মাহবুবুল আলম

  ১৯ জানুয়ারি, ২০১৮

কবি ও কাব্যকলা

আজকাল অনেকেই আমরা যারা টুকটাক কবিতা লিখি তারা নিজেকে কবি বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করি এবং প্রতিনিয়ত কবিতা লিখে যাচ্ছি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমরা কয়জনই বা কবি। একই সঙ্গে আমরা যে প্রতিনিয়ত কবিতা লিখে যাচ্ছি, তার মধ্যে কয়টি কবিতা সত্যিকার অর্থে কবিতা হচ্ছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। যারা প্রতিষ্ঠিত বা সেলিব্রিটি কবি তারা অনেকেই সবার রচিত কবিতাকে কবিতা এবং সবাইকে কবি বলতে নারাজ। এর মধ্যে প্রগতিশীল বা মধ্যপন্থায় বিশ্বাসী লেখক বা কবিদের মত হলো, কে কবি নয় বা কার কবিতা কবিতা হিসেবে স্বীকৃত নয় তা নাকচ করে দিতে রাজি নন। তাদের মত, একজন কবি লিখতে লিখতে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মাধ্যমে কবি হয়ে ওঠেন। এর সঙ্গে যুক্ত আছে স্রষ্টাপ্রদত্ত সৃজনশীলতা ও লেখক সত্তার বিষয়টিÑএই কথাটিও কিন্তু অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আর কার কবিতা কবিতা হলো কিংবা হলো না তা নির্ভরশীল মহাকালের বিচারের ওপর।

তাহলে কবি ও কবিতার সংজ্ঞা কী বলে সে বিষয়ের ওপর একটু আলোকপাত করা যাক। কবি হলো মানবসত্তা আর কবিতা হলো কবি বা লেখকের স্রষ্টা প্রদত্ত আলাদা সত্তা। তা না হলে সব মানুষই কবি বা লেখক হতে পারতেন। তাই মানুষের মধ্যে কেউ কেউ কবি বা লেখকসত্তার অধিকারী। তবে পৃথিবীর সব মানুষ নয়। বাংলা উইকিপিডিয়া কবি সম্বন্ধে যে তথ্য বা সংজ্ঞা দিয়েছে তা এখানে উদ্বৃত্ত করা যেতে পারেÑ‘সেই ব্যক্তি বা সাহিত্যিক যিনি কবিত্ব শক্তির অধিকারী এবং কবিতা রচনা করেন। একজন কবি তার রচিত ও সৃষ্ট মৌলিক কবিতাকে লিখিত বা অলিখিত উভয়ভাবেই প্রকাশ করতে পারেন। একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট, ঘটনাকে রূপকধর্মী ও নান্দনিকতা সহযোগে কবিতা রচিত হয়। কবিতায় সাধারণত বহুবিধ অর্থ বা ভাবপ্রকাশ ঘটানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধারায় বিভাজন ঘটানো হয়। কার্যত যিনি কবিতা লিখেন, তিনিই কবি।’

কবি শব্দটি ‘কু’ ক্রিয়ামূলের বংশে প্রসূত একটি শব্দ। ‘কু’ অর্থ অসাধারণ, নতুনরূপে উত্তীর্ণকারী। এতেই বোঝা যায়, কবি সেই মানুষ যিনি সাধারণ অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি অথবা প্রচলিত শব্দকে নতুনরূপে উত্তীর্ণ করতে সক্ষম। ইংরেজি শব্দ ‘পয়েট’। লাতিন ভাষার প্রথম শব্দরূপ বিশেষ্যবাচক পুংলিঙ্গ ‘পয়েটা’ থেকে সংকলিত হয়েছে। ফরাসি কবি আর্থার রিমবোঁদ ‘কবি’ শব্দের লিখিতভাবে সারাংশ প্রদান করেছেন, তিনি বলেছেন, ‘একজন কবি দর্শনীয় মাধ্যম হিসেবে নিজেকে অন্যের চোখে ফুটিয়ে তোলেন। তিনি একটি দীর্ঘ, সীমাহীন এবং পদ্ধতিবিহীন, অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় সবার দৃষ্টিগ্রাহ্যতার বাইরে অবতীর্ণ হয়ে কবিতা রচনা করেন। সব স্তরের ভালোবাসা, দুঃখ-বেদনা, উন্মত্ততা-উন্মাদনার মধ্যে নিজেকে খুঁজে বেড়ান। তিনি সব ধরনের বিষবাষ্পকে নিঃশেষ করতে পারেন। সেইসঙ্গে পারেন এগুলোর সারাংশকে কবিতা আকারে সংরক্ষণ করতে। অকথ্য দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি অকুণ্ঠ বিশ্বাসবোধ রচনা করেন যখন, যেমন যেখানে খুশি অগ্রসর হন। একজন অতি মানবীয় শক্তিমত্তার সাহায্যে তিনি মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত হন।

কবিতা হলো ভাবুক মানুষের ভাবনাজাত আবেগের এক অন্যরকম তাড়না। এই তাড়নায় যে তাড়িত হয় সে ই হয়ে ওঠেন কবি। এই আবেগের তাড়না যার মধ্যে নেই তিনি যত বড় প-িত এবং জ্ঞানের অধিকারী হোন না কেন তিনি কবি হতে পারেন না। কাব্যের বিষয়বস্তু কাব্যসত্যে ও কাব্য সৌন্দর্যে মানুষের জীবন-জীবিকা এমনভাবে উপস্থাপিত হতে হবে যাতে পাঠক কবির সুগভীর আন্তরিকতা ও বিষয় তন্ময়তা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ প্রকাশ না করে বরং সত্য ও সুন্দরের উপজীব্য বিষয় খুঁজে পান। তাই অল্পকথায় বলা যায়, কবিতা হলো জীবন ও শিল্পের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক অনন্য মূর্তি। তবে বাংলা ভাষার প্রধানতম আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। অর্থাৎ কবিতা লিখলেই বা কবি অভিধাপ্রাপ্ত হলেই কেউ ‘কবি’ হয়ে যান না।

এখানে কীটসের কবিতাবিষয়ক ভাবনার উদ্বৃতি করা যায়। তিনি বলেছেন, ‘সুন্দরই সত্য সত্যই সুন্দর। তাই কবির কাজ হলো এই সত্য ও সুন্দরের সময়কে নিজের ভেতর ধারণ করা বস্তু, বিষয় ও ভাবনার বিষয়কে তার তৃতীয় চোখের মাধ্যমে দেখা ও দৃষ্টিনন্দন ও নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তোলা। কবিতা বিষয়ে শ্রী অরবিন্দ বলেছেন, ‘আধুনিক কাব্যের স্বধর্ম হলো, তার আবেদন বৃদ্ধি নিজের কাছে নয় কল্পনার কাছে। তাই যার কল্পনা সত্য ও সুন্দরের যত কাছে এবং সময়ের দাবিকে ধারণ করতে পারে তিনিই হলেন সার্থক কবি।

কবিতার গঠনশৈলী ও শরীর নির্মাণে একজন কবিকে অধিক মনোযোগী হতে হবে। তাই কবিতা একবারে মূর্ত যেমন হবে না, তেমনি আবার অধিক বিমূর্তও হবে না এবং তা করতে হবে পাঠকের কথা চিন্তা করেই। একজন রমণীকে ঘোমটা পরিয়ে বসিয়ে রাখলে যেমন তার রূপ-সৌন্দর্য থেকে সুন্দরী রমণীকে দেখতে আসা মানুষ বঞ্চিত হয়, তেমনি আবার সাজসজ্জা প্রসাধনে সাজিয়ে উন্মুক্ত করে রাখাও ঠিক নয়। এতে সেই নারীর আকর্ষণ দেখতে আসা মানুষের কাছে একঘেয়েমি ও গতানুগতিক বলেই মনে হবে। এ কথাটি কবিতার বেলায়ও প্রযোজ্য। শব্দচয়ন, উপমা, নান্দনিকতা ও প্রতীকী ব্যঞ্জনা, অনুপ্রাস, শব্দে, সংগীতে আবেগ ও ভাবে কল্পনার বিষয়বৈচিত্র্য, অনুভূতির নিবিড়তায় কবিতাকে সাজিয়ে তুলতে পারার মুন্সিয়ানাই একজন কবি থেকে আর একজন কবিকে আলাদা করে তোলে। একজন কবির কবিতায় জৈবিক, অজৈবিক, দেশ কিংবা প্রকৃতির প্রেম, দ্রোহ ও মানবিকতা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীক বিবিধবৈষম্য, শোষণ ও বঞ্চনার চিত্র প্রকৃতভাবে চিত্রিত না হলে সে কখনো ভালো কবি হতে পারে না। আর জনপ্রিয়তা লাভ সে তো সুদূরপরাহত। সেই অনাদিকাল থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত যুগ-যুগ ধরে তারা তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনাগুলোকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্টি করে চলেছেন নতুন নতুন কবিতা। প্রত্যেক সমাজ-সভ্যতা ও নির্দিষ্ট ভাষায় রচিত হওয়ায় কবিরা বহুমাত্রিক, বিচিত্র ভঙ্গিমা, সৃষ্টিশৈলী প্রয়োগ করেছেন তাদের কবিতায়, যা কালের বিবর্তনে যথেষ্ট পরিবর্তিত, পরিমার্জিত হয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। পরে এই প্রায়োগিক বিষয়াদিই ঠাঁই করে নিয়েছে বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসের পাতায়।

উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ একবার কবিদের কাজ সম্বন্ধে বলেছেন, ‘যে গানের বিষয়বস্তুকে আনন্দের সঙ্গে তুলে ধরা, বাইরে নির্গত হয়ে আমার আত্মাকে ওইদিন পরিশোধিত করবে, যা কখনো ভুলে যাওয়ার মতো বিষয় নয় এবং এখানে লিপিবদ্ধ থাকবে। ম্যারিয়েন মুরে কবিদের কাজ সম্পর্কে বলেছেন, তারা প্রকৃতই সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করেন।’ অন্যান্য অনেক কবি যেমনÑ‘এইনিডে’ ভার্জিল এবং ‘প্যারাডাইজ লস্টে’ জন মিল্টন বর্ণনা করেছেন, ‘গ্রিক পুরাণে বর্ণিত কাব্য ও সংগীতাদির দেবীরা তাদের আবেগিক কর্মকা- প্রয়োগের মাধ্যমে কবিদের কাজে সহায়তা করেন।’

তাহলে কবিতা হলো কবির বেদনা-বিদ্ধ হৃদয়ই হয়ে ওঠে কবিতার ক্যানভাস। অর্থাৎ, সময়-বিশেষে কোনো একটি বিশেষ সূত্রকে অবলম্বন করে কবির আনন্দ-বেদনা যখন প্রকাশের পথ পায়, তখনই কবিতার জন্ম। কবি বেদনাকে আস্বাদ্যমান রস-মূর্তি দান করেন। ব্যক্তিগত আতান্তরের বিষবৃক্ষ থেকে কবি কল্পনার সাহায্যে মধুবৃক্ষে রূপান্তর করতে পারেন, তখন বেদনা পর্যন্ত রূপান্তরিত ও সুন্দর হয়ে ওঠে। বেদনার যিনি ভোক্তা, সে যদি বেদনার আবেগ-অনুভূতিকে নিজের ভেতর ধারণ করতে না পারলে তার দ্বারা কাব্যসৃষ্টি সম্ভব নয়। কবির বেদনা-অনুভূতির এ রূপান্তর-ক্রিয়া সম্বন্ধে ক্রোচে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন এভাবেÑ

চড়বঃরপ রফবধষরংধঃরড়হ রং হড়ঃ ধ ভৎরাড়ষড়ঁং বসনবষষরংযসবহঃ, নঁঃ ধ ঢ়ৎড়ভড়ঁহফ ঢ়বহবঃৎধঃরড়হ রহ ারৎঃঁব ড়ভ যিরপয বি ঢ়ধংং ভৎড়স ঃৎড়ঁনষড়ঁং বসড়ঃরড়হ ঃড় ঃযব ংবৎবহরঃু ড়ভ পড়হঃবসঢ়ষধঃরড়হ.

কাজেই তিনিই কবি যিনি বাইরের জগতের রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দ বা আপন মনের ভাবনা-বেদনা কল্পনাকে অনুভূতি-স্নিগ্ধ ছন্দোবদ্ধ অবয়ব দান করতে পারেন। অনেকে বলেন, যিনি জগতের একখানি যথাযথ স্বাভাবিক চিত্রপট এঁকে দিতে পারেন, তিনিই যথার্থ কবি। অর্থাৎ, কবি জগতের ভালো-মন্দের যথাযথ চিত্র অঙ্কন করবেন। ফুল-পাখি-চাঁদের কথাই শুধু বলেন না, জীবনচলার পথে মানুষের সমস্যার কথাও বলেন। রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় অসামান্যতার কথা, বৈরী আচরণের কথাও বলেন। ভ্রুকুটি করেন শাসক ও শোষকদের।

কবিতা চিরযৌবনা, বহুরূপী। তার আবেদন, রূপ, ভূমিকা অফুরন্ত, অনির্বাণ। বিভিন্ন পাঠক বিভিন্ন আঙ্গিকে একে দেখবেন, গ্রহণ করবেন, আলোচনা করবেন। আর তখনই কবিতা সার্থক হয়ে উঠবে, সার্থক কবিতার স্রষ্টাও হয়ে উঠবেন সার্থক কবি। কবিতা ও কাব্যকলার আলোচনা পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠতে হলে জানতে হবে আগে কবিকে, কবিতার সময়কে, বাস্তবতাকে, কবিতা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে, সমকালীন বিশ্ব প্রেক্ষাপট ও মানবিক দিকগুলোকে। সারকথা, সর্বশ্রেণির পাঠক উপযোগী সৃষ্টিশীলতা। ধর্ম থাকবে, ধর্মে ঔদার্য থাকবে, প্রতিবাদও থাকবে। কবিতায় নান্দনিকতা, পেলবতা শর্তহীনভাবে কাব্যের অঙ্গনে থেকে যাবে, থাকবে কাব্যরসিকের চিন্তা-চেতনাও। ব্যক্তি প্রেম, দেশপ্রেম কবিতায় আধুনিকতার মূলসূত্র। সময়কে নির্ভীকভাবে উচ্চারণ করে আগামীর কাছে পৌঁছে দেওয়াই হলো অনন্য স্বীকৃতি। ফুল, পাখি, চাঁদ, নারী, গাছপালা, আকাশ-বাতাস, গ্রহ-নক্ষত্র, মহাকাল, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস-ঐতিহ্য সবকিছুরই বসবাস কবিতাতে। সকল শ্রেণির পাঠক এমনকি শিশুদের কাছেও পৌঁছে দিতে হবে সাহিত্যরস। সকল সময়ের সকল দেশের সকল শ্রেণির গ্রহণ উপযোগী কবিতা সৃষ্টি হলেই সর্বজনীন কবি হিসেবে স্বীকার করতে কুণ্ঠা থাকা উচিত নয়।

একজন কবি হবেন তৃতীয় নয়নের অধিকারী, সেই নয়নের মাধ্যমেই কবি তার নিজের পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর সূক্ষ্মদৃষ্টিতে দেখে কল্পনা ও বাস্তবতার মিশেলে কবিতার অনুষঙ্গ এবং তার নান্দনিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে কাব্যিক নানাবিদ ব্যঞ্জনায় নির্মাণ করেন কবিতার শরীর। জীবন ও জগতের চরম ও পরম সত্য ও রহস্যকে, সাবলীল ও কাব্যরসময় করে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার ওপরই নির্ভর করে কবিতার পাঠকপ্রিয়তা এবং জনপ্রিয়তা অর্জনের বিষয়টি। পরম সত্যের অন্বেষণ এবং কাব্যিক সৌন্দর্য সৃষ্টিই কবি ও কবিতার উদ্দেশ্য।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist