শাহরিয়ার সোহেল

  ২০ জুলাই, ২০১৮

গ্রিস, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক ও স্পেনের

নারীবাদী কণ্ঠস্বর

পৃথিবীর সর্বত্রই রয়েছে আহাজারি ও এক বিষণœ ক্রন্দনের সুর। সে সুর অন্য কোথাও নিয়ে যায় আমাদের। আমরা অন্যভাবে নিজেদের ভাবতে পারি। সে সুর মনের গহীনে বাজে মৃদুলয়ে, কখনো উচ্চকিত, কখনো ক্ষোভ, ঘৃণা, ভালোবাসা ও সংগ্রামের সঙ্গে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নারীবাদী শক্তিশালী কণ্ঠস্বরের মতো গ্রিস, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক ও স্পেনেও রয়েছে নারীবাদী শক্তিশালী কণ্ঠস্বর। তাদের চেতনা অন্যদের চেয়ে ভিন্ন নয়। পৃথিবীর যেকোনো জায়গার অনুভূতিই এক, প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন হতে পারে।

সাফোর জন্ম গ্রিসের এক ছোট্ট দ্বীপ লেসবোসে, খ্রিস্টপূর্ব ৬৩০ সালে। তার জীবন সম্পর্কে যত না তথ্য তার চেয়ে বেশি রয়েছে রটনা। তবে মোটের ওপর এটুকু বলা যায়, তিনি একজন অত্যন্ত প্রতিভাশালী, সুক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বময়ী নারী ছিলেন। কবিতা লিখেছেন অনেক কিন্তু কালের কামড় উপেক্ষা করে টিকে আছে অল্পই, মাত্র দুটো পূর্ণাঙ্গ কবিতা এবং বেশ কিছু কাব্য কণিকা, ইংরেজি অনুবাদক ম্যারি বার্নার্ড যাদের নাম দিয়েছেন ‘ফ্রাগমেন্টস’। ব্যক্তিজীবনে সাফো মেয়েদের একটা আশ্রম পরিচালনা করতেন, যেখানে কাব্যকলা, সংগীত, দর্শন, শিক্ষা দেওয়া হতো। তার অধিকাংশ প্রেমের কবিতাই আশ্রমের সেই মেয়েদের উদ্দেশে রচিত।

বিচ্ছেদ বেদনা কেউ সহ্য করতে পারে না। প্রিয়তম চলে যাবে, যে কারণেই হোক, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, এ দুঃখ সইবার নয়। কিন্তু পুরুষ কঠিন হৃদয়। ফুল থেকে ফুলে ঘুরে বেড়াতে চায়। এক টুকরো স্বর্ণখ- পোকা কাটতে পারে না, কিন্তু পুরুষের হৃদয় খুব সহজেই ঘূণে ধরে যায়। প্রিয়তম চলে যায়, তবু কবি সাফো তাকে মনে করিয়ে দেয়, তাদের সুন্দর কিছু মুহূর্তের কথাÑ ‘সত্যি বলছি, এর চেয়ে মরে যাওয়া ভাল’ কবিতায়।

যদি তুমি ভুলে গিয়ে থাক/তা হলে তোমাকে আমাদের সেইসব সুন্দর/মুহূর্তের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই/আমার কাছে বসে তুমি তোমার চারপাশে/জড়িয়ে নিয়েছিলে কত গোলাপ/কমলা আর বেগুনি ফুলের তোড়া/নরম গলায় ঝুলিয়েছিলে যতেœ গাঁথা মালা/তারপর মুখে রাজকীয় প্রসাধনী মেখে/কোমল শয্যায় তুমি তোমার/তৃষ্ণা মিটিয়েছিলে প্রাণ ভরে।

বিংশ শতাব্দীর সূচনায় যে ক’জন হাতে গোনা নারী কবিতায় আধুনিকতার আস্বাদ এনেছিলেন এডিথ সডারগ্রান তাদের অন্যতম। জন্ম লেনিনগ্রাদে, জাতে ফিনল্যান্ডীয়, ভাষা সুইডিশ, এডিথের শৈশব যৌবন কাটে এক অস্থির, অনিকেত পরিপার্শ্বে। রুশ বিপ্লবের পর মা তাকে নিয়ে চলে যান সীমান্তের ওপারে, দারিদ্র্যজর্জর ফিনল্যান্ডের গ্রামে। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রথম গ্রন্থ ঢ়ড়বসং, ১৯১৮ সালে হেলসিংকিতে। ঞযব ঝবঢ়ঃবসনবৎ ওপব. সে কবিতার ভিন্ন সুরে সচকিত হয়ে তুমুল আক্রমণ করেন সমালোচকেরা। ব্যথা ও অভিমানে নিজেকে আড়াল করে রাখেন এডিথ। এমন সময় ইগার অলসেন নামে এক বিপ্লবী নারীর, যিনি নিজেও কবি, তার সঙ্গে গড়ে ওঠে এক আশ্চর্য ভালোবাসার সম্পর্ক, যিনি তাকে কবিতা লেখা চালিয়ে যেতে এবং কবিতার জগতে ক্রমে পরিচিত করে তুলতে সাহায্য করেন। ১৯২৩ সালে দারিদ্র্য ও যক্ষ্মার সঙ্গে লড়ে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেন এডিথ। তার মৃত্যুর পরে সমালোচকদের টনক নড়ে। জীবনের বিনিময়ে তিনি ফিরে পান তার প্রাপ্য প্রশংসা, সম্মান ও জনপ্রিয়তা। তার অপর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোÑ ঞযব অষঃবৎ ড়ভ জড়ংবং এবং মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় ঞযব খধহফ যিরপয রং হড়ঃ.

পৃথিবীর আদিকাল থেকেই নারীরা ভীষণ করুণ অবস্থার ভেতর দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। পুরুষরা নারীদের ছায়া দেয়, তবে তা ঈগলের ডানার ছায়া, ছায়া যেমন দেয়, তার চেয়ে বেশি ছোবল মারে, মুক্তচিন্তার নারীদের হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়। তার জীবনের অংশ যেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে পড়ে। গহীন সমুদ্র সে কষ্ট শুষে নেয়। নারীর হাসির আড়ালে লুকানো থাকে অজস্র কান্নার দাগ। সে ডুকরে ওঠা ক্রন্দনধ্বনি বুকের বাইরে দীর্ঘশ্বাস হয়ে বের হয়, তবু চোখে থাকে না অশ্রু, যেন কত সুন্দর, প্রসাধনীযুক্ত পুতুল একখানা। ‘সিদ্ধান্ত’ কবিতায় কবি বলেছেনÑ

তোমার কি কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয়/তুমি আর কখনোই কোনো কবিতা লিখতে পারো না।/কবিতা ছিঁড়ে পড়বে প্রতিটি কবিতা থেকে,/সে সব আর কবিতা থাকবে না,/হবে ঈগলের থাবার আঁচড়। টোভ ডিটলেভসেনের জন্ম ডেনমার্কে ১৯১৮ সালে। পড়াশোনা ছেড়ে কারখানায় কাজ করতে যান। তিনটি ব্যর্থ বিয়ের অভিজ্ঞতা। সব মিলিয়ে তার কবিতায় এক ধরনের প্রথাবিরোধিতার সুর জাগে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থÑ অ এরৎষ’ং গরহফ, অ ডড়সধহ’ং গরহফ, ঞযব জড়ঁহফ জড়ড়স ইত্যাদি।

প্রচলিত রং গায়ে মেখে সবাই পারে না অন্যের মনোরঞ্জন করতে। কবি টোভ ডিটলেভসেনও পারেননি। যেসব কথায় অন্যেরা খুশি হয়, তিনি তা বলতে পারতেন না। সত্য বিষয়, সত্য কথা বেশির ভাগ লোকই অপছন্দ করে। কবি অকপটে সত্য বলতে দ্বিধা করেন না। এ জন্য তিনবার বিয়ে করেও ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যের মতো হয়ে উঠতে পারেননি। নিজের স্বতন্ত্রবোধ তাকে জাগিয়ে রেখেছে কালান্তরে। ‘আত্মপ্রতিকৃতি’ কবিতায় এজন্যই তিনি বলেছেনÑ

