আবু আফজাল সালেহ

  ২৪ মে, ২০১৯

চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গা

কবি নজরুলের স্মৃতিবাড়ি

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। রাজনৈতিক বা লেটের দলে বাংলাদেশের বেশ কয়েক স্থানে এসেছেন। ময়মনসিংহ (ত্রিশালসহ), কুমিল্লা, খুলনা, যশোর, বরিশাল বা চুয়াডাঙ্গা উল্লেখযোগ্য। এসব স্থানে অনেক সাহিত্য রচনা করেছেন কবি। অনেক রচনা অমরত্ব পেয়েছে। চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গায় (পূর্বের নাম নিশ্চিন্তপুর) বেশ কয়েকবার এসেছেন। এখানেও কালজয়ী রচনা করেছেন। একেবারেই পাশেই রয়েছে খ্রিস্টানদের সিমেট্রি বা কবরখানা। আছে দুটো গির্জা; কয়েকগজ দূরেই।

‘বাবুদের তাল-পুকুরে/হাবুদের ডাল-কুকুরে/সে কি বাস করলে তাড়া,/বলি

থাম একটু দাঁড়া।’

ছড়ার অংশবিশেষ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লিচু চোর কবিতার। এ ছড়াটি যে চুয়াডাঙ্গার মাটিতে বসেই কবি লিখেছিলেন। এ খবর হয়তো আমরা কেউই তেমন জানি না। না জানারই কথা। ‘লিচু চোর’ কবিতাটি যে চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গায় লেখা, এর পক্ষে হয়তো এত দিনে দালিলিক কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা কষ্টসাধ্য, তবে জেলার অনেক গুণী ব্যক্তিই এটি স্বীকার করেছেন যে, লিচু চোর কবিতার ভাব, ভাষা, আচরণ ও তার উপস্থাপনের ঢং চুয়াডাঙ্গার পরিবেশকেই চিহ্নিত করে। এ ছাড়া কবির প্রখ্যাত উপন্যাস মৃত্যুক্ষুুধা ও পদ্মগোখরা এখানকার রচনা বলেও অনুমান করা হয়। তবে মৃত্যুক্ষুুধা উপন্যাসটি কৃষ্ণনগরে লেখা বলেও অনেকে মত দিয়েছেন।

আমাদের জাতীয় কবি নজরুল তরুণ বয়সে অনেকবার এসেছেন চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার সীমান্তবর্তী জনপদ কার্পাসডাঙ্গায়। তার স্মৃতিবিজড়িত খড়ের আটচালা ঘরটি এখনো সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ঘরটি বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে। এই লেখাটির উদ্দেশ্য লিচু চোর কবিতা বা আর দুটো উপন্যাস চুয়াডাঙ্গায় রচিত বলে দাবির জন্য নয়। শুধু কবির স্মৃতিবিজড়িত আটচালা ঘরটি সংরক্ষণের তাগিদকে সামনে নিয়েই লেখা আর কী! কারণ কবি যে এই ঘরেই অনেক দিন-রজনি কাটিয়েছেন, সে ব্যাপারে কারো দ্বিমত বা বিতর্ক নেই। তৎকালীন দামুড়হুদা উপজেলার ভৈরব নদের তীরবর্তী কার্পাসডাঙ্গা মিশনপাড়ার সরকার পরিবার ছিল জ্ঞান-গরিমায় বেশ সম্ভ্রান্ত। এই পরিবারের সন্তান শ্রী মহিম সরকার চাকরির সুবাদে থাকতেন কলকাতায়। কলকতা আমহার্স্ট স্ট্রিটে তিনি সপরিবারে বসবাস করতেন। মহিম সরকারের সঙ্গে কবি কাজী নজরুল ইসলামের খুবই সখ্য ছিল। তার বাড়িতে কবির আসা-যাওয়া ছিল আপনজনের মতো। তার দুই মেয়ে আভা রানী সরকার ও শিউলী রানী সরকার নজরুলগীতি চর্চা করতেন। তাদের গানের তালিম দিতেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম নিজে। পরবর্তীতে আভা রানী সরকারের গানের রেকর্ডও বের হয়। প্রখ্যাত লেখক ড. আশরাফ সিদ্দিকী অনুসন্ধান করে নজরুলের কথা ও সুরে আভা রানী সরকারের ছয়টি গানের রেকর্ড-তথ্য পান।

একাধিক তথ্যসূত্রে জানা যায়, মহিম সরকারের পারিবারিক আমন্ত্রণে একাধিকবার কবি নজরুল কার্পাসডাঙ্গায় এসেছেন। তবে ১৯২৬ সালে ২৭ বছর বয়সে কবি সপরিবারে এখানে বেড়াতে আসেন। এ সময় প্রায় দুই মাস কার্পাসডাঙ্গায় অবস্থান করেন। তার সঙ্গে এসেছিলেন শাশুড়ি গিরিবালা, স্ত্রী প্রমীলা ও বড় ছেলে বুলবুল। তারা কলকাতা থেকে ট্রেনযোগে দর্শনায় নেমে ছয় মাইল গরুগাড়িতে করে কার্পাসডাঙ্গায় আসেন। কার্পাসডাঙ্গা মিশনপাড়ার প্রয়াত শ্রী দ্বারিক নাথ ওরফে তেরেন সরকারের ভাষ্যমতে, কবি কলকাতা এবং কৃষ্ণনগর থেকে কয়েকবার কার্পাসডাঙ্গায় আসেন। কার্পাসডাঙ্গার বিপিন সরকার জানিয়েছেন, কবির সঙ্গে বসে তাস খেলেছেন তিনি। পারিবারিক আমন্ত্রণে কবি নজরুলের কার্পাসডাঙ্গায় আগমন ঘটলেও স্বদেশি আন্দোলন বেগবান করার জন্য অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গে গোপন বৈঠকও তিনি করেছিলেন বলে সে সময়কার অনেকেই মৃত্যুর আগে জানিয়ে গেছেন। তাদের মধ্যে দ্বারিক নাথ ওরফে তেরেন বাবু অন্যতম। তার ভাষ্যমতে, কার্পাসডাঙ্গা মিশন চত্বরে কয়েকটি ঝাউগাছ ছিল। সেই গাছে এক দিন একটি বিষধর দেখতে পান দ্বারিক। সাপটিকে মেরে ফেলেন তিনি। পরে কবি বিষয়টি জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হন। এ কারণেই কবি নজরুল কার্পাসডাঙ্গায় রচনা করেন পদ্মগোখরা। কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম নসকর আলী ১৯৮৭ সালে কলকাতায় গিয়েছিলেন। তখন জীবিত ছিলেন কার্পাসডাঙ্গার মহিম বিশ্বাসের মেয়ে আভা রানী সরকার ও শিউলী রানী সরকার। তাদের দুজনের সঙ্গে কথা বলেন নসকর আলী। আভা রানী ও শিউলী রানী নিশ্চিত করেন নজরুল কয়েকবার কার্পাসডাঙ্গায় গিয়েছেন। কাজী নজরুল ইসলাম কার্পাসডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী কুড়ুলগাছির গাঙ্গুলী ও মজুমদার বাড়িতেও কয়েকবার এসেছেন বলেও জানা যায়। কার্পাসডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী কোমরপুর গ্রামের কৃতী লেখক ছিলেন এম ইব্রাহিম। তিনিই নজরুলকে কার্পাসডাঙ্গায় প্রথম কাগজে-কলমে তুলে ধরেন। তার লেখা নজরুল ও নিশ্চিন্তপুর গ্রন্থে নজরুলকে নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। এই গ্রন্থটি ১৯৯০ সালে প্রকাশ করেন এম ইব্রাহিম। যা আগে চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দর্পণ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। নজরুল ও নিশ্চিন্তপুর গ্রন্থে লেখা আছেÑ ‘নিশ্চিন্তপুর’ কার্পাসডাঙ্গার পূর্বপাড়ার নাম। নিকট অতীতে এখানে ছিল নীলকুঠি, জমিদারি কোম্পানির সদর দফতর, পরে মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানির সদর দফতর। কার্পাসডাঙ্গা বাজারের পূর্বপাশে প্রায় দেড়শ একর জমি ঘিরে বাঘাডাঙ্গা গ্রামের পশ্চিম দিকে নায়েববাড়ি পর্যন্ত এলাকা নিশ্চিন্তপুর নামে পরিচিত ছিল। কার্পাসডাঙ্গার ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যবাহী এলাকা নিশ্চিন্তপুরের কোনো চিহ্ন নেই আর। খাতা-কলমেও প্রায় অবলুপ্ত। সর্বশেষ কার্পাসডাঙ্গার ডাকঘরটির নাম ছিল নিশ্চিন্তপুর, কিন্তু তাও এখন হয়ে গেছে কার্পাসডাঙ্গা। কবি কাজী নজরুল ইসলাম কার্পাসডাঙ্গায় অবস্থানকালে একটি আটচালা ঘরে তার থাকার জায়গা হয়। যে খাটে তিনি ঘুমোতেন, যে আলমারিটা তিনি ব্যবহার করতেন, তা আজও অক্ষত অবস্থায় আছে। কবির গুরুত্ব অনুভব করে তার স্মৃতি লালন করে আসছেন বংশপরম্পরায় প্রকৃতি বিশ্বাস। কবি কাজী নজরুল ইসলাম এখানে মহিম সরকারের আমন্ত্রণে আসার পর এখানকার কংগ্রেস নেতা শিক্ষক হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের সঙ্গে ভাব জমে তার। হর্ষপ্রিয় বিশ্বাস ছিলেন বর্তমান ভারতের শিমুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ফলে শিক্ষিত মানুষ হিসেবে হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের সঙ্গে কবির বেশ খাতির জমে ওঠে। সেই সুবাদে আটচালা ঘরেই কবির থাকার জায়গা হয়।

