সৈয়দ নূরুল আলম
উর্মিলা নগরে থাকে
অস্থির সময়ের উজ্জ্বল হাত
‘উর্মিলা নগরে থাকে’ আলমগীর রেজা চৌধুরীর ৪৯তম গ্রন্থ, যেটা বইমেলা ২০১৯-এ পরিবার পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
‘উর্মিলা নগরে থাকে’ একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। প্রেক্ষাপট ১৯৯০-৯১, যখন দেশে চলছে স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলন। অন্ধকারের কবলে দেশ আর ঠিক তখনই উর্মিলার আবির্ভাব। এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। শুভপুর গ্রাম থেকে উঠে আসা সারল্যে ভরা উর্মিলা হয়ে ওঠে অস্থির সময়ের মুক্তির প্রতীক। তাকে পথ দেখায় আরেক নারী চরিত্র বেবী। অফিসের সবার বেবী আপা। এ অফিসের কর্তাব্যক্তি।
‘জাকির সাহেব টেবিলের সামনে চেয়ার দেখিয়ে বলে, বসো উর্মিলা। আপা তোমার প্রতি আস্থাশীল। সুমি-নাজনীনকে দেখলাম তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
উর্মিলা লজ্জিত কণ্ঠে বলে, ‘স্যার গ্রাম থেকে এসেছি তো তাই সবাই একটু করুণা করে।’
‘ছিঃ ছিঃ এ কথা কেন বলছ? সবাই তো গ্রাম থেকে আসে।’
‘জি স্যার। উর্মিলা জাকির সাহেবের চোখের দিকে তাকায়। বেশ বলিষ্ঠ পুরুষ। চোখের পাতা দ্রুত ওঠানামা করে।’
এভাবেই লেখক সহজ, সরল, কোমল উর্মিলার ছবি এঁকেছেন। পরবর্তীতে এই উর্মিলাই স্বৈরাচার এরশাদ হঠাও আন্দোলন মঞ্চে বেবী আপাকে রক্ষা করে, নিজেও রক্তাক্ত হয়। পরদিন অকুতোভয়, সাহসী নেত্রী হিসেবে খবরের কাগজে জায়গা করে নেয় উর্মিলা। এভাবেই উর্মিলা এগোতে থাকে।
রুবী, দিপু, সুমি, নাজনীন, শমসের চাচা, চামেলী উপন্যাসে এ চরিত্রগুলো এসেছে সহজাতভাবে। বাড়তি কোনো চরিত্র নেই, নেই কোনো বাড়তি কথন। এখানেই লেখকের শক্তিময়তা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টানটান উত্তেজনায় গল্পের ভেতরে ঢুকে যেতে হয় পাঠককে। পাঠক ধরে রাখার এ মন্ত্র খুব কম লেখকেরই থাকে, সেক্ষেত্রে আলমগীর রেজা চৌধুরী এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বলা যায়।
জাহানারা ইমাম ছাড়াও সেই সময়ের কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তির নাম এসেছে আলোচিত উপন্যাসে। এখানে লেখক সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন এবং একই সঙ্গে থেকেছেন সত্যাশ্রয়ী।
রাজনৈকিত উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু না থাকলে সেটা হয়ে যেত খণ্ডিত। তাই লেখক বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করেছেন একটু ভিন্নভাবে। উর্মিলা তার ডায়েরিতে লেখে- ‘বঙ্গবন্ধুর আত্মা প্রোথিত রয়ে গেল বাংলার আকাশ-বাতাস-বৃক্ষ লতায়। ঘাতক চিরকাল নিপতিত মহাকালের আস্তাকুঁড়ে।
প্রিয় মুজিব, আমি আপনার জন্য শোকগাথা লিখে যাব, আর মহাকালের পরম্পরায় একজন দেশপ্রেমিকের আত্মা খুঁড়ে খুঁড়ে আবিষ্কার করব, ভালোবাসা।’ এভাবেই লেখক বঙ্গবন্ধুকে উপন্যাসে ধারণ করেছেন।
উপন্যাসে স্বতঃসিদ্ধভাবে প্রেম থাকবে। আলোচিত উপন্যাসেও সে প্রেম এসেছে কিন্তু সেটা খুব সূক্ষ্মভাবে। উর্মিলা এবং দীপুর মধ্যে দু-একটা কথনের মাধ্যমে পাঠক তা টের পায়। যেমন, ‘দীপু ভাই আমার হাত ধরেন। আমি কিছু বলি না। মনে হয় নদীর মোহনায় আমি একা নই।
হাতের তালু তার ঠোঁট স্পর্শ করে। তৃষ্ণায় আমার বুক খাক হয়ে আছে। আপনি আমাকে করুণা করুন।
আমি দীপু ভাইয়ের হাত চেপে ধরি। অনন্ত তৃষ্ণার দাহ আমাকে কষ্ট দিতে থাকে।
করুণা বলবেন না। যাপিত হৃদয় আপনার জন্য প্রতীক্ষা করবে।
আকস্মিক দীপু ভাই আমার ঠোঁটে গাঢ় চুম্বন এঁকে গেট পেরিয়ে অন্ধকারে মিশে গেলেন। আমি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি। লেখক এখানে সংযমী। দক্ষ নাবিক।
সবশেষে বলা যায়, আলমগীর রেজা চৌধুরী ১১১ পৃষ্ঠার এ উপন্যাসে কিছু দেখা চরিত্র নিয়ে সমকালীন সমাজ ও রাজনৈতিক সহ-অবস্থানের চিত্র সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী শতাব্দী জাহিদ। মূল্য ১৭৫ টাকা।
"