মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
সুরের সাধক
শিল্পের ক্ষেত্রে যেসব উচ্চমার্গের মাধ্যম আছে, তার মধ্যে সংগীত অন্যতম। বিশেষত, যারা সুর নিয়ে কাজ করেন, কথাকে ধ্বনির মোহনীয় আবেশে ছড়িয়ে দেন বাতাসেÑ তাদের কাজ যে সাধনার ও মানবিক বিদগ্ধজন মাত্রই উপলব্ধি করেন। বিশ্বে এমন সুরকার হাতে গোনা অল্প কজনই আছেন, যারা তাদের কর্মের মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন পৃথিবী, জয় করে নিয়েছেন কোটি সংগীতপ্রিয় মানুষের হৃদয়। বিশ্ব জয় করা এমনি একজন মানুষ সুরের সাধক ইয়োহান জেবাস্টিয়ান বাখ। বাখের কাজ এতটাই শক্তিশালি ছিল যে, পরবর্তীতে অনেকেই তার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। এমনকি, জার্মানির পৃথিবীবিখ্যাত আরেক সংগীতজ্ঞ উলফগ্যাং অ্যামাদিউস মোজার্টও বাখকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
বাখ জন্মেছিলেন ১৬৮৫ সালে জার্মানির আইজেনাখ শহরে। তার মা মারিয়া এলিজাবেটা বাখ। বাবা ইয়োহান আমব্রোসেউস বাখ ছিলেন গির্জার অর্গানবাদক। পারিবারিকভাবেই বাখের পরিবার ছিল সংগীতমনস্ক। পরিবারের সবাই সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং কোনো কোনো সদস্য এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাদের মধ্যে কেউ ছিলেন বেহালাবাদক, অর্গানবাদক, সুরকার আবার কেউ কেউ ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী। তাদের অনেকের জার্মানিতে সুখ্যাতিও ছিল। বাবার কাছে বাখ বেহালাসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখেন। বাখ মাত্র ১০ বছর বয়সের মধ্যেই তার পিতা-মাতাকে হারান। পরবর্তীতে বড় ভাই জোয়ান ক্রিস্টোফার বাখ তাকে সংগীত বিষয়ে শিক্ষা দেন। তিনি বাখকে ক্যালভিককর্ড বাজানোও শেখান। চাচা ক্রিস্টফের কাছে অর্গান শেখেন বাখ। বাখ যাই শিখেছেন, তা-ই মনোযোগ দিয়ে করার চেষ্টা করেছেন। বাল্যকালের এই পারিবারিক শিক্ষাই সংগীত জগতে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে তার জন্যে শক্ত ভিত হিসেবে কাজ করেছে।
শৈশব পরবর্তী জীবনে বাখ সংগীতের পেছনে তার সমস্ত সময় ব্যয় করেছিলেন। তার পেশাগত জীবনের কর্মক্ষেত্রও ছিল সংগীত নিয়ে। ফলে কর্মক্ষেত্রের সুবাদে তিনি সুর নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই সুযোগকে যে বাখ ভালোমতোই কাজে লাগিয়েছেন, এই সময়ে এসে তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। বাখের সংগীত সম্পর্কে বলা হয়, ‘তার কর্মের স্থাপত্যই সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক দিক। খুব সহজ আর স্পষ্ট এর গঠন। তার কম্পোজিশন শোনার সময় এর সূক্ষ্ম মেলোডিক, হারমোনিক এবং রিদমিক্যাল অংশগুলো আলাদা করা যায়, পুরো কম্পোজিশনের অনুভূতিকে অক্ষুণœ রেখেই। এর গঠন খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়।’
