এস এম মুকুল

  ০২ জুলাই, ২০২০

মুক্তমত

ঘর থেকেই শুরু হোক দুর্নীতি প্রতিরোধ

ক্যানসারের চেয়েও ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি হলো দুর্নীতি। একজন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাকালে ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি হলে কঠোর শাস্তির কথা ঘোষণা করার পরও তেল, চাল আর নগদ টাকা বিতরণে যে দুর্নীতির খবর বেরিয়ে এসেছে, তাতে জাতির আর আশার জায়গা নেই। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে যথার্থই বলা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি ত্রাণ হিসেবে কাফনের কাপড়ও দিতে যান, তাহলে কতিপয় লোক এই কাফনের কাপড় চুরি করে পাঞ্জাবি বানাবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দুঃখ করেই অকপটে বলে ছিলেন, কৃষক, শ্রমিক দুর্নীতিবাজ না। আমরা শিক্ষিত সমাজের মানুষগুলোই দুর্নীতিবাজ।

দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতি একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। সমাজ থেকে এই ব্যাধিকে হটাতে হলে প্রয়োজন সামাজিক গণজাগরণ। সামাজিক আন্দোলন ছাড়া এই ব্যাধি হটানো যাবে না। আমরা সবাই কথায় কথায় দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারের পদক্ষেপের কথা বলি। এ কথা ঠিক সরকার চাইলে দুর্নীতি কমে যাবে। তবে একেবারে হটানো সম্ভব নয়। সেজন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। নাগরিক সচেতনতা দরকার। নৈতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষা দরকার। সততার মূল্যায়নে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা দরকার। আইনের শাসন বাস্তবায়ন করা দরকার। তার মানে দুর্নীতি নির্মূল করা একটা সামগ্রিক কার্যক্রম বটে। একাকী সরকার এ কাজ করতে পারবে না। মনে রাখতে হবে, দুর্নীতি হলো এক ধরনের প্রবণতা। এই প্রবণতা আগে দূর করা দরকার। যেমন আইন না মানাও এক ধরনের প্রবণতা।

জাপান সরকার তাদের জনগণের জন্য মাঝে মাঝে কিছু নির্দেশনা দেয়। যেমনÑ পাওয়ার সেভ করার জন্য সোম আর বৃহস্পতিবার দেশের জনগণ লিফট ব্যবহার করবে না। দেখা গেছে, জাপানিরা সরকারের পরবর্তী নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত সোম ও বৃহস্পতিবারে লিফট ব্যবহার করছে না। তারা সবাই সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করছে। আবার সরকার যখন বলবে অফিস কিংবা বাসায় এয়ারকুলারের তাপমাত্র ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে স্থির রাখতে হবে। জাপানের জনগণ ঠিক তাই করবে। নিয়মানুবর্তিতা বা সরকারের নির্দেশনা মানার এমন প্রবণতা দেখে সে দেশে অবস্থানকারী এক বাঙালি এক জাপানির কাছে জানতে চাইল, আচ্ছা তোমরা নিয়ম ভাঙ না কেন? তার প্রশ্ন শুনে জাপানি ভদ্রলোক বিস্ময়ে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, কী বলছ, কিছু বুঝতে পারছি না। নিয়ম ভাঙব কেন? নিয়ম তো তৈরিই করা হয় মানার জন্য। এই হলো বাঙালি আর জাপানিদের প্রবণতার ব্যবধান। আমরা বাঙালিরা নিয়ম ভাঙতেই বেশি পছন্দ করি। দশ হাত দূরত্বের মধ্যে একটি ফুটওভারব্রিজ আর একটি আন্ডারপাস থাকা সত্ত্বেও বাঙালিরা দৌড় দিয়ে রাস্তা পারাপার হয়। আমরা আইনের কথা বলি, কিন্তু নিজেরা আইন মানি না। আইনের কঠোর শাসনের কথা বলি। দেখা গেছে, করোনাকালে পাবলিক অযথা ঘর থেকে বের হওয়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দুয়েকজনকে কানধরে ওঠবস করিয়েছেন বা লাঠিপেটা করেছেন। আর ফেসবুকে এ নিয়ে তুলকালাম প্রতিবাদে সোচ্চার নিয়ম ভঙ্গকারী বাঙালিরা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে পরিচালিত অভিযানে অনেক ভয়ংকর, লজ্জাস্কর তথ্য বেরিয়ে এসেছিল। বনরক্ষক ওসমান গণির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে, যার ঘরে বালিশের ভেতর, চালের ড্রামের ভেতর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাওয়া গিয়েছিল। তখনকার সরকারের উপদেষ্টারা বলেছিলেন, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চাইলে পুরো দেশটাকেই কারাগার ঘোষণা করতে হবে। আমরা খুব বাহবা দিয়েছিলাম। কিন্তু সেসময়ে দুর্নীতিমুক্তকরণের অভিযানকারীদের অনেকে দুর্নীতি করে আখের গুছিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ আছে। তাহলে কী করে দুর্নীতিমুক্ত হবে বাংলাদেশ, সেটাই ভাবার বিষয়।

আমাদের কাছে সুন্দর যুক্তি আছে, বাবাই সন্তানের কাছে সেরা। ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজরাও ভালো বাবা। কিন্তু এমন কিছু বাবার কারণে বাকিরা চিকিৎসা পান না, গরিবরা চাকরি পান না, রাস্তায় পানি জমে থাকে, গরিব মানুষ ত্রাণের টাকা পান না। প্রশ্ন হলো, এ রকম বাবা ও তার সন্তানদের সংখ্যা যদি ক্রমশ বাড়তে থাকে; তাহলে দেশ কোথায় যাবে, ভেবে দেখা দরকার। প্রশ্ন হলো, সন্তান কিংবা স্ত্রী, পিতা কিংবা স্বামী কি একে অপরের আয়ের বৈধতা জানার চেষ্টা করেন। তারা কি অনুসন্ধান করেন যে, কোন পদে চাকরির বেতন স্কেল কত। আয় কত হওয়ার কথা। তাদের জীবনযাপনের ব্যয়ের সঙ্গে, সম্পদের সঙ্গে সেই আয়ের সামঞ্জস্য আছে কি। ভেবেছেন কি কখনো, আপনার স্বজনের দুর্নীতির কারণে কত শত, হাজারজন অধিকারবঞ্চিত হচ্ছে। তাহলে কোন মুখে নিজেরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন। আশ্চর্যকরভাবে দেখছি, ফেসবুকে ঘুষখোর মানুষটিও যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দেয়; তখন তার বিবেক কি কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাহলে কীভাবে দুর্নীতি নির্মূল হবে।

দুর্নীতিবাজ আসলে কারা, তারা তো এ সমাজেরই মানুষ। কারো বাবা, ভাই, স্বামী, স্ত্রী, সন্তান, মামা, চাচা, খালু, ফুফা এরাই তো। খোঁজে দেখুন কারা দুর্নীতিবাজ। কারা অসৎ, অবৈধ উপায়ে বিত্তবৈভব গড়ে তুলেছেন। দুর্নীতি ঠেকাতে পৃথিবীর নানা দেশেই হরেকরকম পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, কঠোর আইন কিংবা বিচার এর মধ্যে অন্যতম। এরই পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর নজরদারিও গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতি ঠেকাতে অভিনব এক প্রচেষ্টা নিয়েছে মস্কোর নগর সরকার। এজন্য তারা ব্যবহার করছে এক ধরনের কৌতুকের বই। বইটির নাম ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই’। ঘুষ নেওয়াকে নিরুৎসাহিত করতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এই বই পড়ানো হচ্ছে। বইটিতে অনেক ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, যার মূল কথা ঘুষ কিংবা দুর্নীতির বিরুদ্ধে। ব্যবহার করা হয়েছে ছোট ছোট গল্প এবং উক্তি। মস্কো সিটি ইউনিভার্সিটি এই ছবিগুলো তৈরি করেছে। ২০০৪ সালে রিপাবলিক অব জর্জিয়ায় প্রায় ৩০ হাজার ট্রাফিক পুলিশ সদস্যকে দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত করা হয়। বলতে গেলে দেশটির গোটা ট্রাফিক পুলিশ বাহিনীকেই চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল! সে বছরই পুলিশ বাহিনীতে স্বচ্ছতা আনতে দেশটির সরকার প্রতীকী হিসেবে কাচের তৈরি পুলিশ স্টেশন তৈরি করে। এরপর থেকেই জর্জিয়ায় অপরাধপ্রবণতার হার লক্ষণীয়ভাবে কমতে থাকে এবং পুলিশের প্রতি জনগণের হারানো আস্থা ফিরে আসতে থাকে। আবার সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি রুখতে চীনে সব সরকারি কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়মিত ভিত্তিতে জেলখানা ভ্রমণ করানো হয়! এ কাজের উদ্দেশ্য হলো, দুর্নীতি করলে কপালে কী লেখা আছে, তা স্বচক্ষে দেখিয়ে আনা। পাশাপাশি আগের যত সরকারি কর্মকর্তা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে কারাবাস করছেন, তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং সাক্ষাতে কারাবাসী সরকারি কর্মকর্তারা তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। যৌক্তিক কারণেই প্রিয় বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে অভিনব উদ্যোগ নিতে হবে এখনই।

লেখক : সাংবাদিক ও উন্নয়ন গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close