নিতাই চন্দ্র রায়

  ০১ নভেম্বর, ২০১৯

মুক্তমত

উইপোকা দমনে শুদ্ধি অভিযান

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, আমার কৃষক দুর্নীতি করে না। শ্রমিক দুর্নীতি করে না। দুর্নীতি করে শিক্ষিত লোকেরা। তিনি আরো বলেছেন, ‘দেশ থেকে সব অন্যায়-অবিচার ও শোষণ উচ্ছেদ করার জন্য দরকার হলে আমার জীবন উৎসর্গ করব।’ বঙ্গবন্ধু তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। তিনি বেশ কয়েকবার চীন ভ্রমণ করেছেন। নিজ চোখে দেখেছেন, চীনের মহান বিপ্লবী নেতা মাও সেতুংয়ের নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করে চীন কীভাবে দ্রুত উন্নতির শিখরে আরোহণ করে। গত ৬৮ বছরে চীনে যে উন্নয়ন হয়েছে পৃথিবীর কোনো দেশেই তা হয়নি। চীনের উন্নয়নে অন্তর্নিহিত কারণ ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণ এবং কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের ন্যায়সংগত অধিকার প্রতিষ্ঠা। মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক সাফল্যের মূলে ছিল ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন রোধ এবং মাহাথির মোহাম্মদের অর্থনৈতিক নীতি। বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। সিঙ্গাপুরের অভূতপূর্ব উন্নয়নের কারণও ছিল লি কুয়ান ইউয়ের দূরদর্শী নেতৃত্ব ও তার নীতি ও আদর্শ। ১৯৬৫ সালে মালয় ফেডারেশন থেকে বেরিয়ে আসার সময় জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, এ রাষ্ট্রের মূলনীতি হবে স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, জনকল্যাণ, সমৃদ্ধি ও সাম্য। সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক বলেছেন, ‘মাত্র ৩০ বছরে একটি দারিদ্র্যপীড়িত দেশের জনগোষ্ঠীকে জীবনযাপনের সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। লি কুয়ান পেরেছেন তার চতুর্দিকে মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জড়ো করে একটি কার্যকর সরকার পরিচালনায় তাদের অঙ্গীভূত করতে।’

উইপোকা আখ ফসলের বড় শত্রু। শুধু আখ নয়; কাঠের আসবাবপত্র, চেয়ার-টেবিল, অফিসের ফাইলপত্র এমনকি ঘরের ঘুঁটি খেয়ে নষ্ট করে ফেলে। উইপোকা মাটির নিচে ঢিবি তৈরি করে বসবাস করে। এরা সমাজবদ্ধ জীব। রানি, পুরুষ, সৈনিক ও শ্রমিকÑ এই চার শ্রেণিতে বিভক্ত এবং তাদের কাজও ভিন্ন ভিন্ন। শ্রমিক উই ফসলের ক্ষতি করে। ঢিবি তৈরি করে। আখ রোপণের পর উই রোপণকৃত আখের চোখ খেয়ে ফেলে। ফলে আখ গজাতে পারে না। গজালেও আখের কচি চারা খেয়ে নষ্ট করে দেয়। আক্রান্ত চারা শুকিয়ে মারা যায়। দাঁড়ানো অবস্থায় এরা আখের মূল শেকড় ও কান্ড খেয়ে ক্ষতিসাধন করে। শুধু আখ নয়; গম, ভুট্টা ও চা ফসলেরও প্রভূত ক্ষতি করে উইপোকা। দেশের উন্নয়নকে ফসলের খেতের সঙ্গে তুলনা করা হলে, জঙ্গি, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী, ঘুষখোর, জুয়াখোর, ক্যাসিনো ব্যবসায়ী, মদখোর, দুর্নীতিবাজ, বিদেশে অর্থ পাচারকারী, ঋণখেলাপি, নদী দখলকারী, ধর্ষক, অপহরণকারী, নারী নির্যাতনকারী খুনি, হত্যাকারী, খাদ্যে ভেজালকারী, টেন্ডারবাজ, অসৎ রাজনীতিবিদ, জনগণকে হয়রানিকারী আমলা এবং অবৈধ সম্পদের মালিকÑ এরা সবাই উইপোকা। এসব উইপোকাই আমাদের উন্নয়নের আখ, গম, ভুট্টাখেত খেয়ে শেষ করে ফেলছে। ঘুষ ও দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণে প্রতিবেশী দেশের তুলনায় বেশি খরচ হচ্ছে। কাজের গুণমান হচ্ছে নিম্ন মানের। জনগণ কাক্সিক্ষত সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকার সামাজিক সুরক্ষা খাতে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতার মতো কাজগুলোও একশ্রেণির আমলা ও অসৎ স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের কারণে ব্যাহত হচ্ছে। কৃষকের কাছ থেকে সরকারি গুদামে ধান কেনার মতো কাজও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যাচ্ছে না একশ্রেণির অসৎ স্থানীয় নেতা এবং খাদ্যগুদামের দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের কারণে। ফলে খাদ্য উৎপাদনকারী অন্নদাতা কৃষকের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে দরুণভাবে। কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণে ছাত্রলীগ নেতাদের চাঁদাবাজি প্রধানমন্ত্রীকে দারুণভাবে মর্মাহত করে। তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। ছাত্রলীগের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম। সম্প্রতি বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার আহমেদ ফাহাদকে ছাত্রলীগ নামধারী নেতাকর্মীরা নৃশংসভাবে হত্যা করে। এতে সারা দেশের মানুষের মনে বিক্ষোভের আগুন জ্বলছে। প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এ হত্যার সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ও সভাবেশ করছেন সচেতন শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন বুয়েটের শিক্ষক সমিতি ও বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবরারের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, এ নৃশংসতা কেন? এই জঘন্য কাজ কেন? এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। কীসের ছাত্রলীগ, আমার কাছে অপরাধী অপরাধীই। যত রকমের উচ্চ শাস্তি আছে, সেটা দেওয়া হবে।

