reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১৯ আগস্ট, ২০১৬

জঙ্গিবাদ

রাজনীতির সংস্কৃতি বিচ্ছিন্নতা

সেলিনা হোসেন

২২ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমরা স্মরণ করেছি। কেউ কেউ বলেছিলেন এই জঙ্গি আক্রান্ত সময়ে রবীন্দ্রনাথকে আমাদের খুব দরকার। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের কোনো সময় নেই। রবীন্দ্রনাথকে দেখতে হবে সেভাবে-‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার তলে/সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।’ এই যে বিনয়, এই যে মানুষের কাছে নতজানু হওয়ার শিক্ষা, এসব যদি আমার থাকে তাহলে রবীন্দ্রনাথের জন্য আমাদের কোনো সময় নেই, রবীন্দ্রনাথ সর্বকালীন সময়ের মানুষ। তার দর্শন আমাদের জীবনে চিরকালীন সত্য। আবার যখন ভালো সময় আসবে তখন অন্য গান গাইব, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে’ অথবা ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার’। এসব গান আমরা যেকোনো সময়ে গাইতে পারি। আজকে আমাদের এখানে যে জঙ্গিবাদের উত্থান হলো, আমাদের ছেলেমেয়েরা যে বিপথগামী হলো, মেয়েরাও হয়েছে বলে দেখলাম পত্রিকার পাতায়। আমি আরো তিন বছর আগে শুনেছি এমন বিষয়। একটি মেয়ের বিষয়ে, তার সাহিত্যে কিছুটা আগ্রহ ছিল, আমাকে বলল, আপা হলের কোনো কোনো মেয়ে আছে যারা আমাদের ওদের দলে নিয়ে যেতে চায়। তখন যে বুঝেছে সে যায়নি। যে মনে করেছে আমি করব না এ কাজটা, তারা যায়নি। যে মনে করেছে ওদের সঙ্গে মিশে ধর্মকে আমি এভাবে দেখব না, ধর্ম তো প্রত্যেকের আত্মার পবিত্র বিশ্বাস। তারা যায়নি। এই বিশ্বাস নিয়ে যে যার ধর্ম পালন করে থাকে। অন্যের ধর্মকে সম্মান করে থাকে। এসব সংকটের সময়েও আমরা রবীন্দ্রনাথের গান পাব : ‘অন্তর মম বিকশিত কর/অন্তর তর হে।’

আমার ধর্মে আছে ‘লাকুমদিনুকুম ওয়ালিয়া দিন’। যার যার ধর্ম তার তার। এত বড় একটা মেসেজ থাকার পরও আমাদের ছেলেগুলো বিপথগামী হলো কেন। হত্যা তো কোনো ধর্মের বিষয় হতে পারে না। এই জায়গাগুলো কেন আমাদের ছেলেমেয়েদের বোঝানো যায় না। এই সময়ে আমার ভাবনার জায়গা এখানে যে, এই ব্যর্থতাকে আমরা কীভাবে অতিক্রম করব। আমরা একসময় মাদ্রাসা শিক্ষাকে দোষারোপ করেছি, ওরা কিছু করে না। করে না এই অর্থে যে, ধর্মীয় দিকেই তাদের শিক্ষাটা চলে যায়। দেশের উৎপাদন, সমাজ উন্নয়নের বিষয়ে এদের ভূমিকা অথবা চিন্তা নেই। তাদের যে কাজটি করতে হবে সেই দায়িত্ববোধের মধ্যেও তারা ঢুকতে পারে না। অন্যদিকে যারা এই দায়িত্ব নেবে বলে আমরা ভেবেছিলাম তারাও তো পারল না। এমনকি শিক্ষকরাও পারল না। এর উৎসটা আমাদের খতিয়ে দেখা দরকার। শুধু সাংস্কৃতিক তৎপরতা দিয়ে এই বিষয়গুলোর সমাধান হবে আমি মনে করি না। এর জন্য পরিবার থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। সমাজ এবং রাষ্ট্রেরও ভূমিকা আছে। তাদের বোধের মধ্যে, চেতনার মধ্যে বিষয়গুলোকে আনতে হবে। যার মধ্য দিয়ে তারা নিজের মেধা কাজে লাগাবে।

পত্রিকার লেখালেখিতে দেখি যে জঙ্গরা প্রযুক্তির জ্ঞানটাকে কাজে লাগিয়েছে। যে ছেলে ইন্টারনেট অথবা প্রযুক্তি পরিচালনায় বেশি দক্ষ তাদের তারা টার্গেট করছে। তারা হলি আর্টিজানে খুন করে তার মেসেজ পাঠিয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে। আমরা অনেকে এসবের কিছু শিখিনি। যে শিক্ষা আমাদের অনেকেরই নেই তা তারা আয়ত্ত করছে। তাদের এসব শিক্ষাকেও ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে হবে। অনেকে সাংস্কৃতিক চিন্তার বিকাশের ওপর জোর দেন। সংস্কৃতি মানে তো কেবল এই নয় যে আমি গান, নাটক করে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করব। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান যা করেছিলেন সেই ইতিহাস জানার প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণে এটা একটা বড় শিক্ষা। তিনি রাজনীতির সঙ্গে সাংস্কৃতিক চেতনা যুক্ত করেছিলেন।

এখানে প্রসঙ্গত বলি, ভারত থেকে আমি একটা ফেলোশিপ পেয়েছি। আমি তাদের একটা বিষয় জমা দিয়েছি, ‘পূর্ববঙ্গ থেকে বাংলাদেশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শেখ মুজিবর রহমান।’ এ বিষয়ে আমার একটা ধারণা ছিল এমন যে, পূর্ব বাংলা থেকে বাংলাদেশ হয়েছে এটা তো ঐতিহাসিক সত্যি। পূর্ববঙ্গ রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন। ১৮৮৯ সালে তিনি শিলাইদহে প্রথম আসেন। তারপর তিনি দশ বছর ছিলেন এই এলাকায়। তিনি লিখেছেন, পৃথিবী যে কত আশ্চর্য সুন্দর এখানে না এলে আমি বুঝতাম না। কলকাতার ওই পথঘাটে থাকলে আমার এখানকার প্রকৃতি চোখে পড়ত না। নিজেকে তিনি কিন্তু একটা শিক্ষার মধ্যে ঢোকালেন। প্রকৃতিকে, মানুষকে চেনার, জনজীবনে দারিদ্র্য দেখার নতুন শিক্ষায় তিনি প্রবেশ করলেন। তিনি ছিন্নপত্রের একটা চিঠিতে লিখেছেন, তিনি যাচ্ছেন পতিসর থেকে নৌকায়। মহিলারা নদীতে স্নান করছে, বাচ্চাদের স্নান করাচ্ছে, কাপড় ধুচ্ছে। তাদের মাথার ওপর ঝুলে আছে গাছের ডাল, সেই ডালে সবুজ রঙের সাপ। নদী পথে যেতে যেতে তিনি এসব দেখছেন। এরপর লিখছেন, মানুষের জীবনে দুর্যোগ তিন রকম। এর একটি হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দ্বিতীয়টি শাসনব্যবস্থা, তৃতীয়টি হলো শাস্ত্র। এই শাস্ত্রের দুর্যোগ তার ধর্মে বেশি ছিল। জাতপাত অথবা ধরাছোঁয়া এসব বিষয় তিনি দেখেছেন। মানুষকে ধর্মের নামে দমন করে রাখার বিষয়গুলো তিনি দেখেছেন। একে তিনি বলছেন শাস্ত্রের দুর্যোগ।

এই রবীন্দ্রনাথকে বঙ্গবন্ধু কীভাবে দেখলেন? সনজিদা খাতুনের স্মৃতিচারণে আছে। ১৯৫৩ সালে শহীদ দিবস উদযাপন হবে আর্মানিটোলা মাঠে। তার ওপর দায়িত্ব পড়েছে মেয়েদের মিছিল নিয়ে যাওয়ার। মসজিদে এবং মন্দিরে প্রার্থনা হবে শহীদদের জন্য। সনজিদা খাতুন আর্মানিটোলা মাঠের কাছে গিয়ে দূর থেকে দেখলেন শেখ মুজিব ফুটপাতে বসে খিরাই কিনে খাচ্ছেন। এরপর তিনি বক্তৃতা করলেন। ভাষার জন্য, অধিকারের প্রশ্নে, পাকিস্তান সরকারের এই অনৈতিক আচরণের বিরুদ্ধেÑসব মিলিয়ে যে বক্তৃতা তিনি করলেন সেদিন তা অসাধারণ। তারপর তিনি ষাটের দশকের পুরোটা সময় যা করেছেন, বিশেষ করে ছয় দফা দেওয়ার পরে যখনই কোনো রাজনৈতিক সভা করতেন তার আগে গান গাওয়াতেন ‘আমার সোনার বাংলা’। এর ব্যাখ্যাটা এভাবে আমি করেছি যে, একজন রাজনীতিবিদ তার সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে গণমানুষের ভেতর ঢোকাচ্ছেন। শুধু বক্তৃতা করে গণমানুষের হৃদয় স্পর্শ করা যাবে না। যখন গাওয়া হচ্ছে ‘আমার সোনার বাংলা’ তখন একজন মানুষ স্বাভাবিকভাবে আপ্লুত হয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষকে তিনি এভাবে উজ্জীবিত করেছেন। এটা খুব সহজ কাজ ছিল না।

আজকের দিনে এভাবে চিন্তা করা হয় না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে যখন তিনি মুক্তি পেলেন। তখন তো রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ, রেডিও-টেলিভিশনে প্রচার হবে না। শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। আয়োজন হয়েছে রেসকোর্সে। সেখানে বক্তৃতার শেষে মুজিব বললেন, আমরা যেভাবে শেকসপিয়র, ভলতেয়ার, মাও সে তুং পড়ি সেভাবে রবীন্দ্রনাথকে পড়ব। শিল্পীদের ডেকে ডেকে শেখ মুজিব কর্মসূচিতে যুক্ত করতেন, সোনার বাংলা গাওয়াতেন। এই গান ছয় দফার পক্ষে জরুরি ছিল। রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির যোগাযোগটা তখন কত প্রবল ছিল তা বোঝা যায়। আজকের দিনে যা আমরা দেখতে পাই না।

অন্যদিকে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের ছেড়ে দিয়েছি, তারা তাদের মতো চিন্তা করতে পারছে না, পারিবারিক সংযোগগুলো সেভাবে কাজ করছে না, কোনো কিছুর অভাব থেকে ঘাটতি থেকে সহিংস ঘটনা ঘটেই চলেছে। এই যে ছেলেমেয়েরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তার কি একবারও মনে পড়ছে না মায়ের কথা, বাবার কথা? একবারও ফোন করে ‘হ্যালো’ বলবে না? কেমন অমানবিক হয়ে পড়ছে তারা। জন্মদাতা বাবা-মায়ের খোঁজ নেওয়াও তো ধর্ম। প্রতিবেশীর সঙ্গে যোগাযোগ না থাকতে পারে, বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকবে না কেন? পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হলি আর্টিজানে ভারতীয় মেয়েটিকে কয়েক টুকরা নাকি তারা করেছে। তাদের ক্রোধটা নারীদের ওপর বেশি কেন? তারা তো গুলি করে মেরেই ফেলেছে আগে। তারপরও এভাবে কোপাল কেন? কেন তাদের এই ক্রোধ। আর আমরাই বা কীভাবে এই ব্যর্থতার জায়গায় চলে এলাম?

আমার বাড়ির আশপাশে কিছু বাচ্চা ছেলে আছে। তারা প্রায় খোঁজ নেয়, ‘দাদু কী লিখছেন?’ আমার বিষয়ে যে তারা এই খোঁজ রাখে তাতে আমি বিস্মিত। আমি ওদের মাঝে মাঝে ডাকি। ঘরে এনে খাওয়াই। তাদের সঙ্গে কথা বলি, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করি। আমি ওদের জিজ্ঞেস করলাম, জঙ্গিরা কি করেছে শুনেছ? ওরা তিনজনই লাফিয়ে উঠে বলল, ‘আমরা কোনো দিন জঙ্গি হব না।’ আমি ওদের এই মেসেজ দেওয়ার জন্য ডেকেছি, দেখলাম যে না ওরা আগে থেকেই মেসেজটা পেয়েছে। পরিবার, স্কুল বা যাদের সঙ্গে খেলে তাদের কাছ থেকে হয়ত তারা এই মেসেজ পেয়েছে। আমি মনে করি, এই দায়িত্ব আমারও। অনেকে এখানে নিষেধ করে ওরা খেলতে পারবে না। ওরা আমার গ্লাস ভাঙে, আমার বাতির শেড ভাঙে, তারপরও আমি কিছু বলি না। আমি বলি, ওদের জায়গা দিতে হবে। ফলে আমাদেরও তো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অবকাশ আছে।

আজকে অনেকেই ঐক্যের কথা বলছে। এখানে ঐক্য গঠনের চেয়ে জরুরি এলাকাভিত্তিক কাজ করা। রাজনৈতিক দলগুলো যার যার এলাকায় কাজ করলেই ঐক্যের এত প্রয়োজন পড়ে না। এক অর্থে তো ঐক্য আছেই। কিন্তু এটা গঠন করতে গিয়ে কালক্ষেপণের চেয়ে এলাকায় এলাকায় কর্মসূচি দেওয়া, কাজ করা জরুরি। তারা তরুণদের কাছে যাবে, অস্ত্র পেলে তাকে ধরিয়ে দেবেÑএটা এখন দরকার। রাজনৈতিক দলগুলো ক্লাব, পাঠাগার গড়ে তুলতে পারে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে পারে।

কিন্তু রাজনীতি আমাদের এখন সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন। অথচ এটা ছিল না স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়। একবার বঙ্গবন্ধু বাংলা একাডেমিতে গিয়েছেন, সেটা ’৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। আমি তখন বাংলা একাডেমিতে কাজ করি। সত্তর সালে সেখানে যোগ দিয়েছি। সেখানে বিদেশি যারা বাংলা ভাষা শিক্ষা করেছে তাদের সনদ দেওয়া হবে। ’৭০ সালের নির্বাচনের পর তো সবাই ধরে নিয়েছেন শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। তিনি বাংলা একাডেমিতে এলেন। অনুষ্ঠানের মাঝেই তাকে কেউ এসে খবর দিলেন যে, জুলফিকার আলি ভুট্টো সংসদে যোগ দেবেন না। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। চোখেমুখে আগুনের রেশ ফুটে ওঠে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হুসনা বানু খানম। বঙ্গবন্ধু তাকে বললেন, আপনি এই গানটি গাইবেনÑ ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/ তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।’ একজন রাজনীতিবিদ যখন সংস্কৃতিকে সঙ্গী করতে পারেন, একজন শিল্পীকে মঞ্চে তুলে আনেন, সেটা শিল্প এবং শিল্পীর জন্য একটা অর্জনও। উপস্থিত জনতা গানের আবেগে আপ্লুত হয়ে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে উঠল। এটি ছিল গণজাগরণের সূত্রের সাংস্কৃতিক দিক। এটা একটা বন্ধনও। এমন দৃশ্য আমরা এখন আর দেখি না। এই বন্ধন ছুটে গেছে। এই বন্ধন সহিংসতা নিরসনে জরুরি।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist