অলোক আচার্য

  ০২ মার্চ, ২০১৮

শ্রীকান্ত ও দেবদাস চরিত্রের থেকেও জীবন্ত

রবীন্দ্রপর্বের সাহিত্যিকদের মধ্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। শরৎচন্দ্র পাঠ করেননি, এমন শিক্ষিত বা মোটামুটি লেখাপড়া জানা বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ব্যাপারটা এভাবে বলতে পারি, পৃথিবীর যেকোনো বাংলাভাষীর সঙ্গেই শরৎচন্দ্রের পরিচয় হয়েছে; না হয়ে উপায় নেই। এত গল্প, এত উপন্যাস আর এত আণ্ডর্য চরিত্র তিনি তৈরি করেছেনÑ সেইসব চরিত্র বা আখ্যান পাঠ না করে এড়িয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।

রবীন্দ্রনাথের পর নিজস্ব গতিতে লেখা ঔপন্যাসিক হিসেবে শরৎচন্দ্র ছিলেন সর্বাধিক জনপ্রিয়। লেখার সাবলীলতা, সামাজিক সমস্যা আচরণের খুটিনাটি দিক তার লেখায় উঠে এসেছে। লেখায় যেমন এসেছে সমাজ সংস্কারের কথা, তেমনি এসেছে প্রেম-ভালোবাসা, বিরহ-দ্ব›দ্ব। এসেছে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার কথা। দেবদাস উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে এতটা প্রাণবন্তÑ মাঝেমধ্যে মনেই থাকে না এটি একটি উপন্যাস। বাস্তবতার খুব কাছাকাছি বলেই মনে হয়। শুধু বইয়ের পাতায় দেবদাসকে আটকে রাখতে মন চায় না। এটি যেন বাস্তব। দেবদাস যেন সত্যিকারের বিরহী প্রেমিক। আর পার্বতী যেন না পাওয়ার আক্ষেপে বন্দি থাকা নায়িকার নাম। তাই সবকিছু মিলিয়ে দেবদাস অনন্য সৃষ্টি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ চরিত্রহীন, গৃহদাহ, পল্লী সমাজ, দত্তা, শুভদা, শেষ প্রশ্ন, দেনাপাওনা, শেষের পরিচয় ও পণ্ডিতমশাই। রাজনৈতিক উপন্যাস ‘পথের দাবি’; যা ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। বেশির ভাগ উপন্যাসেই সামাজিক দ্ব›দ্ব, পারিবারিক মিল ও কুসংস্কারÑএসব ছিল।

শ্রীকান্ত আমার পড়া কিশোর চরিত্রগুলোর মধ্যে সবথেকে প্রিয় আর রোমাঞ্চ জাগানো চরিত্র। শ্রীকান্তের জীবনের প্রতিটি ঘটনা পাঠকমাত্রই নিজের কিছুটা ছায়া দেখতে পাবে। দুরন্ত, বন্ধুবাৎসল্য, পরোপকারিতা আরো কত গুণ সমন্বিত করা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আমার মনে হয়, পৃথিবীর অনেক কিশোর চরিত্রের ভেতর শ্রীকান্ত অসাধারণ, অনবদ্য এবং মহান মানবিক এক উপন্যাস। কিন্তু বাঙালির বাইরে এই চরিত্রের খুব বেশি পরিচয় ঘটেনি, তার কারণ বোধহয় আমাদের সাহেবপ্রীতিই হবে। চারটি খণ্ডে প্রকাশিত এই উপন্যাসে অনেক চরিত্র, উপ-চরিত্র, আখ্যান, উপ-আখ্যান দিয়ে সাজানো। উপন্যাসটির প্রতিটি চরিত্র বাঙালি পাঠককে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছে, এখনো সমানভাবে করছে। ভবিষ্যতেও করবে। একটা উপন্যাস, উপন্যাসের চরিত্র, আখ্যান একশো বছর পরেও পাঠককে আকর্ষণ করে, ধরে রাখেÑ ঔপন্যাসিকের সৃজন ক্ষমতা কতো প্রবল হলে এটা সম্ভব শ্রীকান্ত পাঠ করে বোঝা যায়।

