ইভান অনিরুদ্ধ

  ১০ মে, ২০১৯

গল্প

শাস্তি

মেন্দিপুর ইউনিয়নের ইছাপুর গ্রামের মন্নাফ আলি বড় মাপের গেরস্ত না হলেও বৈশাখ মাসে যে পরিমাণ ধান পায়, তাতে তাকে ইছাপুরের একজন সুখী মানুষই বলা যায়। সারের খরচ, মেশিনের তেলের খরচ, কামলা খরচÑ এসব বাদ দিয়ে সে প্রতি বছর এই সময় প্রায় ১০০ মণ ধান পায়। এতে সারা বছরের সংসারের খোড়াকি নিশ্চিন্তে চলে। হঠাৎ তার কোনো বিপদ সামনে এলেও ঘরের ধান ব্যাপারীর কাছে বিক্রি করে সহজেই উদ্ধার পায়। পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে ধারদেনা করতে হয় না।

মন্নাফ আলির এই সুখী অবস্থা এক দিনে আসেনি। একটা সময় সে কী কষ্টই না করেছে! ইদ্রিস চেয়ারম্যানের ঘরে বছর চুক্তিতে কামলা খেটেছে। গ্রামের ভাষায় যাকে বলে ‘বদ্ধ’ থাকা। মাত্র ১০ হাজার টাকায় সে বদ্ধ থেকেছে বছরের পর বছর। গতর খাটা সেই কষ্টের টাকা জমিয়ে প্রতি বছর কিছু কিছু ফসলের জমি কিনেছে। অথচ এটা বেশি দিন আগের কথা না। চোখ বন্ধ করলে চোখের আয়নায় সেসব দিন ভাসে!

নতুন বউ ঘরে এসেছে তখন। বৃদ্ধ মা-বাবা আর বিয়ের যোগ্য ছোট দুই বোন সংসারে। এই সংসারটা কেবল মন্নাফের একার রোজগারে চলত। বছর ঘুরতেই বউ পোয়াতি হলো। কোলজুড়ে এলো পরীর মতো ফুটফুটে একটা মেয়ে। তারপর মেয়ের বরকতেই কি না, তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে লাগল দ্রুত। একটা সময় সে ইদ্রিস চেয়ারম্যানের ঘরে গতর খাটা বাদ দিয়ে নিজেই গিরস্তি শুরু করল। আসলে দিন তো সবার এক রকম যায় না। দিন বদল হয়, জীবনেরও রং বদলায়।

ইছাপুর গ্রামটা হাওরের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভরা বর্ষায় এই গ্রাম একটা সবুজ দ্বীপে পরিণত হয়। আর শুকনো মৌসুমে হাওর শুকিয়ে যায়। যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানের খেত। বৃষ্টির সময় উজানের ঢল যদি না নামে তা হলে এসব ফসলের কোনো ক্ষতি হয় না। তখন গ্রামের সব গেরস্তই ভালোভাবে বৈশাখের ফসল ঘরে তুলতে পারে। অবশ্য তিন বছর আগে যখন ইদ্রিস মিয়া ইলেকশনে জিতে প্রথম চেয়ারম্যান হলো মেন্দিপুর ইউনিয়নের, তখন সে ইছাপুর গ্রামের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে নানা জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করে, এলাকার এমপি সাহেবকে ধরে গ্রামের পেছনে তিন কিলোমিটার লম্বা একটা বাঁধের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে এটা তার একটা খুব ভালো অর্জন। এই বাঁধটাই হলো ইছাপুর গ্রামবাসীর প্রাণভোমরা। উজানের ঢলের পানি আটকিয়ে রাখে এই বাঁধ। সারা গ্রামের মানুষের মতো মন্নাফও তখন খুব খুশি চেয়ারম্যানের ওপর। কিন্তু গত শুকনো মৌসুমে এই বাঁধ সংস্কারের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বেশ বড় অঙ্কের টাকা এসেছে চেয়ারম্যানের কাছে। কেউ বলে পাঁচ লাখ, কেউ বলে দশ লাখ। মন্নাফের এই নিয়ে মাথাব্যথা নাই। তার কথা একটাই, চেয়ারম্যান যেন এই বাঁধ সরকারের টাকায় ঠিকঠাক কইরা রাহে। বাঁধ মজবুত থাকলেই ইছাপুর গ্রাম মজবুত থাকব। গ্রামের ধনী-গরিব সকল মানুষ সুখে থাকব। আমার কেবল এই সামান্য চাওয়া।

