ইসমাইল মাহমুদ

  ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯

নুপিলান দিবস

মণিপুরি নারী বিদ্রোহের ইতিকথা

মণিপুরি সম্প্রদায়ের প্রধান দুটি অনুষ্ঠান হলো ‘মহারাস উৎসব’ এবং ‘নুপিলান দিবস’। প্রতি বছর দামোদর মাসখ্যাত কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে ‘মহারাস উৎসব’ এবং ১২ ডিসেম্বর ‘নুপিলান দিবস’ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। মণিপুরিদের দুটি প্রধান অনুষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম ‘নুপিলান’ বা নারী বিদ্রোহ দিবস আগামীকাল ১২ ডিসেম্বর সিলেট বিভাগের সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলার মণিপুরি পাড়াগুলোতে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। প্রতি বছরের মতো এবারও মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার রামনগরস্থ মণিপুরিপাড়ায় সিলেট বিভাগের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। এবারের নুপিলান দিবস ৮০তম।

নুপিলান বা মণিপুরি নারী বিদ্রোহ দিবসের ইতিহাস সম্পর্কে মণিপুরি তথ্য-উপাত্ত থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, মণিপুরি সম্প্রদায়ের প্রথম নারী আন্দোলন সংগঠিত হয় ১৯০৪ সালে। ওই বছরের ১৫ মার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ড পলিটিক্যাল এজেন্টের বাংলোতে কে বা কারা আগুন লাগিয়ে দেয়। একই বছরের ৪ আগস্ট পুনরায় রহস্যজনক অগ্নিকান্ডে ভস্মীভূত হয় ওই একই বাংলো। এ অবস্থায় পলিটিক্যাল এজেন্ট বাংলোর আশপাশের চারটি মণিপুরি গ্রামের পুরুষপ্রধানকে তাদের নিজস্ব সম্পদ দিয়ে বাংলোটি পুনর্নির্মাণ করে দেওয়ার নির্দেশ জারি করে। এ ছাড়া ওই মণিপুরি গ্রামগুলোর প্রধানরা কায়িক শ্রম করতে হবে বাধ্যতামূলক নির্দেশ জারি করা হয়। মণিপুরি সমাজের প্রচলিত প্রথা হলো ব্রাহ্মণ এবং রাজবংশের লোকেরা কোনো কায়িক শ্রমে অংশ নেবেন না। কিন্তু ব্রিটিশ কর্মকর্তার ওই আদেশে মণিপুরি সমাজের পুরুষ প্রধানদের কায়িক শ্রমে বাধ্য করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। ফলে মণিপুরি সমাজে এ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভের দাবানল। ওই বছরের ২ অক্টোবর মণিপুরি নারীরা প্রথমে আন্দোলনে নামেন। মণিপুরি মহিলা নেত্রী শামুহাওবী দেবী, মনিহাও মা প্রমুখদের নেতৃত্বে নারীরা মিছিল বের করেন এ অন্যায় আদেশ প্রত্যাহারে ব্রিটিশ সরকারের কাছে দাবি জানান। পরে মণিপুরি নারীদের যৌক্তিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন মেগাজিৎ সিংহ, কালা সিংহ, চাওবা সিংহ, মুতুম সিংহ, চমু সিংহ প্রমুখ মণিপুরি পুরুষ। এ আন্দোলন করার কারণে ব্রিটিশ সরকার ৭ নারী ও ৫ পুরুষকে বন্দি করে। ফলে আন্দোলন আরো তীব্র হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ সরকার। বাধ্যতামূলক কায়িক শ্রম থেকে ব্রাহ্মণ ও রাজবংশের লোকদের বাদ দেওয়া হয়। মণিপুরি নারীরা সম্মিলিতভাবে আন্দোলন পরিচালনা করে প্রথম নারী বিজয় লাভ করেন।

