ন প্রদর্শনী দ্রব্য আছে এখানে। এসব বিষয়ে নির্মিত পৃথিবীর বৃহত্তম জাদুঘর এটা। ক্রমেল রোডে এর অবস্থান। ঢুকতে টিকিট লাগে না। প্রধান প্রবেশ পথেই আকাশছোঁয়া গম্বুজ থেকে ঝুলছে ১১ মিটার উঁচু কাচের নীল, সবুজ ও হলুদ রঙের আঙুরের থোকার মতো দর্শনীয় দীপাধার। অনেকগুলো অতিকায় হলরুম ভেতরে। ছাদগুলো উঁচু গগনচুম্বী আর কী বিচিত্র তার কারুকার্য। বিভিন্ন হলে স্থাপিত বেশির ভাগ ভাস্কর্য বাইবেল ও গ্রিক পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক। একটি হলে মাথা সমান উঁচু বেদির ওপর একজন নগ্নকায় পুরুষের ১৭ ফুট লম্বা মার্বেল মূর্তি। জানলাম এটা ইতালির কালজয়ী শিল্পী মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর তৈরি। স্বর্গোদ্যানে ডেভিড দাঁড়িয়ে আছেন। ডেভিডের পেছনে স্বর্গের স্বর্ণদ্বার। একজন মহিলা মূর্তি শিশু কোলে অবাক চোখে ডেভিডকে দেখছেন। মূল মূর্তিটি ইতালির ফ্লোরেন্সে আছে। এটা তার প্রতিলিপি হলেও মূলের মতোই সুন্দর। পাশে শিশু, মহিলা-পুরুষের ছোট ছোট আরো নগ্নমূর্তি রয়েছে। সম্ভবত এরা দেবশিশু ও দেব-দেবী। দেবীরা নগ্ন, গায়ের দুপাশে পাখা।

শিল্পকলার কিছু শ্বেতাঙ্গিনী ছাত্রী এসেছেন। তারা মেঝেতে গ্যাট হয়ে বসে খাতা খুলে ছবি আঁকছেন এগুলোর। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম। চমৎকার তাদের আঁকার হাত। কক্ষজুড়ে আরো অনেক মূর্তি ও ছবি রয়েছে। ইতালির বিখ্যাত সমাধি, গির্জা ও ক্যাথেড্রাল থেকে সংগৃহীত ভাস্কর্য ও স্তম্ভগুলো কাস্ট করে রাখা এক জায়গায়। হলরুমের বহু ভাস্কর্যই মূল ভাস্কর্যের নকল বা কাস্ট। হলের নাম তাই ওয়েস্টন কাস্ট কোর্ট এবং ইতালির নবজাগরণের স্মারক। পাশাপাশি দুটি নগ্নমূর্তি দৃষ্টি কাড়ে। পিট্রো ফ্রাঙ্কাভিলার বানানো জেফির এবং অ্যাপোলো।

আরো উল্লেখযোগ্য যে, প্রদর্শনী দ্রব্য রয়েছে তার মাঝে আছে, পিসা ক্যাথেড্রালের ধর্ম প্রচারের মঞ্চ, ডোনাটেলোর সিংহ ভাস্কর্য, রাফেলসের আঁকা বিখ্যাত চিত্র। অসংখ্য ছোট ভাস্কর্য দিয়ে সাজানো পাথরের কফিন বক্স, তার ওপরে শায়িত মনুষ্য মূর্তি। সম্ভবত তা কফিনের ভেতরে থাকা মৃত ব্যক্তির। এমনকি শিল্পী অ্যাঞ্জেলোর চেয়ারে বসা অবস্থায় নিজের শ্বশ্রƒমন্ডিত প্রমাণ সাইজের মার্বেল মূর্তিও রয়েছে জাদুঘরে।

