ইয়াসমীন রীমা

  ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

পর্যলোচনা

প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে তাঁতে

তাঁতশিল্প বাংলাদেশে গ্রামীণ ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য এবং উজ্জ্বলতম অংশ। এ শিল্পে জড়িত রয়েছে দেশের বৃহত্তম একটি জনগোষ্ঠী। একসময়ে এ পেশাটিতে সনাতন ধর্ম অবলম্বনকারী সম্প্রদায়রাই বেশি সংপৃক্ত ছিল এবং নিয়মিতভাবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ অবধি পর্যন্ত পেশাটি সুনামের সঙ্গে চালু রেখেছিল। আর তাদের বলা হতো আশ্বিনী তাঁতি। তাছাড়া ধীরে ধীরে এসব পেশাজীবীর বিভিন্ন নাম বা গোত্র সংযোগ করা হয় যেমনÑ বারাশ, বসাক, নন্দী, পাল প্রামাণিক, সাধু, সরকার, শীল ইত্যাদি। ১৯২০ সালের প্রথমদিকে গ্রামাঞ্চল থেকে জেলা শহরগুলোতে তাঁতিদের থেকে ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির একদল তাঁতি পূর্ববঙ্গে এসে বসতি গড়ে। এই তাঁতিরাই আসল তাঁতি বংশোদ্ভূত বলে গণ্য করা হয়। পরবর্তীকালে মুসলিম ধর্মাবলম্বীরাও এ পেশায় নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে কারিগর হিসেবে পরিচিত হতে পছন্দ করতে শুরু করে।

প্রযুক্তির বিকাশ যখন তাঁতিদের জীবনধারণের দ্বিতীয় উপায় হিসেবে অন্য পেশা গ্রহণে এবং এ পেশা পরিত্যাগে বাধ্য করছে; তখনো কারিগরপাড়ার মানুষগুলো এর ওপরই জীবিকা নির্বাহ করছে। দিন দিন মানুষ যেখানে উন্নতির মুখ দেখে, সেখানে এ পেশাজীবী মানুষ অগ্রগামী নন। যদিও দিন দিন তাঁতের সংখ্যা বাড়ছে অবিশ্বাস্য হারে। কিন্তু জীবনযাত্রার মান রয়েছে আগের অবস্থানে। তাঁতশিল্পের সেই হারিয়ে যাওয়া গৌরব পুনরুদ্ধারে সরকার কতটা যতœবান, সেই হিসেবে না গিয়ে বরগুনা জেলার বঙ্গোপসাগরের তীরে তালতলীর রাখাইন আদিবাসীরা ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই তাঁতের খটখটাখট শব্দে ছন্দময় করে তোলে প্রতিটি পাড়া। সাড়া ফেলে দেয় পাড়ায় পাড়ায়। কাপড় বোনার ধুম পড়ে যায়। প্রধানত রাখাইন নারীরাই ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এসব কাপড় বুনে থাকে। রঙবেরঙের এসব কাপড় বোনা সম্পন্ন হলে দেশের বিভিন্ন স্থানের বাজারগুলোতে পাঠানো হয় বিক্রির জন্য। আর বিপণনের কর্মটিও রাখাইন নারীরাই সম্পাদন করে থাকে। তবে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা সেই তাঁতে এখন লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া এবং যথারীতি সুফলও আসছে। একসময় নিজেদের দরকারের কাপড়ের সংস্থান তারা নিজেরাই করত। এখন তারা কেবল নিজেদের জন্য নয়, দেশের সবার চাহিদার কথা ভাবছে।

রাখাইনরা ঐতিহ্যগতভাবেই রঙের জৌলস প্রকৃতি ও জীবজন্তুর প্রতি বেশি সংবেদনশীল; তাই রাখাইনদের হস্তচালিত তাঁতে বোনা কাপড়গুলো অলঙ্কৃত থাকে লতাপাতা, ফুল, পাখি ও প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ। যার কারণে তাঁতে বোনা কাপড়ে ছয় থেকে আট রকমের রং ব্যবহার করে থাকে, এসব রং নেওয়া হয় প্রকৃতি থেকেই।

হস্তচালিত তাঁতশিল্পে এখন লেগেছে প্রযুক্তি পরশ; তাই একটি সেমি অটো তাঁতে প্রতিদিন তিনটি লুঙ্গি বুনে তৈরি করা সম্ভব। অথচ প্রযুক্তিবিহীন আগের একটি তাঁতে কমপক্ষে তিন দিনে একটি কাপড় বোনা হতো। রাখাইনরা প্রথমত লুঙ্গি, চাদর, থামি, বিছানার চাদর প্রভৃতি তৈরি করে নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে বাজারে বিক্রির জন্য অবশিষ্ট সময় কঠোর শ্রম ব্যয় করে কাপড় প্রস্তুত করে। রাখাইন তাঁতশিল্পটি লাভজনক পেশা হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক বুদ্ধিমত্তার অভাবে তাঁতপণ্য বিকাশে বাধাগ্রস্ত ছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে একটি অটো তাঁত সেই বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে।

