হাসান জাবির

  ৩১ জুলাই, ২০১৯

পর্যালোচনা

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর ও আমাদের পররাষ্ট্রনীতি

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হচ্ছে পূর্বমুখিতা। এই পূর্বমুখিতা বলতে বৃহৎভাবে পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক যোগাযোগকে বোঝায়। পররাষ্ট্রনীতির এই কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়েই আছে জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস ও মিয়ানমারের মতো দেশগুলো। যদিও স্বাধীনতা-উত্তর যুগ থেকে আজ অবধি বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রীয় অংশীদার হচ্ছে জাপান। যে কারণে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার ও বাণিজ্য সহযোগী হিসেবে ঢাকা-টোকিও সম্পর্ক উভয়পক্ষের কাছেই বরাবর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি পূর্ব এশিয়ার দেশ চীনও বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ককে ক্রমেই উষ্ণতার দিকে নিয়ে যেতে সচেষ্ট। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক পূর্ব এশিয়ার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ জাপান ও চীন সফর ছিল বিশেষ আলোচিত ঘটনা। বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম দুই প্রধান মোড়ল চীন ও জাপানে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরের মধ্য দিয়ে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির সম্প্রসারণ ঘটেছে। পররাষ্ট্রনীতির মূল চেতনা সমুন্নত রেখে বৈশ্বিক অংশীদারত্বের এই সম্প্রসারণ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য ব্যাপক কূটনৈতিক সাফল্য। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ চীন সফর শেষে উভয়পক্ষ এক ধরনের সন্তোষ অনুভব করছে। উল্লেখ্য, মাত্র এক মাসের ব্যবধানে প্রধানমন্ত্রী প্রথমে জাপান ও পরবর্তীতে চীনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সফর শেষ করেছেন।

সবার সঙ্গে বন্ধুত্বÑ এই মৌলিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ নিজের পররাষ্ট্রনীতিকে বরাবর বৈশ্বিক বিভাজনের ঊর্ধ্বেই রেখেছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের আলোকে বাংলাদেশ নিজের ট্র্যাডিশনাল মিত্রদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে পররাষ্ট্রনীতিতে যেসব কৌশল অবলম্বন করেছেন তার মধ্যে পূর্বমুখী নীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কূটনৈতিক বিষয়ে যারা খবর রাখেন, তারা জানেন যে, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সঙ্গে খাপখাইয়ে নেওয়া এবং অন্য রাষ্ট্রের আচরণগুলোকে নিজ স্বার্থের উপযোগী করে তোলার মধ্যেই নিহিত থাকে পররাষ্ট্রনীতির সার্থকতা। এর সার্থক রূপায়ণ ঘটেছে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক পূর্ব এশিয়ার দুই দেশ সফরে। এ ক্ষেত্রে কূটনীতির মৌলিক বৈশিষ্টগুলোকে সমুন্নত রেখে বাংলাদেশ নিজের প্রয়োজনমতো উভয় দেশের সামর্থ্যকে ব্যবহার উপযোগী করতে পেরেছেন। এক বিরূপ বৈশ্বিক, আঞ্চলিক, জাতীয় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের এই পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির কার্যকারিতা সবার কাছেই দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর উভয় সফরেই বাংলাদেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা ছিল রোহিঙ্গা ইস্যু। মূলত নিজ দেশ মিয়ানমার থেকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত ব্যাপকসংখ্যক রোহিঙ্গাকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টা অত্যন্ত স্পর্শকাতর ইস্যু। যে কারণে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর শেষে দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছে। ১. রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান প্রসঙ্গ, ২. চীন কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীকে উষ্ণ সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের এ নতুন বাস্তবতা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সাধারণ ধারাকে ব্যাহত করবে কি না? অর্থাৎ ঢাকার ট্র্যাডিশনাল মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না? রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রথমেই বলতে হয় যে, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশ করা মিয়ানমারের এই জনগোষ্ঠি ইতোমধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে মারাত্মক নেতিবাচক সংকটের সৃষ্টি করেছে। এর ফলে ভীষণ ঝুঁকিপ্রবণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক জীবন। সংগত কারণেই বিশালসংখ্যক এ লোকদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো বাংলাদেশের কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বই মনে করে চীনের আন্তরিক ইচ্ছা এ সমস্যার সমাধান প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত ফলপ্রসূ করবে। যদিও এ ব্যাপারে চীনা প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও সিপিসির শীর্ষ নেতৃত্ব মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার পূর্বতন ধারাবাহিকতা পুনরায় শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। একই সঙ্গে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে এ সমস্যা সমাধানে ঢাকা-নেপিডোর দ্বিপক্ষীয় আলোচনাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা সমস্যাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ১. এদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো। ২. বাংলাদেশে আপৎকালীন সময়ে আশ্রয়কালে এ বিশাল জনগোঠীর ভরণপোষণ তথা তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় রসদ জোগান দেওয়া। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের ব্যাপারে জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ও শেখ হাসিনা একমত হয়েছিলেন। এই ধারাবাহিকতায় চীনের কম্যুনিস্ট নেতৃত্বের সমর্থন আদায় করা ছিল বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা সবাই জানি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিয়ানমারের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হচ্ছে চীন। দীর্ঘদিন থেকে বেইজিংয়ের একতরফা সমর্থন নিয়ে মিয়ানমার সব আন্তর্জাতিক ঝক্কি-ঝামেলা থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে। যে কারণে রোহিঙ্গা সমস্যার আশু সমাধানে চীনের গ্রিন সিগন্যাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশা করব যে, দেশটি নিজের সামর্থের শেষটুকু দিয়ে এ সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখবে। ব্যাপারটি যদি শুধুই কূটনৈতিক শিষ্টাচারের অংশ হিসেবে বক্তব্য বিবৃতির মধ্য সীমাবদ্ধ না থাকলে; সেটি হবে বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির বড় সার্থকতা।

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ চীন সফরের প্রসঙ্গে আরো বেশ কয়েকটি বিষয় আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি তথা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুতর কোনো পরিবর্তন ঘটল কি না? খুব পরিষ্কাকভাবেই বলা যায় যে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কোনো ব্যত্যয় ঘটাবে না এই সফর। পরিবর্তিত বাস্তবতায় বাণিজ্যনির্ভর কূটনৈতিক সম্পর্কের সুফল পেতে প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীরা চীন সফরে জাতীয় স্বার্থের ব্যাপারে ব্যাপক সক্রিয় সচেতন ছিলেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এ বাস্তবতা অবশ্যই অন্য পক্ষগুলোর রুষ্ট হওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাই প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক চীন সফরকে অত্যন্ত চমকপ্রদ সাফল্য হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। অন্যদিকে জাপান সফরের প্রাক্কালে ঢাকা-টোকিওর মধ্যে প্রায় ২৫০ কোটি ডলারের উন্নয়ন সহায়তা চুক্তিটি ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এই দুই সফরে উভয় দেশের নেতারা বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বিশেষ করে চীনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের উষ্ণ সংবর্ধনা প্রদান এখানে লক্ষণীয়। এর মধ্য দিয়ে কার্যত বেইজিং বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বর্তমান ধারাবাহিকতার প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেছে। চীনের এ ধরনের রাজনৈতিক সমর্থন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেও বেশ প্রভাবিত করবে বলেই মনে করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চীনের নীতির সুস্পষ্ট পরিবর্তন প্রস্ফুটিত হয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে আরো কিছু বিষয় আলোচনায় আসে। তার মধ্যে চীন ও জাপান ঘিরে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন করা। এর ফলে আঞ্চলিক পর্যায়ে আন্তঃবাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটার ব্যাপক সম্ভাবনা থাকছেই। যার সুফল পেতে পারে বাংলাদেশ। এমনটি হলে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির কার্যকারিতা আরো গুরুত্ব পাবে। বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির সূত্রপাত ঘটেছিল বহু আগেই। স্বাধীনতা উত্তরকালে বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় কাছে আনাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। তখনো চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সচেষ্ট ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু বিশ্বরাজনীতির ভিন্ন মেরূকরণের প্রতিক্রিয়ায় সেদিন বাংলাদেশ চীনকে কাছে পায়নি। যদিও পরবর্তীতে বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে চীন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। এ বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক চীন ও জাপান সফর পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতিকেই আরো গতিশীল করবে।

লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close