কিন্তু মন্নাফের চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার হিসাব মেলে না। এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার যখন অসৎ আর ধান্দাবাজ হয়ে যায়, তখন সাধারণ মানুষের দুর্দশা বাঁধভাঙা বানের জলের মতোই হয়। সব তলিয়ে নিয়ে যায়। ইদ্রিস চেয়ারম্যান ক্রমেই সেই রকম হয়ে উঠেছে। টাকার লোভ সে হজম করতে পারে নাই। কোনো রকমভাবে কিছু টাকা খরচ করে, কিছু বাঁশ, মাটি দিয়ে লোক দেখানো সংস্কার করেছে বাঁধটা। কত দিন যে মন্নাফ চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে মিনতি করেছেÑ গ্রামের সবাইকে নিয়ে শক্তভাবে এই বাঁধটা মেরামত করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। চেয়ারম্যান উল্টো রেগে

কাঁই হয়ে গেছে।

ইদ্রিস চেয়ারম্যান রেগে গিয়ে মন্নাফকে ধমক দিয়ে বলল, কী রে মন্নাফফিয়া, তুই অহন বড় গিরস্ত অইছস। তয় অত বেশি বুঝিছ না কইলাম। অহনো তো আমার ঘরের ভাত ছালুন তোর পেডের ভিত্রে আছে। মন্নাফ কিছুই বলে নাই। এই কথার পর সে আর কীইবা বলতে পারে? মাথা নিচু করে চুপচাপ ইদ্রিস চেয়ারম্যানের সামনে থেকে চলে এসেছে। বর্ষা আসার আগে যদি এইবার বাঁধ মাটি ফেলে উঁচু করে ঠিক না করা হয়, তা হলে এইবার আর ফসলের মুখ দেখতে হবে না। বটতলা বাজারে বিল্লালের চায়ের দোকানে মাঝে মধ্যে মন্নাফ গেলে গ্রামের দু-চারজনের সঙ্গে দেখা হয়। তারা অনেকটা আশা নিয়ে তার কাছে বাঁধের বিষয়ে কথাটা বলে। একজন বলে, হুনছি চেয়াম্যানের কাছে টেহা আইছে মাটি কাটানির লাইগ্যিয়া। আরেকজন চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে বলে, মন্নাফ ভাই, তুমি যদি চেয়ারম্যানরে ইট্টু বোঝাইয়া কও তাইলে কাম ডা তাড়াতাড়ি অওনের আশা আছে। মন্নাফ কেবল চুপচাপ শুনে। কিন্তু তাদের কথার উত্তর দেয় না। উত্তর দিতে তার ইচ্ছে হয় না। আর কী উত্তর দেবে সে? চেয়ারম্যান যে খারাপ মানুষ, তা কি তারা জানে না? তার পরও দিন সাতেক পর গ্রামের ১৫-১৬ জনের একটা দল ইদ্রিস চেয়ারম্যানের বাড়িতে গিয়ে তাদের সমস্যার কথা জানায়। চেয়ারম্যান সব শুনে মন্নাফের দিকে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, মন্নাফ, তুই তো দেহা যায় নেতা অইছস। গাঁওওয়ালা লইয়া মিছিল-মিটিং শুরু কইরা দিছস। আমার ফান্ডে কোনো টেহা নাই। তাই এইবার আর মাটি কাটানির বাও নাই। অহন তোরা আমার সামনে থাইক্যিয়া দূরাবায় যা। কিন্তু মন্নাফ সকলের পক্ষ থেকে চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে বলে, ভাইসাব, আমরা যাওনের লাইগ্যিয়া আইছি না। আমরা আইছি একটা সমাধানের আশায়। গ্রামবাসী আফনেরে ভোট দিয়া চেয়ারম্যান বানাইছে কি গরিবের হক মাইরা খাওনের লাইগ্যিয়া? হাজার হাজার টেহা সরকার দিতাছে গরিবের উন্নতির আশায়। আর আফনে আমরার টেহা লইয়া নয়-ছয় খেলা শুরু করছুইন। এইডার পরিণাম

ভালা অইত না।

এই কথায় ইদ্রিস চেয়ারম্যান মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে পায়ের স্যান্ডাল খুলে মন্নাফের মুখের দিকে ছুড়ে মারে। সেই সঙ্গে রাগে প্রচন্ড কাঁপতে কাঁপতে হাত দিয়ে অশ্লীল ভঙ্গি করে বলে, চুতমারানির পোলা, তোর পুটকি দিয়া মাটি ভইরা দিয়াম। তোরে আমি এমন শিক্ষা দিয়াম যে, সারা জীবন মনে থাকব। মন্নাফ এসব কথার উত্তর না দিয়ে সবাইকে নিয়ে চেয়ারম্যানের সামনে থেকে ওঠে আসে।

সারা গ্রামের মানুষ জেনে গেছে মন্নাফের সঙ্গে ইদ্রিস চেয়ারম্যানের একটা বিরাট কিছু ঘটেছে। তবে গ্রামের ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ মন্নাফের পক্ষে। কিন্তু ভয়ে প্রকাশ্যে চেয়ারম্যানের অন্যায়, দুর্নীতির প্রতিবাদ তারা কেউ করার সাহস রাখে না। সেই সাহসটা কেবল মন্নাফের বুকের ভেতর থেকেই বেরিয়ে আসে। ইদ্রিস চেয়ারম্যান বুঝতে পারে এই কামলার বাচ্চারে এখনি একটা উচিত শিক্ষা না দিলে সে তার ভবিষ্যৎ একেবারে পাতিলের তলার কালির মতো অন্ধকার করে দিতে পারে। এই নিয়ে সে তার ক্যাডার বাহিনীর সঙ্গে বুদ্ধি-পরামর্শ করে। শাস্তিটা সরাসরি মন্নাফকে না দিয়ে তার কলিজার ভেতর হাত দিতে হবে অন্যভাবে। এগারো বছরের একমাত্র মেয়েটাই হলো মন্নাফের কলিজার টুকরা। ঠিক হয়, খাল পাড়ের রাস্তা দিয়ে স্কুল থেকে মেয়েটা যখন বাড়ি ফিরবে, তখন বসির আর জয়নাল জোর করেই তাকে তুলে নিয়ে আসবে চেয়ারম্যানের গোচালা ঘরে। তারপর যা করার তাই করবে বসির আর জয়নাল। লাশটা রাতেই ফেলে রেখে আসবে ইছাপুর গ্রামের বাঁধের ওপর। পরদিন গ্রামের লোকজন যেন দেখতে পারে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হওয়া মন্নাফের নিষ্পাপ মেয়ের লাশ। সামান্য একজন গতরখাটা কামলা থেকে গিরস্ত বনে যাওয়া মন্নাফকে এরচেয়ে আর কোনো উচিত শাস্তি দেওয়ার বুদ্ধি ইদ্রিস চেয়ারম্যান এবং তার ক্যাডারদের

মাথায় আসেনি।

বাঁধের পাশে নিষ্প্রাণ পড়ে থাকা মেয়ের লাশের ওপর মন্নাফ উপুড় হয়ে পড়ে বুক চাপড়ে আহাজারি করছে। সেই কান্নার আওয়াজ মুহূর্তের ভেতর ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হয়ে পুরো গ্রামকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। কারো আর বোঝার বাকি রইল না যে, এটা ইদ্রিস চেয়ারম্যানের লোকদের কাজ। মন্নাফকে মুখ ফুটে কিছু বলতে হয়নি, প্রতিবাদী গ্রামবাসী হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়ে চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে মিছিলের মতো করে হাঁটা দিয়েছে। যে হাত দিয়ে যারা তাকে এক দিন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল, আজ সেই হাত দিয়েই তারা তার ঘরবাড়ি তছনছ করে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আগুনের ভয়াল লেলিহান শিখা মন্নাফের কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই দাউ দাউ করে ঘরবাড়ির চারদিকে

ছড়িয়ে পড়েছে।

কেবল ঘরের ভেতর থেকে অসহায় ইদ্রিস চেয়ারম্যানের গগনবিদারী চিৎকার ভেসে আসছেÑ বাঁচাও, বাঁচাও! তোমরা আমারে বাঁচাও! কিন্তু তার ভাগের শাস্তি শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউই তাকে বাঁচাতে আসেনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close