হাফিজ উদ্দীন আহমদ

  ০৫ জুন, ২০২০

ভ্রমণ-১

ক্লিওপেট্রা দর্শন

ক্লিওপেট্রার গহনা আর পোশাকের সামনে যখন দাঁড়ালাম, তখন একটু আগে দেখে আসা মমি করে রাখা মৃতদেহটা যেন এক মুহূর্তে জীবন্ত রূপ ধরে আমার সামনে এসে দাঁড়ালÑ তার ঝলমলে পোশাক আর অলংকার পরে অনিন্দ্য রূপ ও লাবণ্য নিয়ে। যেন নিঃশব্দে বলতে চাইল : হে ভ্রমণপিয়াসী, তোমার মতো কারো জন্যই আজ আড়াই হাজার বছর ধরে আমি প্রতীক্ষায় শুয়ে আছি; যে আমাকে জানতে চায়, পড়তে চায় আমার দুঃখগুলো। আমি অভিভূত হলাম। মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম আমার মেয়ে প্রেটিকে, যার জন্য আমার এ সৌভাগ্য। দেশ ছাড়ার আগেই প্রেটিকে জানিয়ে রেখেছিলামÑ কোথায় কোথায় যেতে চাই বিলাতে এলে। জবাবে প্রেটি বলেছিল : আব্বু, তুমি এসব আমার ওপর ছেড়ে দাও। আমিই তোমার ট্যুর প্রোগ্রামগুলো সেট করব। সারা পৃথিবী চষে বেড়ানো প্রেটি মাস্টারপ্ল্যানার। আমি সায় দিয়ে যে ভুল করিনি তা বুঝতে পারছি।

আজ কাক্সিক্ষত ব্রিটিশ মিউজিয়াম দেখার দিন। একসময় পৃথিবীজুড়েই ছিল ব্রিটিশ রাজত্ব। তার বিপুল সাম্রাজ্যের যেখানে যে জিনিস তাদের আকর্ষিত করেছে, তাই তারা এনে জড়ো করেছে এখানে। আট মিলিয়ন দ্রষ্টব্য আছে এর ছাদের নিচে। এক দিন কেন, এক মাসও কম সময় সব দেখবার জন্য। লোকে বলে, এ মিউজিয়াম দেখলে সারা দুনিয়াই দেখা হয়ে যায়। এ দেশে আসবার সময় যে ফ্যাচাং হয়েছিল, তা এখন তুচ্ছ মনে হয়।

২০১৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর কাতার এয়ারের কিউ-আর ৩৩০, সন্ধ্যা ৭-৪০-এর সেই ফ্লাইটটি সেদিন গেলই না যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে। ফলে দোহা-হিথ্রো কানেকটিং ফ্লাইটও মিস হলো। অথচ আমাদের চেকিং সমাপ্ত হয়ে বোর্ডিং পাসও দিয়ে দিয়েছিল। ‘ওয়েট ওয়েট’ বলে রাত ১০টায় এয়ারপোর্টের স্পাইসি রেস্টরেন্টে খাইয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অমানুষিক যন্ত্রণা দিয়ে বসিয়ে রেখেছিল তারা ‘এই ছাড়ছি ছাড়ছি’ আশ্বাস দিয়ে। শেষে কিছু লোক মারমুখী হয়ে উঠলে ভোররাত ৪টায় আমাদের ঢাকা রিজেন্সি হোটেলে পাঠিয়ে দিল। ঢাকার লোক হয়েও ঢাকায় ট্রানজিট থাকলাম, সে এক মজার অভিজ্ঞতা। ১০২৬ নম্বর রুমে এক সঙ্গে থাকলাম হাঙ্গেরিতে কর্মরত ডা. মোর্শেদ খানের সঙ্গে। সকালে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ খেয়ে বিকাল না হতেই যখন আবার হাজির হলাম বিমানবন্দরে, তখন আগের রাতের ক্লান্তি তখন কেটে গেছে। এয়ারপোর্টের বাইরে যাওয়ায় আবার সিকিউরিটি চেক হলো। শেষ পর্যন্ত ৯ তারিখ আগের নির্ধারিত ফ্লাইটটি ছাড়ল সন্ধ্যায় একই সময়ে। যাক এবার নিশ্চিন্ত হলাম একটু হয়তো নির্বিঘেœ পৌঁছাব গন্তব্যে। কিন্তু ও-মা! দোহা হামাদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ভোররাত ৪টায় কাতার কিউ-আর ১১১ ফ্লাইট যেটা ছাড়ল, সেটা ৬ ঘণ্টা পর বিলাতের স্থানীয় সময় ১০টায় হিথ্রো পৌঁছার কথা, কিন্তু সেটা বিলাতের বদলে চলে গেল খোদ গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে। প্রায় দুঘণ্টা ওড়ার পর মাইক্রোফোনে ঘোষিত হলো : লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলম্যান, এটেনশন প্লিজ! ইজ দেয়ার এনি মেডিকেল পার্সোনেল? কাইন্ডলি রিপোর্ট টু দ্য ক্রু। এ প্যাসেঞ্জার ইজ সিক।

কয়েকবার ঘোষণা শোনার পর আর বসে থাকা যায় না। আমার চিকিৎসক সত্তা জেগে উঠল। এয়ার বাসের নিচতলায় এসে দেখি ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে হঠাৎ নেতিয়ে পড়েছে এক মধ্যবয়সি শ্বেতাঙ্গ। চেক করে দেখলাম তার নাড়ির গতি, রক্তচাপ সব ঠিক আছে। কিন্তু কোনো কথা বলতে পারছে না।

ইতোমধ্যে এক ইউরোপিয়ান চিকিৎসক এসে হাজির। সম্ভবত হার্ট অ্যাটাক হয়েছে যাত্রীর। উড়ন্ত বিমানে চিকিৎসা দেওয়ার বিরল সৌভাগ্য হলো আমার। রোগীর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্লেনের মুখ এথেন্সের দিকে ঘোরালেন বিজ্ঞ ক্যাপ্টেন। আমাকে ধন্যবাদ জানাল কাতার বিমান। প্যাসেঞ্জারকে ভর্তি করা হলো হাসপাতালে। শেষে সকাল

১০টার জায়গায় বিকাল প্রায় ২টা নাগাদ বিলাতে পৌঁছে দেখি আমাকে বরণ করতে ফুলের তোড়া হাতে নাহিদ আর প্রেটি তখনো হিথ্রো এয়ারপোর্ট টার্মিনাল ফোর-এ দাঁড়িয়ে।

নাহিদ প্রেটির জীবনসঙ্গী। কিংবদন্তি সম্রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রাকে দেখতে হলে এ রকম ছোটখাটো ত্যাগ তো করতেই হবে, নইলে তুমি কিসের ভ্রমণ অনুরাগী?

আমার সামনে কাচের শোকেসে বন্দি ক্লিওপেট্রার পোশাক, বরই বিচি দিয়ে তৈরি গলার হার আর কিছু সুগন্ধি লতাগুল্ম, যা দিয়ে তিনি প্রসাধনী করতেন। বরই বিচি দেখে এ কথা ভাবলে ভুল হবে যে, ক্লিওপেট্রার সোনাদানা বা মণিমুক্তা ছিল না। আজকাল মেয়েরা যেমন স্বর্ণালংকারের বদলে মাঝে মাঝে কাঠের বা পুঁতির মালা পরে, এটাও হয়তো তেমনি।

অনেকে তাকে মিসরের ফারাওর কন্যা বলেছেন। আসলে মিসরে জন্ম গ্রহণ করলেও তিনি মিসরীয় ছিলেন না। খিস্টপূর্ব ৬৯ সালে তার জন্ম হয়। মারা যান খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সালে। খুব অল্প দিনই বেঁচে ছিলেন। থিবসে মমির সঙ্গে তার শবাচ্ছাদন, পোশাক, বরই বীিচর গলার হার, চিরুনি ইত্যাদি পাওয়া গেছে। কাপড়টা সম্ভবত লিনেন বা সিল্কের। এত অবিকৃত রয়েছে কীভাবে, হাজার হাজার বছর পরও তা বিশ্বাস করা কঠিন। পাগড়ির মতো গোটানো ওটা। মনে হচ্ছে, আফ্রিকার মেয়েরা মাথায় যে পাগড়ির মতো আচ্ছাদন পরে, অনেকটা হিজাব জাতীয় এটা সে রকমই কিছু। চিরুনিটা কাঠের, হাড়ের বা হাতির দাঁতের মনে হচ্ছে। হাত দিয়ে ধরা নিষেধ, তাই বোঝা গেল না। আমাদের দেশে সাধারণত গ্রামের নারীরা উকুন বাছার জন্য যে রকম চিরুনি ব্যবহার করে, অবিকল সে রকম। একদিকে মোটা এবং একদিকে চিকন দাঁত। অবাক হলাম, এত বছরেও দাঁতগুলো অটুট রয়েছে। কেউ কোথাও লিখেনি এই সৌন্দর্যের রানির মাথায় উকুন ছিল কি না। তবে সেকালে কীটনাশক বা ইনসেক্টিসাইড অর্থাৎ সোজা কথায় উকুন মারা ওষুধ ছিল না, অতএব থাকলেও থাকতে পারে।

একটু আগেই জাদুঘরের চার নম্বর কক্ষে মিসরীয় গ্যালারিতে ছিলাম। সেখানেই দেখেছি ক্লিওপেট্রার শবাধার। তার মমিতে পাঁজর বা হাত-পা ভাঙা ছিল না। মৃতদেহ লিনেনের ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ানো। তার বাইরে কাপড়ের আচ্ছাদন। সেটার ওপর ব্যান্ডেজ দিয়ে আড়াআড়ি ও কোনাকোনিভাবে তা আটকানো। শবাধারটিতে মুখাবয়ব এঁকে চিত্রকর্ম দ্বারা সজ্জিত। প্রথম ও তৃতীয় শতাব্দীতে রোমক আমলে অনেক মমিতেই একটি কাঠের খ-ে মৃত ব্যক্তির সত্যিকার ছবি এঁকে আবৃত করা কাপড়ের ভেতর বা প্লাস্টার করা মমি ধারকের ভেতর দিয়ে দেওয়া হতো।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close