ইমাম গাজ্জালী

  ২৯ নভেম্বর, ২০১৯

বই আলোচনা

একজন পিতার গোপন অনুতাপে স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ

মনিরুজ্জামান খানের প্রথম উপন্যাস ‘একজন পিতার গোপন অনুতাপ’। এর আগে গল্প লিখেছেন লিটলম্যাগে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর এই উপন্যাসের মাধ্যমে জানান দিলেন- ফের লেখালেখির জগতে পথচলা শুরু করেছেন। লেখকের টগবগে তারুণ্য কেটেছে প্রগতিশীল লড়াইয়ে। এ কারণে তার লেখায় পারফিউমে গন্ধ নয়, বেরিয়ে আসে মাটির সুবাস। সেই সঙ্গে এমন চারপাশের চিত্রকল্প উঠে আসে, যাকে সাধারণত লেখকরা দেখেও না দেখার ভান করেন। কিংবা ঢেকে রাখতে চায়। যে চারপাশ জ্বাজল্যদ্বীপ্তমান, নিত্যঘটমান, সে দৃশ্য আমাদের অতি পরিচিত, মনিরুজ্জামান খান তাকেই তুলে আনতে চেয়েছেন। এই আনতে চাওয়াটাই বড় ব্যাপার। তবে সে কাজে তিনি কতটুকু সফল হয়েছেন, তার বিচার করতে আরো সময় লাগবে। তবে লেখালেখির জগতে যে তিনি পা দিয়েছেন, সেটাই বড় সুসমাচার। সে কাজে তিনি একটা ভালো সফলতা আনবেন, সে ভরসা করা যায় অনায়াসে। কারণ অস্ত্র যুদ্ধ করে না, করে অস্ত্রের পেছনের মানুষ, তার পেছনে থাকে মতাদর্শ। দিন শেষে সেটাই যুদ্ধের কারণ। আর মনিরুজ্জামান খানকে যারা চেনেন, তারা নিশ্চয়ই একমত হবেন, তিনি মানুষ ও মাটির প্রতি একজন দায়বদ্ধ মানুষ। শেষ পর্যন্ত কলমযুদ্ধে যতটুকু বিজয় তথা সফলতা আসবে, ততটুকুই নগদ পাওয়া। যদি তিনি দাবিকৃত সময়ের স্বরূপটি চেনার লড়াই জারি রাখতে পারেন।

একজন পিতার গোপন অনুতাপে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র দুই পরিবারের দুই তরুণী। তাদের ঘিরে প্রেম, প্রতারণা, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, ঘরসংসার, ক্ষুদ্র স্বার্থবোধ, পরধন আত্মসাৎ করার লোভ, ষড়যন্ত্র, ধর্মবোধ উঠে এসেছে। তাদের ঘিরেই হঠাৎ টাকার কুমির হওয়ার জন্য পাগল করা মানবিক বোধহীন চরিত্র যেমন উঠে এসেছে, পাশাপাশি ধর্মত্যাগ না করেও সাম্প্রদায়িকতার চাষাবাদ করা সমাজে দুই সম্প্রদায়ের এক দম্পত্তির একসঙ্গে পথচলার ঘটনাও রয়েছে।

ওই দুই তরুণীর একজনের নাম আয়শা, অপরজন ফাতেমা। দুজনেই বাবার একমাত্র সন্তান। সম্পর্কে মামাত-ফুপাত বোন। আয়শার বাবা জসিমউদ্দীন স্কুলশিক্ষক, সারা জীবনের তিল তিল করে জমানো অর্থে একটা বাড়ি করেন। সন্তান কন্যা হওয়ার কারণে, উত্তরাধিকার আইনে নারীর বঞ্চনার কথা জানেন তিনি। তার মৃত্যুর পর বাড়িটি খাবে ‘বারো ভূতে’। সেই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে আগে ভাগেই বাড়িটি লিখে দেন মেয়ে আয়শার নামে। মরার আগে পাত্রস্থ করার জন্য তাকে বিয়েও দেওয়া হয় তলিয়ে না দেখা এক ‘সুপাত্র’ দেখে। পরে জানতে পারেন সে ‘সুপাত্র’ অনিয়মের দায়ে চাকরিচ্যুত, একই সঙ্গে প্রতারক এবং অপরাধপ্রবণ মানুষ। এই যুবকের হঠাৎ বড়লোক হওয়ার ফাঁদে পড়ে সামাজিক মানমর্যাদা অর্থকড়িসহ শেষ সম্বল হারায় আয়শা। প্রতারণার কাছে হেরে যাওয়া তরুণী আয়শা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

অপরদিকে, ফাতেমা নিজের বুঝের ওপর দাঁড়াতে চাওয়া একজন তরুণী। তার আদর্শের আইকন হলো পিতার চেয়ে অধিক তারই বড় চাচা, আনিসুর রহমান, যাকে ‘ব্যাটা’ বলে ডাকে ফাতেমা। ব্যাটা একজন বৃক্ষপ্রেমিক, পরিবেশবাদী। পেশায় কলেজশিক্ষক। তারই সাহস ও অনুপ্রেরণায় রক্ষণশীল বাবা আরিফুরের প্রভাব কাটিয়ে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয় ফাতেমা। তার প্রভাব ও প্রেমের জালে আটকে পড়ে অসাম্প্রদায়িক দম্পত্তির ছেলে সহপাঠী দীপন। বাবা আরিফুরের মৃত্যুর পরও শরিয়া আইন অনুযায়ী ‘বারো ভূতে’ গিলে খায় তার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাড়িটি। শরিয়া আইনে হাতছাড়া হয় ফাতেমার পৈতৃক বাড়ি। তবু সে হেরে যায়নি, কারণ সম্পত্তির চেয়েও বড় সম্পদ আছে তার। যে সম্পদ আয়শার নাগালে থাকলেও আয়ত্তে ছিল না। আর সেই সম্পদ হলো, ব্যাটা আনিসুর রহমান ও তার প্রভাব। এ কারণে সব হারিয়ে ফাতেমা উঠে দাঁড়ায়, পাশে পায় প্রেমিক পুরুষ দীপন আর খুব সম্প্রতি পাওয়া বিসিএস ক্যাডারের চাকরি। আর আনিসুরের মতো মানুষকে ধারণ করতে না পারা আয়েশা সর্বস্বান্ত হওয়ার পর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারে না, সত্যকার অর্থেই সে সর্বহারা, জীবনযুদ্ধে হার মানা মানুষ।

উপন্যাসটির ঘটনা ও ব্যক্তির চরিত্রের বর্ণনা আরো প্রাঞ্জল হওয়া দরকার ছিল। সমাজতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেখানে দুই ভিন্ন চরিত্রের মন্তব্য গতানুগতিক। সমাজের সংকটের আরো গভীরে যেতে পারতেন লেখক। আরো খুলে দেখাতে পারতেন ভেতরের দগদগে ঘা। সে কাজে তার আরো মনোযোগী হওয়া দরকার।

বইটি প্রকাশ করেছে বেহুলা বাংলা, প্রচ্ছদ মানানসই, চমৎকার ছাপা। মধ্যবিত্তের প্রেম প্রতারণা, তাদের টিকে থাকার লড়াই, নারী হওয়ার কারণে পৈতৃক সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার প্রভাব ভালোভাবে আঁকতে চেয়েছেন একজন পিতার গোপন অনুতাপে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close