নাজমুল হাসান মেহেদি

  ২৭ জুলাই, ২০১৮

পাথরচাপা প্রশ্ন

আদিব ক্লাস টেনে উঠেছে। মাথায় অনেক চিন্তা। ঠিক এক বছর পরেই সে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। আজকাল গণহারে যেভাবে জিপিএ-৫ পাচ্ছে তাতে ভয় লাগছে আদিবের। সে তো ক্লাসের ফার্স্ট বয়, হোক না গ্রামের স্কুল। ফার্স্ট তো ফার্স্টই। নবম শ্রেণির ফাইনালে কী এক কা-ই না ঘটে গেল! যে ফিরোজ নবম শ্রেণিতে ফার্স্ট ছিল সে এখন চতুর্থ আর নিশাত দ্বিতীয়তেই রয়ে গেল। আগে নিশাত আদিবকে অতটা পাত্তা দিত না। কারণ অবশ্য একটা ছিল, আদিব যে গত ক্লাসে পঞ্চম অবস্থানে ছিল।

এখন নিশাত আদিবকে পাত্তা দেয় তাও পড়াশোনা কেন্দ্রিক, আদিবের পজিশনের উন্নতি না হলে হয়তো তার প্রতি নিশাতের দৃষ্টিভঙ্গিরও উন্নতি হতো না। আদিব এমনিতেই লাজুক প্রকৃতির আর নিশাতের রূপের কথা পুরো স্কুলের কে না জানে। গত বছরের এসএসসি পরীক্ষায় দুই দুইটা বড় ভাইয়ের ফেলের পেছনে নাকি নিশাতের সৌন্দর্যের দায় রয়েছে বলে কথিত আছে।

দশম শ্রেণির ইংরেজি প্রথমপত্র পড়ান আশিক স্যার। ভালোর রাম আর মন্দের রাবণ এই দুইটা চরিত্রের বেশ সুচারু সংমিশ্রণ রয়েছে এই লোকটার মধ্যে। ক্লাসে পড়া পারলে তাকে মাথায় করে নাচতেও রাজি, যে পড়া পারে তার কাছে স্যার খুব ভালো মানুষ। আর যদি কেউ পড়া না পারে তাহলেই হলো। এমন কোনো উদ্ভট ধরনের শাস্তি মনে হয় বাকি নেই, যা তিনি ক্লাসে দেননি। ব্যথা থেকে অপমান, কী না দিয়েছেন ক্লাসে। একদিন মেয়ে বলে তনুকে ছাড় দেননি, ক্লাসের বাইরের করিডোরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন যেখান থেকে জুনিয়র ছেলে-মেয়েরা আসা-যাওয়া করে। লজ্জায় অপমানে অনু সাতদিন জ্বরে ভুগেছিল।

আশিক স্যারের শাস্তি থেকে বাঁচতে অন্য যে স্যাররা একটু কম কঠোর তাদের বিষয়ের পড়া লাটে উঠল। সব সাবজেক্ট এমনকি গণিতের থেকে দশম শ্রেণির সবার নজর বেশি ছিল ইংরেজি প্রথম পত্রের দিকে। কেউ শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আবার কেউ লজ্জা আর অপমান থেকে মুক্তি পেতে।

আদিব গণিতের থেকে ইংরেজিতে ভালো, তাই আশিক স্যারের কাছে বরাবরের মতো স্নেহের পরশ পেয়ে আসছে। কিন্তু আশিক স্যারের কাছে আদিব যতটাই আদরের, গণিতের স্যারের কাছে ততটাই নিগ্রহের। গণিত স্যার আদিবকে কোনো এক অজানা কারণে দেখতে পারতেন না, সেটা গণিত একটু কম পারার কারণে নাকি তার কাছে প্রাইভেট না পড়ার কারণে নাকি জনপ্রিয় আশিক স্যারের স্নেহভাজন হবার কারণে, তা জানা যায়নি।

আশিক স্যার বৃহস্পতিবার পড়া দিয়েছেন, একটা প্যারাগ্রাফের অর্ধেকটা। শনিবার পড়া নেবেন। শনিবার আদিব আর তিন-চারজন ছাড়া কারোরই পড়া হয়নি। সেদিন স্যার কী মনে করে যেন কোনো শাস্তি না দিয়ে বললেন, আগামী শনিবার এই প্যারাগ্রাফের পুরোটা পড়া থাকবে। যে না পারবে তাকে সোজা হেডমাস্টারের রুমে পাঠিয়ে দেব। আর হেডমাস্টারের রুমে যাওয়ার মানে তো বুঝ, পিঠের চামড়া থাকবে না।

ঘটনাটা পরের দিন রোববারের। ক্লাসে টিফিনের সময় মেয়েরা যখন কমন রুমে ছিল, নিশাতরা ইংরেজি প্যারাগ্রাফের বইটা ক্লাসে রেখে গিয়েছিল। ফিরে এসে বইটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কেউ ইচ্ছে করে লুকিয়ে রেখেছিল নাকি চুরি হয়েছিল তা বোঝা যাচ্ছিল না।

নিশাত মন খারাপ করে বসেছিল, হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল। কারণটা বই না। শনিবারে আশিক স্যারের কাছে পড়া সে কীভাবে দেবে ভেবে পাচ্ছিল না, তাই কেঁদে ফেলেছিল। অন্য বান্ধবীরা এসে সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করল। সোমবার প্রথম পিরিয়ডের পরে নিশাত হঠাৎ ছেলেদের জন্য বরাদ্দ ক্লাসের ডান পাশের সারির দ্বিতীয় বেঞ্চের কোণায় যেখানটাতে আদিব নিয়মিত বসে সেখানে এলো।

আদিব, তোমার কি আশিক স্যারের প্যারাগ্রাফটা পড়া হয়েছে?

হ্যাঁ, আমার হয়ে গেছে। দুয়েকবার রিভিশন দিলেই হয়ে যাবে। তোমার বইটা তো হারিয়ে গেল, নতুন বই কিনেছ?

না, আব্বা ঢাকা থেকে না আসা পর্যন্ত বই কেনা সম্ভব না। আদিব, তোমার বইটা আমাকে দুই দিনের জন্য দেবে? আমি বুধবারেই দিয়ে দিতে পারব।

আচ্ছা, আজকেই নিয়ে নিও, আমার তো পড়া শেষ। তাছাড়া আমি খুঁজলে হয়তো আমার বড় ভাইয়ের দুই বছর আগের বইটা পেয়ে যাব, সেখান থেকে প্যারাগ্রাফটা রিভিশন দিয়ে নিতে পারব।

ধন্যবাদ, আদিব।

অন্য ছেলে ক্লাসমেটরা ব্যাপারটা নিয়ে কিছুক্ষণ মশকরা করল আদিবের সঙ্গে।

আদিব বই তো দিলো, কিন্তু মনের মধ্যে একটা খটকা রয়ে গেল। দুই দিনের জন্য হলে তো নিশাত মেয়েদের মধ্যে যে কারো বই নিতে পারত। কিন্তু কেন আমার থেকে নিল? যাইহোক, নিয়েছে নিক, পড়া পারলেই হলো। মেয়েটা এমনিতেই ইংরেজিতে দুর্বল।

নিশাতের জন্য কেমন যেন মায়া হয় আদিবের। এই মেয়েটার জন্য কত ছেলেই না পাগল। ফিরোজও যে ওর প্রতি দুর্বল সেটা আজিজ আর রাশেদ মিলে যখন নিশাতকে নিয়ে ফিরোজকে ক্ষেপায় তখন বোঝা যায়। বুধবারে ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও নিশাত আদিবের বই দিল বৃহস্পতিবার দিন তা-ও শেষ পিরিয়ডে, ছুটির সময়। আদিবের বই নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথা ছিল না। কারণ ইতোমধ্যে সে ঘরের বস্তাবন্দি বইয়ের ভেতর থেকে বড় ভাইয়ের পুরনো বইটা বের করে নিয়েছে। তাই নিশাতের ফেরত দেওয়া বইটা নিয়ে টেবিলেই অন্য বইয়ের সঙ্গে রেখে দিল, খুললও না। রহস্যটা ছিল সেখানেই।

শনিবারে আশিক স্যারের ক্লাসে কোনো দিনও পড়া দিতে পারে না সে রকম কয়েকজন বাদে বাকিরা মোটামুটি ভালোভাবে স্যারের প্যারাগ্রাফ মুখস্থ করে এসেছিল। স্যার লিখতে বলাতে আরো একটু সুবিধা পাওয়া গেল। মুখস্থ বলতে গেলে তো শুধু মুখের ব্যবহার হয়, চোখ থাকতে হয় দেওয়ালের দিকে নয়তো জানলা দিয়ে বাইরে ধানখেতের দিকে। অন্যদিকে লিখতে গেলে অনেকের হাত চলে নিজের খাতায় আর চোখ চলে পাশের জনের খাতায়। সুতরাং, লিখলে একটু বেশি সুবিধা পাওয়াই যায়।

সেদিন নিশাতের মধ্যে কেমন যেন একটা উত্তেজনা অথবা উদ্বিগ্নতার ছাপ দেখতে পেয়েছিল আদিব। প্রথমে ভেবেছিল হয়ত আশিক স্যারের পড়ার জন্য, কিন্তু না, আশিক স্যারের ক্লাস শেষ হয়ে গেলেও রেশ কাটছিল না। স্কুল ছুটির সময় গেট দিয়ে বের হওয়ার পথে আদিবের সঙ্গে নিশাতের দেখা হয়, ঘটল উল্টো ঘটনা।

আদিব, তুমি কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?

কই, না তো। চিন্তিত কেন হব!