এর ঠিক ৩৫ বছর পর সংগঠিত হয় দ্বিতীয় নারী বিদ্রোহ। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের মণিপুরে যখন চরম খাদ্যাভাব, তখন তৎকালীন শাসকরা যুদ্ধরত সৈনিকদের জন্য মণিপুর থেকে ধান ও চাল পাঠানো শুরু করে। এ অবস্থায় মণিপুর রাজ্যে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় চরমভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে মণিপুরি প্রজাবৃন্দ। সে প্রেক্ষাপটে ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নারী সমাবেশ ও দরবার ঘেরাও কর্মসূচি। মণিপুরি নারী সমাজ সেøাগানে সেøাগানে দরবার হলের উন্মুক্ত মাঠে অবস্থান নেয়। এখানে সমাবেশ করেন তারা। পরে মণিপুরি নারীরা দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যান দরবার অভিমুখে এবং দরবার ঘেরাও করে তাদের দাবিনামা দরবার প্রেসিডেন্টের কাছে পেশ করেন। মণিপুরি নারীরা তাদের দাবিনামায় মণিপুর থেকে ধান-চাল পাঠানো বন্ধ করতে চাপ সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় স্টেট দরবারের প্রেসিডেন্ট মি টি এ সার্প আন্দোলনকারী নারীদের জানায়, মণিপুরের মহারাজ স্যার চূড়াচান্দ সিংহের অনুমোদন ছাড়া তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে না। সেসময় মণিপুরের মহারাজ স্যার চূড়াচান্দ সিংহ নবদ্বীপ ধামে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু মণিপুরি নারীরা এ অজুহাত মেনে নিতে রাজি না হয়ে জোরপূর্বক স্টেট দরবারের প্রেসিডেন্ট মি টি এ সার্পকে ধরে নিয়ে যায় টেলিগ্রাফ অফিসে। সেখান থেকে মি সার্প ধান-চাল বাইরে না পাঠানোর অনুমোদন চেয়ে মহারাজ স্যার চূড়াচান্দ সিংহের কাছে রিটার্ন টেলিগ্রাম পাঠান। টেলিগ্রাম পাঠানোর পর মি সার্প তার বাসভবনে ফিরে যেতে উদ্যত হলে মণিপুরি নারীরা টেলিগ্রামের জবাব না আসা পর্যন্ত তাকে কোথাও যেতে দিতে রাজি নয় বলে জানায়। তারা মি টি এ সার্পকে টেলিগ্রাফ অফিসে আটকে রাখে। দ্রুত খবরটি ছড়িয়ে পড়লে তাকে মণিপুরি নারীদের হাত থেকে উদ্ধারে চতুর্থ আসাম রাইফেলসের কমান্ড্যান্ট মেজর বুলফিল্ডের নেতৃত্বে এক প্লাটুন সৈন্য টেলিগ্রাফ অফিসে এসে প্রচেষ্টা চালায়। মণিপুরি নারীরাও তাকে ছাড়তে রাজি নন। এ অবস্থায় শুরু হয় সংঘাত। দুই দিন ধরে অভুক্ত মণিপুরি নারীরা ‘তেম’ (কাপড় বুননের সময় ব্যবহৃত কাঠের তৈরি একদিক ঈষৎ ধারালো এক ধরনের দন্ড) হাতে সৈন্যদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা চালায়। সৈন্যদের বন্দুকের আঘাতে এ স্থানে মণিপুরি নারীদের অনেকেই আহত হন। এদের অনেককেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়। টেলিগ্রাফ অফিস থেকে শীর্ষ মণিপুরি নারী নেত্রীদের ১০ জনকে বন্দি করা হয়। এ অবস্থায়ও অসম সাহসী মণিপুরি নারীরা পিছু হটে যাননি। টেলিগ্রাফ অফিসে আটকে রাখেন মি সার্পকে। পরদিন ১৩ ডিসেম্বর মহারাজ স্যার চূড়াচান্দ সিংহের কাছ থেকে টেলিগ্রাম আসে। টেলিগ্রামে মহারাজ মণিপুর থেকে ধান-চাল অন্যত্র পাঠানো বন্ধ করার ঘোষণা প্রদান করেন। এরপর মি সার্পকে মুক্তি দিয়ে আন্দোলনকারী মণিপুরি নারীরা নিজ নিজ বাসভবনে ফিরে যান। এ আন্দোলনে যেসব মণিপুরি নারী সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন তারা হলেনÑ খোংনাং দেবী, তোঙ্গৌ দেবী, মুখী দেবী, কুমারী দেবী, অমুবী দেবী, লৈপাকলৈ দেবী, কাবী দেবী, ইবেমহল দেবী, রজনী দেবী, সানাতোম্বী দেবী, চাওবীতোন দেবী, অশংবী দেবী, তিংগোং দেবী, কবোকলৈ দেবী, পিশক দেবী প্রমুখ।

মণিপুরি নারীদের দ্বারা সংগঠিত দ্বিতীয় বিদ্রোহ বৃহৎ নারী বিদ্রোহ হওয়ায় এ দিবসটিকে মণিপুরি সমাজ ‘নারী বিদ্রোহ’ বা ‘নুপিলান দিবস’ হিসেবে প্রতি বছর পালন করে আসছে। প্রথম নারী বিদ্রোহ দিবসটিও মণিপুরিরা পালন করে। তবে তা বৃহৎ পরিসরে নয়। এদিনটি স্বল্প পরিসরে শুধু আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই পালিত হয়।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close