এহসান বিন মুজাহির

  ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

নিবন্ধ

সংবাদপত্র সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্পণ

সংবাদপত্র হলো সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্পণ। সাংবাদিকরা হলেন জাতির বিবেক। সাংবাদিকতাকে বলা হয় কোনো জাতি নির্মাণ কিংবা ধ্বংসের গদ্য। সাংবাদিকতা কোনো জাতির চিন্তা-চেতনার শৈলী ও সুপ্ত মন-মানসিকতা তৈরিতে কিংবা বিনাশ সাধনে কতটুকু ভূমিকা পালন করে, তা কোনো বুদ্ধিমান, সচেতন ও বিবেকসম্পন্ন মানুষের কাছে অস্পষ্ট নয়। মানবতার অতন্দ্রপ্রহরী সাংবাদিকরা দেশ ও জাতির শেষ ভরসা। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা জাতির জাগ্রত বিবেক এবং পাঠকরাই হচ্ছে সংবাদপত্রের প্রাণশক্তি। এ যুগে এমন কোনো শিক্ষিত এবং সচেতন পরিবার নেই, যে পরিবারে সংবাদপত্র নিয়মিত রাখা হয় না। বর্তমান যুগে দৈনিক কাগজগুলো এবং অনলাইন পোর্টালগুলো মানুষের জীবনের একটি অপরিহার্য অংশেই পরিণত হয়েছে। যে মানুষগুলো ভালোমতো পত্রিকা পড়তে পারে না, সমাজের হাল-চাল সম্পর্কে অসচেতন; তারাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ এর প্রভাবে প্রভান্বিত। আধুনিক বিশ্বে সংবাদপত্র ছাড়া মানবসভ্যতা অচল। সমাজ-রাষ্ট্রের উন্নয়ন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, সত্য-সুন্দর এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে সংবাদপত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। সংবাদ, সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র অত্যন্ত নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। একটি ছাড়া অপরটি অসম্পূর্ণ। উনিশ শতকের বিখ্যাত সাংবাদিক জে এ ব্রাডস সংবাদপত্রকে মানব ইতিহাস ও সভ্যতার এক অপরিহার্য নিয়ামক হিসেবে চিত্রিত করেছেন। তার দৃষ্টিতে সংবাদপত্রহীন মানবজীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন-বিভীষিকাময়।

বিখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক হেমিংওয়ে স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় বলেছিলেন, জীবনের সব সৌভাগ্য এবং বঞ্চনা প্রতিদিনের ঘটনার মধ্যেই থাকে; সেগুলো কখনো আমরা নিরাসক্ত খবর হিসেবে পরিবেশন করি অথবা জীবনবোধে উজ্জীবিত হয়ে গল্পে রূপান্তরিত করি। মূলত সংবাদ হচ্ছে জীবনেরই উৎপ্রেক্ষা বা প্রতিচ্ছবি। সবদিক মিলিয়ে সংবাদপত্রের ভূমিকা অপরিসীম। পেশা হিসেবেও সাংবাদিকতা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও সম্মানজনক একটি পেশাও বটে। সামাজিক অনাচার ও বৈপরিত্যের বিরুদ্ধে সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিক, প্রকাশক, ব্যবস্থাপক এবং সংশ্লিষ্ট সবার ওপর পুরো জাতির সুমহান দায়িত্ব অর্পিত। সংবাদপত্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো দল-নিরপেক্ষ সত্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সৎ সাংবাদিকের কোনো দেশ কাল পাত্র নেই। সাংবাদিকদের অন্যতম দায়িত্ব হলো সৎ, সত্যনিষ্ঠ, পক্ষপাতমুক্ত সাংবাদিকতা। সংবাদপত্রকে প্রমাণ করতে হবে কারো প্রতি পক্ষপাত নেই, কারো বিরুদ্ধে বা কারো পক্ষে কোনো এজেন্ডা নেই। বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতা যেমন একটি বিধ্বস্ত জাতিকে পুনর্গঠনে অবদান রাখতে পারে; তেমনি সাংবাদিকতার নামে মিথ্যাচারিতা, পক্ষপাতিত্ব, স্বার্থপরতা এক সুসংহত জাতিকে হিংসাত্মক যুদ্ধের দাবানলে অগ্রসর ভূমিকা রাখতে পারে। সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। তারা জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। প্রকৃত সাংবাদিক হিসেবে তার সংবাদসহ যাবতীয় লেখনী অন্যায় প্রতিষ্ঠায় সহযোগী হতে পারে না। কোনো ঘটনার সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ চিত্র, সত্য খবর সঠিকভাবে জাতির সামনে উপস্থাপন করাই সাংবাদিকদের নৈতিক দায়িত্ব।

ভুল বা মনগড়া কোনো সংবাদ পরিবেশন করা এবং বিশেষ কোনো দল বা গোষ্ঠীর পক্ষে সাফাই গাওয়া সৎ ও প্রকৃত সাংবাদিকের কাজ নয়। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সর্বদা সততা অবলম্বন করা অপরিহার্য। সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ইবাদত। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকের ব্যাপারে, সংবাদ সংগ্রহের নীতিমালা প্রণয়নে আল্লাহ প্রদত্ত রয়েছে নির্দেশনা। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআনুল কারিমে এরশাদ করেনÑ হে ইমানদারগণ! যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের নিকট কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো মানবগোষ্ঠীর ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও’ (সুরা হুজুরাত : ৬)। হাদিসে এরশাদ হয়েছেÑ কোনো ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট, যা সে শুনে (যাচাই-বাছাই না করে), তা অন্যের কাছে বলে বেড়ায় (মুসলিম : ২৩৭০)। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কতিপয় দলীয় কিছু সাংবাদিকের সংবাদ দেখলে মনে হয় এটা তারা চুক্তি করে নিয়েছেন যে, যেকোনো কিছুর বিনিময়ে স্বার্থোদ্ধার চাই। আজ আমাদের দেশের এমনও কিছু মিডিয়া আছে; যেগুলো সাংবাদিকতার অন্তরালে ঘৃণ্য কাদা ছোড়াছুড়ি, আক্রোশ ও মিথ্যাচারে লিপ্ত। মিথ্যে তথ্য-তত্ত্ব, বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ, মনগড়া, ভুয়া রিপোর্ট, তিলকে তাল, তালকে তিল, সাদাকে কালো, কালোকে সাদা বানাতে তারা সামান্যতমও দ্বিধাবোধ করেন না। এর প্রভাব পড়েছে দেশের সাধারণ জনগণের ওপর। প্রকৃত সাংবাদিক, লেখক, কলামিস্টদের নৈতিক দায়িত্ব হলো সব ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ থাকা। আদর্শচ্যুত এবং হলুদ সাংবাদিকতা জাতিকে বিভ্রান্ত করে। সমাজে অনৈক্য, হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ায়। একটি জাতির আশা-আকাক্সক্ষা সঠিকপথে পরিচালিত করতে সাংবাদিকদের ভূমিকা অপরিসীম।

প্রকৃত সাংবাদিকদের শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সত্যিকার আদর্শবাদী, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে হবে। রাজনৈতিক বা অন্য বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত মতামত, দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশ্বাস যাই থাকুক না কেন, তাকে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে থাকতে হবে রাজনৈতিক-দলীয় বিভক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত। সাংবাদিকদের থাকতে হবে সাংবাদিকতার নীতিমালার প্রতি আনুগত্যশীল। সাংবাদিকরা কর্মে ও বিশ্বাসে থাকতে হবে সৎ, বস্তুনিষ্ঠ ও লোভ-লাললার ঊর্ধ্বে। সাংবাদিকদের থাকতে হবে নৈতিক মূল্যবোধ ও পেশাগত যোগ্যতা। সাংবাদিকদের হতে হবে পেশায় সৎ, কর্মে নিষ্ঠাবান, বিশ্বাসে সৎ। পক্ষপাতিত্ব, স্বার্থসিদ্ধি থেকে ঊর্ধ্বে থেকে সৎ সাংবাদিকতায় নিয়োজিত থাকা প্রত্যেক সাংবাদিকের নৈতিক দায়িত্ব। পক্ষপাতিত্বের দ্বারা বিকৃত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভুল সংবাদ প্রচারিত হয়। এর ফলে পুরো জাতি হয় ক্ষতিগ্রস্ত। তাই এহেন ন্যক্কারজনক কাজ থেকে বিরত থাকা সাংবাদিকদের উচিত। বর্তমানে হলুদ সাংবাদিকতার প্রতিযোগিতা চলছে বললেও ভুল হবে না। বস্তুনিষ্ঠ, সৎ সাংবাদিকদের কদর নেই সমাজে। সৎ সাংবাদিকরাই বেশির ভাগ প্রভাবশালী ও স্বার্থবাদীদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হন। টার্গেটে পড়েন তাদের। সব সময় হুমকির মুখে এবং অজানা আতঙ্কে থাকেন। অনেক সময় হন নানাভাবে হয়রানি এবং ক্ষতিগ্রস্ত। এ ক্যাটাগরির সাংবাদিক বা মিডিয়াকর্মীদের প্রাণহানির ঘটনাও প্রায় শোনা যাচ্ছে। কাজেই নির্ভীক সাংবাদিকদের কর্তব্যরত কাজে সার্বিক সহযোগিতা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। শেষ কথা, পক্ষপাতিত্ব, স্বার্থসিদ্ধি থেকে ঊর্ধ্বে থেকে ন্যায়নীতির আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সৎ সাংবাদিকতায় নিয়োজিত থাকা প্রত্যেক সাংবাদিকের নৈতিক দায়িত্ব।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close