না, মনে হলো তাই।

ও, আচ্ছা, আরে নাহ আমি দিব্যি আছি।

ওকে, কাল ক্লাসে দেখা হবে। বাই

নিশাত এই হেয়ালিটা কেন করল আদিবের মাথায় খেলে না। এড়িয়ে গেল নাকি স্কুলে কোনো ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে গেটে দাঁড়িয়ে বেশিক্ষণ কথা বললে হেডস্যারের কাছে নালিশ যাবে সে ভয়ে চলে গেল! এই জন্যই মনে হয় অল্প বয়সের প্রেমে মেয়েরাই বেশি আধিপত্যবাদী হয়ে থাকে, ছেলেরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাখি ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। এই উড়াল দেওয়ার কারণ কি ছেলেটা কম বোঝার কারণে নাকি মেয়েটা বেশি বোঝার জন্য তা অবশ্য গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে।

পরের সপ্তাহে আদিবের সেই বইটার প্রয়োজন পড়ে, যে বইটা নিশাত নিয়েছিল। বইটা খুলতে গিয়ে একটা চিরকুট পাওয়া গেল। গোলাপি রঙের ছোট্ট কাগজে লেখাÑ যদি তোমার মতো কেউ কাছে থেকে থাকে, তাকে তোমার মনের কথা বলে দেওয়া উচিত।

লেখাটা পড়ার পরে লাজুক আদিবের কান গরম হতে শুরু করল। কেউ যেন তার কানে অবিরত গরম বাতাস দিয়ে যাচ্ছে। চিরকুটটা সে অন্তত পঞ্চাশ বার পড়ল। কিন্তু কোনো কিছু ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। নিশাত যে আদিবকে চিরকুট লিখতে পারে, এই কথাটা কিছুতেই তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। নিশাতের পেছনে যেসব ছেলেরা ঘুরে তাদের মধ্যে বেশ ধনাঢ্য পরিবারের ছেলে রয়েছে, দুয়েকজনের মোটরবাইকও আছে, সেখানে আদিবের একটা প্যাডেল মারা বাইসাইকেলও নেই। হয়তো ভুলে অন্য কাউকে দেওয়ার জন্য চিরকুটটা লিখে বইয়ের পাতার ভাঁজে রেখে দিয়েছিল, বের করে নিতে মনে ছিল না।

আচ্ছা, তাহলে বই ফেরত দেওয়ার পরের দিন নিশাত অমন করে উদ্বিগ্ন ছিল কেন? অমন চোখে কি চিরকুটের উত্তর চেয়েছিল নাকি চিরকুটটা আমার কাছে চলে আসাতে আমার প্রতিক্রিয়া কিংবা কাউকে বলে দেই কি না, সেটা জানতে কৌতূহলী ছিল? নাহ, মাথা কাজ করছে না।

এমন সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে উনিশ-বিশেও মেলাতে না পেরে হিসেবটা নয় আর নব্বইতে রেখেই আদিব ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে ঘুম ভাঙতে মনে হলো, কারো সঙ্গে ব্যাপারটা শেয়ার করা উচিত। কিন্তু আব্বু-আম্মুর কাছে এখনই বলা যাবে না। তাতে সমস্যা বাড়বে। বিছানা ছেড়ে আদিব স্কুলে গেল ঠিকই কিন্তু নিজেকে কিছুতেই স্বাভাবিক রাখতে পারছিল না। ওদিকে নিশাত এ কয়দিনে মোটামুটি স্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে দিয়েছে।

আদিব তার মনের কথা খুলে বলার জন্য শেষ পর্যন্ত একজনকে খুঁজে পেল, সে রিয়াজ ভাই। রিয়াজ আদিবদের সঙ্গেই পড়ে তবু ভাই বলার কারণ হচ্ছে, রিয়াজের এক বছরের একটা ইয়ার গ্যাপ আছে। আদিব তার আদ্যোপান্ত সব রিয়াজকে খুলে বলল, সঙ্গে দ্বিধা-দ্বন্দের কথাও। কথাগুলো শোনার পরে রিয়াজও দ্বন্দ্বে পড়ে গেল আসলে ব্যাপারটা কী? কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে রিয়াজ ভাই বিজ্ঞের ভাব নিয়েÑ

আদিব, চিরকুটটা কোথায় আছে?

আমার ব্যাগের পকেটে।

চিরকুটটা ছিঁড়ে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দাও। সামনে এসএসসি পরীক্ষা আর তুমি ক্লাসের ফার্স্ট বয়। পড়াশুনায় নিজেকে ফোকাস কর।

কী মনে করে আদিব সেদিন তার মনের মধ্যে রাজ্যের দ্বিধান্বিত প্রশ্নগুলো পাথরচাপা দিয়ে চিরকুটটা ছিঁড়ে ক্লাসের জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছিল। বাইরে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে গোলাপি রঙের কাগজের টুকরোগুলো ভিজে তলিয়ে গেল, সঙ্গে আদিবের অজান্তে তার হৃদয়ে নিশাতের জন্য লুকোনো ভালোবাসাটাও হারিয়ে গেল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist