মীম মিজান

  ১৮ অক্টোবর, ২০১৯

নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ২০১৮-১৯

আলোচিত সমালোচিত নোবেল

পাঠক হৃদয়কে উদ্বেলিত করে যারা শিল্প-সাহিত্যে সাড়া ফেলেন, তাদের অন্যতম নোবেলজয়ী পোলিশ প্রোজ্জ্বল ঔপন্যাসিক ওলগা তোকার্তুক ও অস্ট্রিয়ান বহুমাত্রিক লেখক পিটার হ্যান্ডকে। সাহিত্যে সবথেকে মর্যাদাবান পুরস্কার হিশেবে ধরা হয় নোবেলকে। এ পর্যন্ত ১২৯ জন লেখক এ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সুতরাং অনুমেয় যেকোনো পর্যায়ের লেখক হলে বা সৃজনকর্ম মানুষকে উপহার দিলে এ রকম পুরস্কারে ভূষিত হওয়া যায়। যদিও সুইডিশ নোবেল কমিটি মাঝেমধ্যে এমন ব্যক্তিকে নোবেলে ভূষিত করে, যা সাধারণ মানুষের কাছে মানদন্ডের প্রশ্নে একেবারে তলানিতে পড়ে যায়।

গত বছর নোবেল ঘোষণা স্থগিত ছিল। কারণ নোবেল কমিটির একজন নারী সদস্যের স্বামী তার মাধ্যমে নোবেল কে পেতে যাচ্ছেন, সেই খবর নিয়ে জুয়াড়িদের কাছ থেকে অর্থ বাগিয়ে নেন। আর এ রকমটি যে শুধু গত বছর হয়েছে, এমনটা নয়। অনেক দিন ধরেই তা চলে আসছিল। আর সেই জুয়াড়িদের থেকে যে অর্থ পেতেন মহিলার স্বামী, তা দিয়ে একটা এনজিও খুলেছেন। আর সেই এনজিওর নারীকর্মীদের ওপর যৌন অত্যাচার করতেন মহিলার স্বামী। একপর্যায়ে তার বিরুদ্ধে নারীরা ফুঁসে উঠলে এ ঘটনা ফাঁস হয়। বিব্রত অনুভব করায় নোবেল কমিটি গত বছর নোবেল ঘোষণা স্থগিত করে। সেই ২০১৮ সালের নোবেল আর ২০১৯ সালের নোবেল একত্রে ঘোষণা হয়ে

গেল ১০ অক্টোবর।

যেহেতু সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ওই দুজন; সেহেতু তাদের সাহিত্য, ব্যক্তিজীবন, কর্মজীবন, রাজনৈতিক মতাদর্শ ইত্যাদি বিশদভাবে বিশ্লেষিত হচ্ছে। ওলগা তোকার্তুকের যে রকমটি গ্রহণযোগ্যতা দেখা যাচ্ছে, অপরদিকে ঠিক পিটার হ্যান্ডকেকে ততটাই

সমালোচিত হতে হচ্ছে।

দুই.

গত বছর সাহিত্যের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মানের পুরস্কার ম্যান বুকার পেয়ে বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন ৫৭ বছরের ওলগা। প্রথম কোনো পোলিশ লেখক হিসেবে এই সম্মাননা লাভ করেছিলেন। এই সম্মান তাকে এনে দিয়েছিল ফ্লাইটস উপন্যাস। সেটি পোলিশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন জেনিফার ক্রোফট। সেটির পোলিশ নাম বিগুনি। সে সময়ই সাহিত্য সমালোচকরা এক বাক্যে বলেছিলেন, ওলগাই হবেন ২০১৮ সালের নোবেলবিজয়ী। কেননা ওলগার লেখনশৈলী সত্যিই অসাধারণ ও ভিন্ন আঙ্গিকের।

মানবিক ও ভিন্ন আঙ্গিকের ঔপন্যাসিক ওলগা তোকার্তুক ১৯৬২ সালের ২৯ জানুয়ারি মধ্য ইউরোপের দেশ পোল্যান্ডের জিয়েলোনা গোরার সুলেচোতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এখন রোকলাওয়ে থাকেন। সেই ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি ওলগার আগ্রহ। প্রাথমিক জীবনে কবিতাচর্চা করতেন। পরবর্তীতে কথাসাহিত্যের দিকে ঝুঁঁকে পড়েন। শিক্ষক দম্পতির সন্তান হওয়ায় তার ভেতরে শিক্ষার নানাদিক কাজ করে। অধিকন্তু তার বাবা একজন লাইব্রেরিয়ানও ছিলেন। ফলে লাইব্রেরিতে অনায়াসে গমন করে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বইয়ের পাঠ শেষ করেন। সেসব বিষয় নিজের ভেতর প্রোথিত করে সৃজনকর্মে এনেছিলেন চমৎকারিত্ব।

ওলগা ১৯৮০ সালে রাজধানী ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানী হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। এ সময় তিনি কিশোরদের আচরণগত সমস্যার জন্য নির্মিত কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে জীবনের প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে স্নাতক শেষ করার পর ভ্রোক্লাউ ও পরে ভালব্রিচে চলে যান, সেখানে থেরাপিস্ট হিসেবে অনুশীলন শুরু করেন। এই থেরাপির অভিজ্ঞতা তার জীবনকে এগিয়ে নিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তোকার্তুক নিজেকে কার্ল জাঙের শিষ্য হিসেবে বিবেচনা করেন। জাঙের মনস্তত্ত্ব তার সাহিত্যকর্মের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বলে