কবীর সুমন আনন্দবাজার পত্রিকায় বাখ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বাখ-এর কি-বোর্ড রচনাগুলোতে, এমনকি, বেহালা, ভিয়োলা ও চেলোর রচনাগুলোতেও ছন্দবহুল সুর রচনার নিদর্শন বেশি। দ্রুত লয়েও বাখ এক স্কেল থেকে তার আপেক্ষিক অন্য স্কেলে গেছেন, সেখান থেকে আবার অন্য একটায়। বাখ শোনার মজাটা এইখানেই। কখন যে তিনি সুরের একটি লাইনে চলতে চলতে হঠাৎ? মোচড় দিয়ে অন্য কোনো দিকে যাবেন, কেউ বলতে পারবে না। হঠাৎ? হঠাৎ? গন্তব্যটাই যেন পাল্টে ফেলছেন। শ্রোতার মনে চাপা উত্তেজনা জাগেÑ এই রে, লোকটা ফিরবে কী করে।’ কিন্তু বাখ ঠিকমতোই ফিরতেন। সুরের চমক দিয়েই তিনি শেষ করতেন এবং শ্রোতারা তখনো তার সুরের জগতে থেকে যেত। গবেষকরা মনে করেন, বাখ ‘কাউন্টারপয়েন্ট, ছোট থেকে বড় স্কেলে সুনিয়ন্ত্রিত প্রগমনে’ সিদ্ধহস্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি নতুন কোনো সংগীতের ধারার উদ্ভাবক ছিলেন না। বরং তিনি ইতালি ও ফ্রান্সের সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। ইতালি ও ফ্রান্সের সংগীত উপকরণ তিনি জার্মানির সংগীতাঙ্গনে নিজস্ব নিরীক্ষায় প্রকাশ করেছেন। তার এই নিরীক্ষার মাধ্যমে জার্মান সংগীত নতুন গতি পেয়েছিল এবং সেই গতি এখনো অব্যাহত রয়েছে। এতকিছুর পরও অভিনব করণকৌশল ও নিমগ্ন সাধনার কারণে বাখ সর্বকালের অন্যতম সেরা সুরকার হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
বাখ সুরস্রষ্টা হলেও অর্গান বাজানোর প্রতি তিনি প্রবল আগ্রহী ছিলেন। এ কারণে তার সমকালে তিনি যতটা না সুরকার হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তারচেয়ে বেশি ছিলেন অর্গানবাদক হিসেবে। বিজ্ঞানী হলেও সংগীতরসিক আইনস্টাইন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপকালে একবার বলেছিলেন, ‘প্রকৃত সংগীতের মাহাত্ম্য অনুধাবন করার জন্য অত্যন্ত উঁচু দরের শিল্পের প্রয়োজন।’ বাখ যেই মাপের সুরকার ছিলেন, সেই সময়ে তার ‘উঁচু দরের’ শিল্পকে মূল্যায়ন করার জন্যে যোগ্য কেউ ছিল না। ফলে মৃত্যুর কয়েক দশক পরেও তিনি সুরকার হিসেবে পরিচিতি পাননি। সেই সময়ের মানুষ তাকে সুরকার হিসেবে যথাযথ মূল্যায়ন করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে বাখ নতুন করে সংগীতজ্ঞদের আলোচনায় আসেন। যেই ইয়োহান জেবাস্টিয়ান বাখ সামান্য একজন ‘অপরিচিত দরিদ্র’ অর্গানবাদক হিসেবে মারা গেলেনÑ সেই বাখের সুরসৃষ্টি দেখে পরবর্তীতে প্রাজ্ঞজনরা বিস্মৃত ও অভিভূত হয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে, ঊনবিংশ শতাব্দির শুরু থেকে ক্রমশ বিশ্বে দাবানলের মতো ছড়িয়ে যেতে থাকে বাখের সংগীতকর্ম।
বাখ বলতেন, ‘সুর লেখা হলে আমি এগুলো নিয়ে খেলি, আর ঈশ্বর এটিকে সংগীত করে তোলেন।’ তিনি মনে করতেন, আত্মার পবিত্রতার জন্যে সংগীত হচ্ছে স্রষ্টার সুশৃঙ্খল নেয়ামত। বাখ প্রচুর পরিশ্রম করেছেন, নিজের সুরকে বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছেন। তিনি মনে করতেন, ‘নিরলস কাজ, বিশ্লেষণ, গভীর চিন্তা, প্রচুর লিখন ও অবিরাম আত্মসংশোধন’ হলো তার সংগীত সাধনার বিশেষ দিক। সমকালে তার যথাযথ মূল্যায়ন না হলেও মৃত্যুর কয়েকশো বছর পর বাখ পুনর্জন্ম লাভ করেন। এ প্রাপ্তি বাখ ও বিশ্বের শিল্পরসিকদের জন্যে কম নয়। বর্তমানে বিশ্বের যে কয়েকজন সংগীতকারকে নিয়ে শ্রোতা ও বোদ্ধাদের প্রবল আগ্রহ, বাখ এখনো তাদের কেন্দ্রে আছেন। শিল্পের মধ্য দিয়েই শিল্পীরা বেঁচে থাকেন। ১৭৫০ সালে মৃত্যুর স্বাদ নেওয়া বাখও তার সুরের মধ্য দিয়ে অনন্তকাল আমাদের সঙ্গী হয়ে বেঁচে থাকবেন- এ কথা নিসঙ্কোচে বলা যায়।
"