বহুবছর আগে পড়া শ্রীকান্ত উপন্যাসের একটি সংলাপÑ ‘মরার আবার জাত কী!’ পড়েছিলাম। কিশোর ইন্দ্র আর তার বন্ধু একটি নদীর তীরে যখন দাঁড়িয়ে ছিল, তখনই নদী দিয়ে একটি মৃত মানুষের দেহ ভেসে যাচ্ছিল। তা দেখে শ্রীকান্ত আফসোস করে দেহটির সৎকার করতে চাইলে বন্ধুটি বলে উঠল, কোন জাতের না কোন জাতের লাশ! তা শুনেই শ্রীকান্ত সেই চরম সত্য, নির্মোহ উক্তিটি করেছিল। কী গভীর মানবিকতাবোধ, মানব অনুভ‚তি থাকলেই না এমনটি সম্ভব হয়। এই সহজ-সরল বাক্যটি মানবগোষ্ঠীর পরম আকর। শ্রীকান্ত উপন্যাস প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৭ সালে। দ্বিতীয় খণ্ড ১৯১৮, তৃতীয় খণ্ড হয়েছিল একটু দেরিতে ১৯২৭ এবং শেষ খণ্ড ১৯৩৩ সালে। আজকের সময়ের দিকে তাকিয়ে প্রায় একশো বছর আগে বিশাল আকারের উপন্যাস লিখেছিলেন শরৎচন্দ্র। সেকালে সনাতন ধর্মের ভেতরে জাত-পাতের যে বিষাক্ত বিস্তার ছিল, সেই অন্ধকারকালে একটি উপন্যাসের চরিত্রের মুখ দিয়ে এমন সরল কিন্তু চিরকালের একটি মানবিক বাক্য প্রকাশ করাও ছিল দুঃসাহসের পরিচায়ক।

দেবদাস নামটি নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাস উপন্যাসের কালজয়ী একটি চরিত্র এবং উপন্যাসটির মূল চরিত্র। অন্যতম প্রধান চরিত্রে পার্বতী হিসেবে দেখা যায় নায়িকাকে। শেষ পর্যন্ত দেবদাসের সঙ্গে পার্বতীর মিলন না হওয়া পাঠকের মনকে ব্যথিত করে। তার দেবদাস ছাড়াও আরো অনেক উপন্যাসের চরিত্র সাহিত্যপ্রেমীদের যুগ যুগ মোহিত করে রেখেছে। তবে সব চরিত্র থেকে দেবদাস একটু ভিন্ন, একটু আলাদা। প্রেমের ভুবনে নাম করা শিরি-ফরহাদ, রোমিও-জুলিয়েট আর দেবদাস-পার্বতী। তাই দেবদাস নামটি আর কেবল বইয়ের মলাটে আবদ্ধ থাকেনি। ছড়িয়ে পড়েছে পাঠকের হৃদয়ে। তাতেই লেখকের মূল সার্থকতা। শরৎচন্দ্রের দেবদাস নিয়ে বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তানে অসংখ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। বিশ্বে এমন চরিত্রকে কেন্দ্র করে এতগুলো তৈরি হওয়া সিনেমা খুব বেশি আছে কি?

সিনেমা উপন্যাস যা-ই হোক, বইয়ের পাতার দেবদাস পড়ার প্রশান্তি অন্য জায়গায়। সিনেমা হওয়াতে সুবিধা একটা হয়েছে; তা হলো দেবদাসের অন্তর্জ্বালা সব পাঠকের জন্যই উন্মুক্ত হয়েছে। বইয়ের পাতা থেকে কল্পনায় টেনে আনার ক্ষমতা সব পাঠকের থাকে না। আবার সে ক্ষমতা না থাকলে লেখকের লেখার গভীরতা যাচাই করা যায় না। দেবদাসের সঙ্গে পার্বতীর ভালোবাসার যে চিত্র আঁকা হয়েছে, তা পাঠককুলকে বিমোহিত করবে আজীবন।

আমাদের বাংলা সাহিত্যে মানুষ বরাবরই খুঁজে পেয়েছে তার স্বপ্ন, সম্ভাবনা, ভালোলাগা নানা আবেগ ও অনুভ‚তির জীবনছবি। সাহিত্যের রং জীবনের প্রতিটি ভাঁজে মিশে আছে। বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি শরৎচন্দ্রের দেবদাস দুই বাংলার অসংখ্য মানুষের হৃদয়ের কষ্ট ছোঁয়া আকুতিকে প্রকাশ করেছে ভিন্নভাবে। সেই ভিন্নতা এতটাই ভিন্ন, বাঙালি জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গেছে এই একটি চরিত্র। মিশে গেছে পার্বতীকে না পাওয়ার চির আক্ষেপ। মিশেছে জমিদার পুত্রের প্রেমের আখ্যান। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র দেবদাসের অপ্রত্যাশিত প্রয়াণই বোধকরি দেবদাস উপন্যাসকে জনপ্রিয় করে তুলেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist