রেজওয়ান শরিফ, টাঙ্গাইল

  ১৫ অক্টোবর, ২০১৯

টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী

কলেজে জাল সনদে শিক্ষক নিয়োগ ও এমপিওভুক্তি

টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার পাঁচপোটল ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক পদে জালিয়াতির মাধ্যমে পদোন্নতি, জাল সার্টিফিকেট দিয়ে এমপিওভুক্তি এবং ভুয়া নিয়োগ বোর্ড সাজিয়ে নিয়োগদানের বিষয়সহ কলেজের নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত পর্যালোচনা করে এসব অনিয়মের সত্যতা পাওয়া গেছে। অভিযোগপত্র, নিয়োগ বোর্ডের রেজ্যুলেশন, তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৯৮ সালের ১৫ মার্চ মো. নজরুল ইসলাম ধনবাড়ী পাঁচপোটল ডিগ্রি কলেজে যোগদান করেন। ২০০৪ সালে এমপিওভুক্তির সময় তিনি শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে মাস্টার্স দ্বিতীয় শ্রেণি উল্লেখ করেন। (এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে মাস্টার্সে দ্বিতীয় শ্রেণি বাধ্যতামূলক)। কিন্তু ১৯৮৭ সালের সনদে তিনি তৃতীয় শ্রেণি প্রাপ্ত হন বলে উল্লেখ রয়েছে। কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ মো. ফেরদৌস আহম্মেদ তার জালিয়াতির বিষয়টি উল্লেখ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ২০০৭ সালের ৪ মার্চ জেলা প্রশাসক বরাবর তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক একই বছরের ১৯ মার্চ ধনবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাশেদুল হাসান তদন্ত শেষে একই বছরের ২১ জুন তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রভাষক মো. নজরুল ইসলামের মাস্টার্সের দ্বিতীয় শ্রেণির সার্টিফিকেটটি জাল বলে শনাক্ত হয়।

এ ছাড়াও পাঁচপোটল গ্রামের দাতা সদস্য প্রয়াত ওয়াজেদ আলীর ছেলে ইমরুল কায়েস কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে আবেদন করলে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ শরিফুল ইসলাম সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) সরেজমিন তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। তদন্তে অধ্যক্ষ আ. রশিদের বিরুদ্ধে শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্য গোপন করে এমপিওভুক্তি, প্রভাষক মো. নজরুল ইসলামের মাস্টার্সের সনদ জাল, কলেজের আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ না করা, অডিট আপত্তির জবাব না দেওয়াসহ কারিগরি শাখায় নিয়োগে অনিয়মের সংশ্লিষ্টতা পায়। তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ৬ এপ্রিল সহকারী পরিচালক (কলেজ-৩) মো. হেলাল উদ্দিন কলেজের অধ্যক্ষ বরাবর দফাওয়ারী জবাব দাখিলের জন্য নির্দেশ দেন।

এদিকে ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর ‘কথিত নিয়োগ বোর্ডের’ স্বাক্ষর অনুযায়ী নাছিমা পারভীন, মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন ও নুরজাহান খাতুনকে সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য ফলাফল প্রকাশিত হলেও এর ঠিক ১৫ দিন পর ১১ ডিসেম্বর কার্যনির্বাহী পরিষদের সভার কার্যবিবরণীতে দেখানো হয় সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের প্রভাষক পদে নাছিমা পারভীনকে, হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে প্রভাষক পদে মো. রফিকুল ইসলামকে এবং গ্রন্থাগারিক পদে শাপলা খাতুনকে নিয়োগের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এমন জালিয়াতির মূল হোতা সেই পুরোনো অভিযুক্ত দুই ব্যক্তি কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রশিদ ও সহকারী অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম বলে অভিযোগ উঠে।

কলেজ পরিচালনা পরিষদের সাবেক সভাপতি মো. জহির উদ্দিন বলেন, ২০১৪ সালে আমি সভাপতি থাকাকালীন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো নিয়োগ পরীক্ষা হয়নি এবং কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অথচ কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ আবদুর রশিদ ও সহকারী অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম আমার স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া নিয়োগ বোর্ড বানিয়ে বিভিন্ন পদে তিনজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সম্প্রতি জালিয়াতির মাধ্যমে অনলাইনে সমাজবিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান ও গ্রন্থাগারিক পদে তিন প্রভাষককে এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করা হয়েছে। তাদের আরো কিছু অনিয়মের বিষয়ে একাধিকবার তদন্ত হয়েছে। ওইসব তদন্তে অনিয়মের সত্যতা মিলেছে। কিন্তু কেন অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তা আমার বোধগম্য নয়। এসব বিষয় স্থানীয় সংসদ সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের গোচরে আনা হয়েছে তিনিও বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার আশ্বাস দেন। সর্বশেষ গত ১৭ জুলাই তাদের এই অনিয়ম তুলে ধরে ব্যবস্থা নিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (ময়মনসিংহ অঞ্চল) বরাবর অভিযোগ দিয়েছি। তারা ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।

কলেজের এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে একাধিক শিক্ষক ও ব্যক্তির সঙ্গে কথা বললে তারা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, এসব বিষয় নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মাঝখান থেকে কলেজের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। সহকারী অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, যাদের স্বার্থে আঘাত লাগে তারাই আমার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালায়। আমি কোনো অনিয়ম করিনি। আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় যে তদন্ত হয়েছে সেগুলোও সমাধান হয়েছে।

কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রশিদ তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আর্থিক দ্বন্দ্বের কারণে এসব অনিয়মের কথা বলা হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে আপোষরফা হয়েছে। তবে নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গেছেন। এ বিষয়ে জানতে কলেজের অ্যাডহক কমিটির বর্তমান সভাপতি এম এ হালিমকে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (ময়মনসিংহ অঞ্চল) উপপরিচালক আবু নুর মুঠোফোনে প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, অনিয়মের বিষয়ে অভিযোগ পেয়ে আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি দিয়ে অবগত করেছি। তারা এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিবে বলে আমাকে জানিয়েছে। আরো কিছু বিষয়ের জন্য আমি সরেজমিন তদন্ত করব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close