গত ১০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে লাশ হয়েছেন ২৪ জন শিক্ষার্থী। এসব হত্যাকান্ডের ১৭টি ঘটনা ঘটেছে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে। বিশ্লেষকরা বলছেন, লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, নেতাকর্মীদের আধিপত্য বিস্তার, নীতি ও আদর্শহীনতা, মূল্যবোধের অভাব, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির কারণে মূলত এসব হত্যাকান্ড ঘটেছে। ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলে নাজমুল হক কোহিনুর, মো. ইদ্রিস, রেজওয়ানুর রব, সৈয়দ মাসুদ মাহমুদ, বশির উদ্দিন আহমদ ( জিন্নাহ), আবুল হোসেন, এবাদ খানÑ এই সাতজন ছাত্রকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকান্ডে তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান সরাসরি জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আমলেই বিচারে তার মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ’৭৫-এর পর তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়নি। জিয়া সরকারের আমলে তাকে বিএনপিতে যোগদানের শর্তে ক্ষমা ঘোষণা করে মুক্তি দেওয়া হয়। বাংলাদেশে ছাত্র হত্যার মতো জঘন্য অপরাধের বিচারহীনতার সংস্কৃতি তখন থেকেই শুরু হয়।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশে মদ, জুয়া খেলা বন্ধ করেন। সেই দেশেই তার দলের যুবদলের নেতারা কোন সাহসে ক্যাসিনো খেলার ব্যবসা বসায় রাজধানী ঢাকার ক্লাবগুলোতে? শুধু ক্যাসিনো নয়, এসব নেতা মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, নারী ধর্ষণসহ নানা অসামাজিত কাজে জড়িত হয়ে দলের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছেন দারুণভাবে। এরা দলের কর্মী নয়; শক্তি নয়; সর্বনাশের হাতিয়ার। এদের আছে অবৈধ অস্ত্র ও গানম্যান। আছে বিদেশে বাড়ি। দেশে আছে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ। আয়ের সঙ্গে ব্যয় ও জীবনযাপনের কোনো মিল নেই। এসব অন্যায়-অবিচার শোষণ ও বঞ্চনার কারণে সমাজের মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে বিরাট অর্থনৈতিক বৈষম্য। পাহাড় প্রমাণ পার্থক্য। রাজধানীতে ২০ তলা ভবনের পাশে উঠছে পলিথিনের ছাউনিযুক্ত বস্তিঘর। বৈষম্যের কারণে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে হতাশা, ক্ষোভ ও অভিমান। নতুন প্রজন্ম হচ্ছে বিভ্রান্ত। মূল্যবোধ ও সামাজিক বন্ধন বিনষ্ট হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা তৈরির পথে প্রচন্ড প্রতিবন্ধকতা। ২০৩০ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে পথনকশা জননেত্রী শেখ হাসিনা তৈরি করেছেন তা ব্যাহত হচ্ছে এসব উইপোকাদের উন্নয়ন বিধ্বংসী অপকর্মের কারণে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ ছিল গরিব কৃষক, শ্রমিক, পুলিশ, বিডিআর, সাধারণ সৈনিক ও ছাত্র-জনতাসহ লাখ লাখ মেহনতি মানুষ। এসব দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হলে সমাজের অনিষ্ট সৃষ্টিকারী অসৎ আমলা, রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের দমন করতে হবে কঠোর হস্তে। সেই দমন অভিযানেই হাত দিয়েছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যুবলীগের চেয়ারম্যানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সিজ করা হয়েছে। বিদেশে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিছু অপরাধী ইতোমধ্যে গা ঢাকা দিয়েছে। কিন্তু এখনো সারা দেশে থেকে মাদক ব্যবসায়ী , চাঁদাবাজ , দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, অস্ত্রধারী ও জঙ্গিদের সমূলে উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। তারা উইপোকার মতো মাটির ঢিবিতে লুকিয়ে আছে। এদের অপকর্ম থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে সমন্বিত দমন পদ্ধতি প্রয়োগ করে উইপোকা সমূলে ধ্বংস করতে হবে। তা হলে দেশের উন্নয়ন দৃশ্যমান হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে এবং জাতির জনকের সোনার বাংলার স্বপ্ন প্রকৃতপক্ষেই বাস্তবায়িত হবে। এটাই আজ জনগণের প্রত্যাশা ও দেশপ্রেমিক মানুষের মনের কথা।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লি., নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close