আশরাফুল আলম, সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ)

  ২৬ এপ্রিল, ২০১৯

শিল্প-কারখানার পেটে সোনারগাঁয়ের মেঘনা!

ছোট বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কবল থেকে কোনোভাবেই বাঁচানো যাচ্ছে না মেঘনা নদী। বাধাহীনভাবে চলছে ভরাট দখল ও দূষণ। মেঘনার শাখা নদীতীরবর্তী নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার দুধঘাটা ও কোরবান এলাকা গিলে খাচ্ছে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান। এলাকাবাসীর অভিযোগ, দেশের কয়েকটি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান খাসেরচর ও কাদিরনগর নামে দুটি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়েছে, এবার দখল করে নিয়েছে দুধঘাটা ও কোরবানপুর এলাকা। সম্প্রতি স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে নদী দখল ও ভরাট কাজ সাময়িক বন্ধ থাকলেও পুনরায় শুরু হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে নীরবতা পালন করছে বলে দুধঘাটা এলাকাবাসীর অভিযোগ।

উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এবং স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীর সহায়তায় চলছে এই দখল প্রক্রিয়া। বাদ যাচ্ছে না সরকারি খাস সম্পত্তি, সরকারি খাল এবং কৃষকের ফসলি জমি। নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসনের কাছে ঘুরেও কোনো প্রতিকার পায়নি ভুক্তভোগীরা। স্থানীয়রা এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো কয়েক দফায় বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন, সমাবেশ, সড়ক অবরোধ এবং বিভিন্ন দফতরে স্মারকলিপি প্রদান করেছে কিন্তু কোনো ফল হয়নি।

সোনারগাঁ উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, নদী দখলের অভিযোগে মেঘনাঘাট এলাকার মেঘনা গ্রুপের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, মদিনা গ্রুপ, হোলসিম সিমেন্ট কারখানা; বারদী এলাকায় বেঙ্গল সিমেন্ট এবং হাড়িয়া এলাকায় আমান সিমেন্ট, বৈদ্যেরবাজার ঘাট এলাকায় অবস্থিত ইউরো মেরিন শিপ বিল্ডার্স এবং হেরিটেজ পলিমার অ্যান্ড ভেজিটেবলস লিমিটেডকে নদী ও সরকারি স¤পত্তি এবং খাস জমির দখল ছেড়ে দিতে ৩ দিনের সময় বেঁধে দিয়ে চূড়ান্ত নোটিস প্রদান করে সোনারগাঁ উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়। নোটিসের প্রায় ৮ মাস পরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাছাড়া হাজার হাজার একর জমি নদীখেকোদের পক্ষে নামজারি ও জমা ভাগের পূর্ব অনুমতি দিচ্ছে জেলা প্রশাসন এবং নামজারি করে ভূমি উন্নয়ন কর নিচ্ছে সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তার কার্যালয়।

পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য মতে, বাংলাদেশ পরিবেশ আইন অনুযায়ী যেকোনো আবাসন বা বড় উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করে এর অনুমোদন নিতে হয় এবং প্রয়োজন হয় অবস্থানগত ছাড়পত্রের। কিন্তু নদীখেকো শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়াই বালু ভরাট করে নদী ও কৃষকদের জমি জোরপূর্বক দখল করে নিচ্ছে। তবে এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয় কোনো দায়-দায়িত্ব নিতে নারাজ। তারা দায় চাপাচ্ছেন জেলা প্রশাসনের ওপর। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের রিট মামলার আদেশ এবং আদালতের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী নদী তীরবর্তী ৫০ মিটার ভূমিতে বালি ও মাটি ভরাটসহ যেকোনো স্থাপনা নির্মান করা স¤পূর্ণ অবৈধ। নদী তীরবর্তী কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাজ বন্ধে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা মানা হচ্ছে না।

সম্প্রতি বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ও সচিব ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার আকস্মিকভাবে সোনারগাঁয়ে মেঘনা নদীর তীরবর্তী এলাকা পরিদর্শন করে দখলের ভয়াবহতা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে মেঘনা নদীর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক ও ভয়াবহ। এসব দখলদারদের স্থাপনা কয়েক দিনের মধ্যেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা জানান। তিনি এসব দখলদারের তালিকা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানোর কথাও বলেন।

সরেজমিন দেখা যায়, মেঘনা নদীর কিছু অংশে ৫০০ আবার কিছু অংশে ৭০০ ফুট নদী দখল করেছে মেঘনা গ্রুপ। উপজেলার আষাড়িয়ারচর ও ঝাউচর এলাকায় মেনী খালি নদীর অধিকাংশ এলাকা বালু ভরাট করেছে তারা। অপরদিকে, আনন্দবাজার এলাকায় নদীর প্রায় ৫০ একর জমি দখল করে নিয়েছে মেঘনা গ্রুপ। নদীগর্ভের প্রায় ৭০০ ফুট দখলে নিয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করেছে তারা। হাড়িয়া এলাকার আমান সিমেন্ট লিমিটেড মেঘনায় অবৈধ স্থাপনা ও জেডি নির্মাণ করেছে। নদীগর্ভের প্রায় ৭০০ ফুট ভরাট করে পাইলিংয়ের মাধ্যমে দখল করছে। মেঘনার শাখা ঐতিহাসিক সরকারি রান্দীর খালের প্রায় ২ কিলোমিটার বালু দিয়ে ভরাটসহ নদীর প্রায় ১ হাজার ৫০০ বিঘা জমি ভরাট করে চারদিকে সীমানা প্রাচীর দিচ্ছেন।

উপজেলার বৈদ্যেরবাজার ঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আল মোস্তফা গ্রুপের মালিকানাধীন ইউরো মেরিন শিপ বিল্ডার্স ও হেরিটেজ পলিমার অ্যান্ড ভেজিটেবলস লিমিটেড নদীর তীরবর্তী খাস ভূমি এবং সরকারি দুইটি খাল বালু ভরাট করে প্রাচীর নির্মাণ করছে। ভরাটের কবলে পড়ে মেনীখালী নদের উৎস মুখ এরই মধ্যে শুকিয়ে গেছে। ইউরো মেরিন শিপ বিল্ডার্স এবং হেরিটেজ পলিমার অ্যান্ড ভেজিটেবলস লিমিটেডের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের স্থিতি অবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ অমান্য করে বালু ভরাটসহ শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাজ করে যাচ্ছে। নদী দখলের পাশাপাশি ইউরো মেরিন শিপ বিল্ডার্স ও হেরিটেজ পলিমার অ্যান্ড ভেজিটেবলস লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানটির মালিক আল মোস্তফা সড়ক ও জনপদ বিভাগের জমিও দখল করেছে। সড়ক ও জনপদ বিভাগের নোটিস তারা আমলে নেয়নি। বারদী এলাকায় বেঙ্গল সিমেন্ট এবং মেঘনাঘাট এলাকায় মদিনা গ্রুপ নদী তীরবর্তী খাস জমি দখল করে রেখেছে।

বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি কবি জামান ভূইয়া জানান, মেঘনা যেন বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা না হয়। পরিবেশ অধিদফতর, বিআইডব্লিটিএ ও স্থানীয় প্রশাসনকে নদীরক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবেশ অধিদফতর নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. নয়ন মিয়া জানান, সোনারগাঁয়ের কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানেরই পরিবেশ ছাড়পত্র নাই।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিটিএ) নারায়ণগঞ্জ জেলার যুগ্ম পরিচালক গোলজার হোসেন জানান, আমরা এরই মধ্যে নদীখেকোদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে থানায় চিঠি দিয়েছি। আগামী এক মাসের মধ্যে নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে নদী দখল মুক্ত করা হবে।

অনুসন্ধান করে জানা গেছে, পরিবেশ অধিদফতর, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা প্রশাসনের একশ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে শিল্প মালিকদের গভীর সুস¤পর্ক রয়েছে। তাদের প্রত্যক্ষ ও প্ররোক্ষ মদদে প্রকাশ্যে চলছে নদী ডাকাতি।

সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অঞ্জন কুমার সরকার জানান, এরই মধ্যে নদীর সীমানা চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছি। খুব শিগগিরই দখলদারদের আমার কার্যালয়ে ডাকব এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close