উল্লেখ করেন।

বর্তমানে ওলগা লেখালেখির পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘রুটা’ দেখভাল করছেন। সমসাময়িক সব ইস্যুতেই তিনি প্রথম সারির একজন আন্দোলনকারী। রাজনৈতিক মতাদর্শে দল দ্য গ্রিনসের সদস্য এবং বামপন্থি ধারণায় বিশ্বাসী।

ওলগা তোকার্তুক শুধু একজন লেখকই নন, মানবিক অন্যান্য গুণাবলিরও অধিকারী। যেমন তিনি একনিষ্ঠ সমাজকর্মী ও বুদ্ধিজীবী। তাকে পোল্যান্ডে তার প্রজন্মের অন্যতম সমাদৃত ও ব্যবসাসফল লেখক বলে গণ্য করা হয়।

সাহিত্যে নোবেলবিজয়ী ১১৪ জন পুরুষ আর ১৫ জন নারীর মধ্যে ১৫তম নারী সাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া সত্যই সম্মানের। ৫৭ বছর বয়সি তোকার্তুককে তার প্রজন্মের শীর্ষ ঔপন্যাসিক মনে করা হয়ে থাকে। তিনি বাস্তবতা আর কল্পনার মিশ্রণে উপন্যাস লেখেন। তবে এ ক্ষেত্রে কল্পনাগুলোর সূত্রপাত হয়ে থাকে বাস্তবতা থেকেই।

মধ্যপ্রজ লেখিকা ওলগা এ পর্যন্ত নয়টি উপন্যাস ও কয়েকটি ছোটগল্প ও প্রবন্ধের বই লিখেছেন। তার সবচেয়ে আলোচিত বই দ্য বুকস অব জ্যাকব ৯০০ পৃষ্ঠার এক মহাকাব্যিক উপন্যাস, যার পটভূমি অষ্টাদশ শতকের পোল্যান্ড। পোল্যান্ডে এ বইটির কদর উচ্চমানের। নোবেল কমিটি ওলগাকে বলেছেন, তার প্রজন্মের পোল্যান্ডের সবচেয়ে মেধাবী লেখক। তার লেখনী সম্পর্কে কমিটির উদ্ধৃতিÑ সীমারেখা ভেঙেচুরে চলা মানবজীবনের চিত্র গভীর মমতায়, কল্পনায় ও আগ্রহে তিনি তুলে ধরেছেন।

তিন.

সাহিত্যে ২০১৯-এর নোবেলবিজয়ী পিটার হ্যান্ডকে। মধ্য ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়ার সমসাময়িক প্রখ্যাত লেখক পিটার। অস্ট্রিয়ার গ্রিফেন শহরে ৬ ডিসেম্বর ১৯৪২ সালে জন্ম এই আলোচিত-সমালোচিত লেখকের। ব্যাংকের করনিকের ছেলে পিটার গ্রাজ ইউনিভার্সিটিতে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। তবে ডিগ্রি অর্জনের আগেই পড়াশোনা বাদ দেন।

পিটার হ্যান্ডকের আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৬ সালে তার প্রথম উপন্যাস ডাই হরনিসেনর প্রকাশের মাধ্যমে। তবে তিন বছর পর নিজেকে সাহিত্যধারায় প্রতিষ্ঠা করেন অফেন্ডিং দ্য অডিয়েন্স প্রকাশের মাধ্যমে।

চলচ্চিত্র নির্মাণেও পিটার সম্পৃক্ত ছিলেন। আর এই চলচ্চিত্র তাকে সমধিক খ্যাতি এনে দেয়। তার খুবই কাছের বন্ধু প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার উইম ওয়েনডার্সের সঙ্গে কিছু দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। সাড়াজাগানো কিছু স্ক্রিপ্টও লিখেছেন। ১৯৮৭ সালে উইংস অব ডিজার্স নামক চলচ্চিত্রটি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও কিছু ফিচার ফিল্মের স্ক্রিপ্ট লেখার পাশাপাশি তিনি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তার জীবনীর ওপর একটি ডকুমেন্টারি ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়।

এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকার মতে, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, বেতার নাটক আর কিছু আত্মজীবনীমূলক লেখা তিনি লিখেছেন। পিটারের লেখনীর সবথেকে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছেÑ ভাষার সারল্য, প্রাত্যহিক জীবনের বাস্তবতা, সমাজের কুসংস্কারচ্ছন্নতার বিরুদ্ধবাদ ইত্যাদি।

পিটারের সাহিত্যিক খ্যাতির ওপর কলঙ্ক লেপন হয় ২০০৬ সালে বলকানের কসাইখ্যাত সেøাবেদেন মিলোসোভিকের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগদান করে তার স্তুতি করে বক্তৃতা করে। অথচ সেøাবেদেনের বিরুদ্ধে তখন হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আট হাজার মুসলিম গণহত্যার বিচারকার্য

চলমান ছিল।

নোবেল প্রাইজ কমিটি টুইটারে জানিয়েছে, পিটার প্রায় ৫০ বছর পর উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন প্রকার সাহিত্য সৃষ্টি করে পাঠকের হৃদয়ে আসন গেড়ে নেন। এবং এর মাধ্যমে তিনি নিজেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিশেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন।

সুইডিশ একাডেমি পিটারের আ সরো বিয়ন্ড ড্রিমস গ্রন্থটির উচ্চ প্রশংসা করেছে। তাদের মতে, এটি সংক্ষিপ্ত এবং তেজালো, কিন্তু গভীরভাবে গ্রহণীয় গ্রন্থ। পিটারের মা জীবনের প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। সেই ঘটনাটিই এখানে উপস্থাপিত হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close