কবি যতবার এসেছেন এই ঘরেই থাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। আটচালা ঘরটি প্রথমত হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের উদ্যোগেই সংরক্ষণ করে রাখা হয়। পরবর্তীতে হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের ছেলে বাবু প্রদ্যুত বিশ্বাস বাবার ভূমিকা পালন করে যান। বর্তমানে কবির স্মৃতিবিজড়িত আটচালা ঘরটি সংরক্ষণ করে রেখেছেন হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের দৌহিত্র প্রকৃতি বিশ্বাস। ৯০ বছর ধরে বিশ্বাস পরিবার নিজ খরচে খড়ের ঘরটি সংরক্ষণ করে আসছে। কবি নজরুল কার্পাসডাঙ্গায় জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তার পেছনে এই বিশ্বাস পরিবারের অবদান একেবারে খাটো

করে দেখা যায় না।

ইদানীং চুয়াডাঙ্গা জেলায় মাটির ঘর নেই বললেই চলে। যে কারণে কেউ খড়ের আবাদও করে না। কিন্তু এই বিশ্বাস পরিবারের সন্তান প্রকৃতি বিশ্বাস অনেক খুঁজে খড় জোগাড় করে প্রতি বছর ঘরটি ছেয়ে রাখেন। এজন্য তার যেমন ভোগান্তি তেমনি খরচও একেবারে কম হয় না। আটচালা ঘরটি সংরক্ষণ ও দেখভালের জন্য একজন কেয়ারটেকার রাখার প্রয়োজন। প্রয়োজন ঘরটি স্থায়ীভাবে প্রশাসনের হস্তগত করা। এ কারণে প্রকৃতি বিশ্বাস যাতে না ঠকেন, সেটিও জেলা প্রশাসন খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবে বলে ভুক্তভোগীরা মনে করেন। এই ঘরটির পাশেই চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় দামুড়হুদা উপজেলা প্রশাসন ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নজরুলের স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছে। নজরুলের জন্ম ও মৃত্যু দিনে এখানে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অনুষ্ঠান পালিত হচ্ছে। প্রতিনিয়তই মুজিবনগরগামী পর্যটকরা এখানে স্মৃতিবিজড়িত ঘরটি দেখতে আজও ভিড় করেন।

যাতায়াত

নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত আটচালা ঘরের ১৫-২০ কিমির মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আটকবর ও মুজিবনগর। ঢাকা বা যেকোনো প্রান্ত থেকে ট্রেন বা বাসে চুয়াডাঙ্গা বা দর্শনায় নামতে হবে। এরপর বাস/অটোতে অল্পপথের কার্পাসডাঙ্গা। ঢাকার গাবতলী/কল্যাণপুর থেকে দর্শনাগামী অনেক বাস কার্পাসডাঙ্গা পর্যন্ত যায়। প্রায় নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র পর্যন্ত। এখান থেকে হাঁটাপথ দূরত্ব।

থাকা ও খাওয়া দর্শনা/চুয়াডাঙ্গাতে মাঝারি মানের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আর মুজিবনগর দেখে মেহেরপুর শহরেও থাকতে পারেন অনায়াসে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close