এবার যে মার্বেল ভাস্কর্য দৃষ্টি আকর্ষণ করল, তা ইতালিয়ান শিল্পী গিয়ান লরেঞ্জো বার্নিনির তৈরি নেপচুন অ্যান্ড ট্রাইটন নামের। একজন ঘাতক এক ব্যক্তিকে দুই পায়ের ফাঁকে চেপে ধরে টেঁটা-জাতীয় লোহার ফলকের যন্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে। উচ্চতা ১৮২.২ সেন্টিমিটার। অপর একটি ১৩২ সেন্টিমিটার মার্বেল ভাস্কর্যে ছোট ছোট শিং আর লেজওয়ালা জন্তুসদৃশ বন দেবতাকে শিশুরা উত্ত্যক্ত করছে। এটাও গিয়ানের তৈরি।

অনেকগুলো হল। চেয়ারে বসা রানি ভিক্টোরিয়া, সন্তান কোলে মেরির মূর্তি, জন মাইকেলের করা বজ্রের দেবতা থুনারের মূর্তি, বিভিন্ন স্তম্ভে সুউচ্চে স্থাপিত আগস্টিনো কারভিনির যশোয়া, সেন্ট ডানস্টান, প্রার্থনারত দেবী, থিঙ্কার নামে চিন্তারত এক ব্যক্তি, আলবার্ট হেনস্টকের ফাদার টেমস, স্বর্গের উদ্যানে এডামের কথা শুনছেন ইভ, সমুদ্রের দেবী থেটিস তার নবজাতক ছেলে এচিলিসকে পায়ের গোড়ালি ধরে স্টিক্স নদীতে ডুবাচ্ছেন, যাতে ছেলের কখনো কেউ ক্ষতি করতে না পারে (কিন্তু গোড়ালি হাতে ধরা থাকায় তা পানির স্পর্শ পায়নি, তাই পরে এই দুর্বল স্থানে তীর বিদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান), চীন থেকে সংগৃহীত ব্রোঞ্জের গৌতম বুদ্ধ ইত্যাদি কত যে শিল্পকর্ম, লিখে শেষ করা যাবে না। সযতেœ সংরক্ষিত মুঘল সম্রাট আকবরের অতিকায় সোনার চামচ, সম্রাট শাহজাহানের বুড়ো আঙুলের আংটি। এক জায়গায় অনেক প্রাচীন তরবারি দাঁড় করিয়ে রাখা, প্রথমটি হলো মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের।

বিভিন্ন হলের বিভিন্ন কক্ষে নানা বিষয়। ফটোগ্রাফি বিভাগে অনেক চমৎকার ছবির মাঝে একটা সহজেই আকর্ষণ করল। লুইস ক্যারোলের ছবি। এলিস লিডেল নামে সাত বছরের বালিকাকে নায়িকা করে লেখা তার বিখ্যাত এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড বইটি পড়েননিÑ এমন পাঠক হয়তো দুনিয়ায় নেই।

যে প্রদর্শনী দ্রব্য সবচেয়ে বেশি আমাকে নাড়া দিয়েছে তা হলো, টিপু সুলতানের যান্ত্রিক বাঘ। দুই ফুট উঁচু, চার ফুট লম্বা বাঘ হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে লাল ইউনিফর্ম ও ক্যাপধারী ব্রিটিশ সৈন্যের ওপর। লোকটি ধরাশায়ী।

জাদুঘর থেকে বের হয়েই নজরে পড়ল ভবনটির বাইরের দেয়ালে কিছু জায়গায় গভীর ক্ষত। এগুলো সারানো হয়নি। টাকার অভাবে নয়, বিশ্বকে দেখানোর জন্য যে, যুদ্ধ জ্ঞানের ভান্ডারকেও নিস্তার দেয় না। দেয়ালে বড় করে লেখা : এই দেয়ালের ক্ষতিসমূহ ১৯৩৯-৪৫ সালের যুদ্ধে শত্রুদের বোমাবর্ষণের ফলে সৃষ্ট।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close