বরগুনার তালতলী ২৬৪টি রাখাইন পরিবারে বেশির ভাগই হস্তচালিত পুরোনো আমলের তাঁত রয়েছে। বর্তমানে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ব্যাপারে রাখাইন সংগঠক খেন খেন বলেন, ‘তাঁতে বোনা কাপড়ে আমরা প্রধানত প্রকৃতি থেকে নেওয়া ছয় থেকে আটটি রং ব্যবহার করে থাকি। এ ছয় থেকে আটটি রং কোনোটিই কৃত্রিম নয়। সুতায় বিভিন্ন রং করতে আমরা শাল, বকুলসহ বিভিন্ন গাছের পাতা ও বাকলকে কাজে লাগাই। যাতে করে রং হয় পাকা, বাজারে অন্য সব কাপড়ের তুলনায় আমাদের কাপড়ের রং হয় ভিন্নতর।’

বরগুনার রাখাইন পল্লীতে পাড়ায় পাড়ায় চাদর-লুঙ্গি ইত্যাদি বুনতে লক্ষ করা যায়। প্রতুষ্যে সূর্য ওঠার পূর্ব থেকে গভীর রাত কারিগররা ব্যস্ত থাকেন। প্রতিদিন একজন কারিগর সর্বোচ্চ চারটি লুঙ্গি অথবা তিনটি চাদর বুনতে পারেন। অপরদিকে চাদর বুনতে পারেন তিনটি। চারটি লুঙ্গি অথবা চাদর বোনার জন্য একজন কারিগর ২০০ টাকার মতো মজুরি গ্রহণ করেন। আর এসব কারিগরের অধিকাংশই নারী। তাঁতের মালিকরা এসব চাদর ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা এবং লুঙ্গি ৯০ থেকে ১৭০ টাকায় পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি আর কুয়াকাটার বাজারে রাখাইদের প্রস্তুতকৃত তাঁতবস্ত্র সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। তবে এসব স্থানে তাদের তৈরি পণ্যের প্রধান ক্রেতারা হচ্ছেন দেশি-বিদেশি পর্যটক।

বরগুনার তালতলী রাখাইন সমাজকল্যাণ সংস্থার সদস্য সচিব খে মংলা বলেন, ২০০ বছরের ঐতিহ্যের বাহন হিসেবে তালতলীর ১৩টি আদিবাসী পাড়া অর্থাৎ তালতলী থানার তালতলীপাড়া, ছাতনপাড়া, মনুপাড়া, আগাঠাকুরপাড়া, সওদাগরপাড়া, তালুকদারপাড়া, কবিরাজপাড়া, তাঁতিপাড়া, লাউপাড়া ও অংকুজানপাড়ায় হাতে চালিত প্রায় ২০০ তাঁত রয়েছে। অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও তারা ঠিক আছে। বর্তমানে প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগে এসব তাঁতযন্ত্র আগের তুলনায় বিপুল প্রাণের সাড়া পড়েছে। সুদিনের আভাস দেখা দিয়েছে। তবে সুতার দুষ্প্রাপ্যতা ও মূল্যবৃদ্ধি সহনীয় পর্যায়ে এসে গেলে লাভের হার বেড়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন। তিনি আরো বলেন, কিছু সমস্যা সমাধান হলে আমরা তাঁতশিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে পারব আরো ভালোভাবে এক্ষুনি যদি তালতলীতে রাখাইন তাঁতিদের জন্য সেমি-অটোমেটিক (এসএ) তাঁত বুনন প্রশিক্ষণ ও উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করে তাঁত এবং সুতা ক্রয় করার জন্য সহজ শর্তে পর্যাপ্ত ঋণ দেওয়া হতো। তবে তাঁতশিল্পটি বিকাশের দ্রুততা বৃদ্ধি পেত।

উপজাতিদের তাঁত নিয়ে কাজ করছে স্থানীয় একটি সংস্থা, রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আরডিএফ) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, তালতলীর ২৫ জন তাঁতিকে ইতোমধ্যে ২৫টি সেমি অটো প্রদান করা হয়েছে এবং যথারীতি একটি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে আগামী আরো এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। তবে ঋণ প্রদানের বিষয়টি এ মুহূর্তে আমাদের চিন্তাভাবনা নেই অদূর ভবিষ্যতে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করা হবে।

একসময় রাখাইনদের মধ্যে রীতি চালু ছিল, যে রাখাইন নারী তাঁত চালিয়ে কাপড় বুনতে পারত না, তার নাকি বিয়ে হতো না। তবে বর্তমানে এই রীতি প্রচলিত না থাকলেও অনেক রাখাইন পরিবার এই পেশা থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সেমি অটো তাঁত প্রযুক্তি রাখাইনদের সেই পুরোনো পেশায় ফিরিয়ে নিতে সাহায্য করছে। অচল হয়ে পড়া পুরোনো তাঁতগুলো আবার প্রাণের ছোঁয়ায় সচল হয়ে উঠছে। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে খটখটাখট কাপড় বোনার ছন্দ।

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close