আমি পারি না রাঁধতে, টুপি পরতে/সেজেগুজে মানুষের মনোরঞ্জন করতে/ফুল সাজাতে, দিনক্ষণ মনে রাখতে/উপহারের জন্য ধন্যবাদ ও/রেস্তোরাঁয় বখশিশ দিতে,/ছেলেবন্ধু জোগাড় ও অভিভাবকদের/সভার ব্যাপারে উৎসাহ দেখাতে।’

স্পেনের অন্যতম কবি গেন্ডারিয়া ফুয়ের্তেসের জন্ম ১৯২০ সালে মাদ্রিদে। শ্রমিক ও কৃষকশ্রেণি এবং নিপীড়িত নারীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নিবেদিত তার কবিতা। তার প্রধান কাব্যগ্রন্থের ভেতর রয়েছেÑ টহশহড়হি ওংষধহফ ও ধফারংব ুড়ঁ ঃড় ফৎরহশ ঃযৎবধফ.

সব নারীই মাতৃত্বের আকাক্সক্ষা করে। পুরুষকে যত অপছন্দ করা হোক না কেন, মা হওয়ার জন্য পুরুষের তো প্রয়োজন। কিন্তু তাই বলে ফুলে ফুলে উড়ে চলা পুরুষকে খুব ভালোবাসতে হবে এমন কোন কথা নেই। নিজের ভেতর যে অস্তিত্বের আবির্ভাব, তা অনেক মূল্যবান। তাকে নিয়েও সুখী হওয়া যায়। নিজের পোশাক যত ম্রিয়মান হোক, পুরোনো জীর্ণ হোক জুতোজোড়া, ধূমপানের জন্য ন্যাতানো বিড়ি, তাতে কী এসে যায়! সুন্দরের আবির্ভাব ঘটবে আর ঝলমল করে উঠবে সমস্ত পৃথিবী। এই সত্য বুকে ধারণ করে কবি গেন্ডারিয়া ফুয়ের্তেস ‘কোনোদিন কিছু পাইনি আমি’ কবিতায় লিখেছেনÑ

আমার ধূসর ঝোলা বরাবর শূন্যই ছিল,/পরার মতো ভালো কোনো পোশাকও ছিল না,/সংবৎসর লেসহীন সেই একই কালো, ন্যাতানো বিড়ি,/অবশ্য আমার তাতে কিছু আসে যায় না।/আমার জিহ্বার নিচে একখ- স্ফটিক আর/নতুন এক সত্তার অস্তিত্ব রয়েছে,/দেখো আমি সেই নতুন সত্তার কথা বলব।

গ্রিস, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক ও স্পেনের নারীবাদী কবিরা শক্তিশালী কণ্ঠে গেয়েছেন মানবতার জয়গান। নারীদের প্রতি ধর্ষণ, অত্যাচার, বৈষম্য প্রভৃতির বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার। নারীদের জেগে ওঠার আহ্বান রয়েছে তাদের কবিতায়। যেসব পুরুষদের জন্য নারীরা অবহেলিত, তাদের বিরুদ্ধে এসব কবির রয়েছে দারুণ ঘৃণা-ক্ষোভ। নারীরা নিষ্পেষিত, নির্যাতিত। এ অবস্থা থেকে তাদের উত্তরণ দরকার। শুধু বসে বসে অশ্রু ফেলা নয়। অশ্রুই যেন হয়ে ওঠে শক্তিশালী বারুদ আর অন্যায়কে প্রতিরোধ করতে পারে যথাযথভাবে। এটাই গ্রিস, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক ও স্পেনের নারীবাদী কবিতাগুলির মূল সুর। মূল ধ্বনি, মূল সুর একাকার হয়ে মিশেছে মনের সত্য সাগরে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist