ইসমাইল মাহমুদ

  ২১ জুন, ২০১৯

স্মরণ

গণসংগীতের গুরু হেমাঙ্গ বিশ্বাস

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রসৈনিক হেমাঙ্গ বিশ্বাস। মূলত লোকসংগীতকে কেন্দ্র করে গণসংগীত সৃষ্টির ক্ষেত্রে তার অবদান অবিস্মরণীয়। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশী ইউনিয়নের রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য সড়কসংলগ্ন পশ্চিম মিরাশী গ্রামে এক জমিদার পরিবারে উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী হেমাঙ্গ কুমার বিশ্বাস জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত সদা হাস্যময় ও মিশুক প্রকৃতির। পিতা হরকুমার বিশ্বাস ছিলেন চুনারুঘাট পরগনার জমিদার। হেমাঙ্গ বিশ্বাস জমিদার পরিবারের সন্তান হয়েও ছিলেন নিপীড়িত, নির্যাতিত, বঞ্চিত মানুষের আপনজন। জমিদারি শান-সৈকতের প্রতি বিন্দু পরিমাণ আকর্ষণ তার ছিল না। কখনোই তিনি জমিদারি প্রভাব দেখাননি। উপরন্তু সমাজের অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রবল মনোবৃত্তি ছিল তার মাঝে। আজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার ও আপসহীন। অন্যায়ের কাছে কখনোই মাথা নত করেননি তিনি। সংগ্রাম করেছেন যৌক্তিক দাবিতে। মানুষকে ভালোবেসে জমিদার বাবার অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে যান ঘর থেকে। তারপর ঘুরে বেড়িয়েছেন হবিগঞ্জ, সিলেট থেকে শুরু করে পুরো ভারতবর্ষে।

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে হেমাঙ্গ বিশ্বাস হবিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করার পর তৎকালীন শ্রীহট্ট মহকুমার (বর্তমান সিলেট জেলা) মুরারিচাঁদ কলেজে ভর্তি হন। সেখানে শিক্ষাকালীন সময়ে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেফতার হন এবং কারাগারে বন্দি থাকাবস্থায় যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। সে কারণে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক তাকে মুক্তি দেয়। ১৯৩৮-৩৯ খ্রিস্টাব্দে বিনয় রায়, দেবব্রত বিশ্বাস, নিরঞ্জন সেন প্রমুখের সঙ্গে নিয়ে তিনি ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’ (আইপিটি) গঠন করেন। পঞ্চাশের দশকের শেষ পর্যন্ত তিনি ওই সংগঠনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বাংলার প্রগতিশীল লেখক-শিল্পীদের আমন্ত্রণে তিনি প্রথম কলকাতায় গমন করেন এবং সেখানে একটি অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তার উদ্যোগে জ্যোতিপ্রকাশ আগরওয়ালের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সিলেট গণনাট্য সংঘ’। স্বাধীনতার আগে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সংগীতের সুরকারদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রধান। তিনি কলকাতা রেডিওতে নিয়মিতভাবে সংগীত পরিবেশন করতেন। সেসময় তার গান, ‘তোমার কাস্তেটারে দিও জোরে শান,/কিষান ভাই-রে/কাস্তেটারে দিও জোরে শান। ফসল কাটার সময় হলে কাটবে সোনার ধান/দস্যু যদি লুটতে আসে কাটবে তাহার জান-রে।/শান দিও, জোরসে দিও, দিও বারে বার/হুশিয়ার ভাই, কভু তাহার, যায় না যেন ধার-রে...’

এ গানটি আসাম ও বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। বাংলার শোষিত-নির্যাতিত কৃষকের ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবি প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আসামে তিনি সহযোগী হিসেবে পান বিনোদ বিহারী চক্রবর্ত্তী, সাহিত্যিক আশোকবিজয় রাহা এবং সেতারবাদক কুমুদ গোস্বামীকে। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তেলেঙ্গানা আন্দোলনের সময় তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিন বছর কারাবন্দি থাকার পর ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি মুক্তি লাভ করেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রসৈনিক হেমাঙ্গ বিশ্বাস আন্দোলন করতে গিয়ে ভোগ করেছেন জেল-জুলুম, নির্যাতন। ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনের সময় পাক শাসকগোষ্ঠী যখন আমাদের মাতৃভাষা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল, তখন হেমাঙ্গ বিশ্বাস রচনা করেন ‘শোন এক আচানক কাহিনি’। তার এ রচনা পুরো পূর্ব পাকিস্তানের আলোড়ন সৃষ্টি করে। শোষিত-নির্যাতিত জনতার পক্ষে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা হেমাঙ্গ বিশ্বাস ষাটের দশকে সোভিয়েত পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ শুরু করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একসময় দেখা দেয় মতপার্থক্য। ফলে তিনি এ কাজ ত্যাগ করেন। চীন-ভারত মৈত্রীর ক্ষেত্রে হেমাঙ্গ বিশ্বাস বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। চায়নিজ ভাষায় তিনি অসংখ্য গান রচনা করেন।

১৯৭১ সালের মগান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী গণসংগীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গ্রামের বাড়িতে বোমাবর্ষণ করে বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেয়। এলাকার প্রায় সবাই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিলেও হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও তার পরিবারের সদস্যরা জীবনকে হাতের মুঠোয় করে এ দেশেই থেকে যান। জীবনের শেষ দিকে হেমাঙ্গ বিশ্বাস সিঙ্গার্স নামে একটি গানের দল গঠন করেন। এ দলের হয়ে তিনি গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে বেড়াতেন। তিনি লাললণ্ঠন, তীর, কল্লোলসহ অর্ধশতাধিক নাটকে সংগীত পরিচালক ছিলেন। একজন জমিদার পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি জমিদারি শাসনব্যবস্থা ও অঢেল সম্পত্তির দিকে দৃষ্টি না দিয়ে গান নিয়ে মেতে থাকেন। নিজের পিতা জমিদার হলেও তিনি জমিদারদের পক্ষাবলম্বন না করে প্রজাদের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে জীবন অতিবাহিত করেন।

হেমাঙ্গ বিশ্বাস বাংলা ও আসাম ভাষায় অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেন। তার রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলোÑ শঙ্খচিলের গান, জন হেনরীর গান, সেলাম চাচা, মশাল জ্বালো, মাউন্টব্যাটেন মঙ্গলকাব্য, বাঁচব বাঁচব রে আমরা, আমি যে দেখেছি সেই দেশ। হেমাঙ্গ বিশ্বাস তার রচিত ‘মাউন্টব্যাটেন মঙ্গলকাব্য’ গ্রন্থে কটাক্ষ করে লিখেছিলেন, ‘মাউন্টব্যাটন সাহেব ও/তোমার সাধের ব্যাটন কার হাতে/থুইয়া গেলায় ও.../এবং/‘নয়াদিল্লিতে ঘোর কালিতে/আইলা কল্কি অবতার-কি বাহার/পতিত ভারত করিতে উদ্ধার/বড় বড় নেতা দিলা পায়ে ধর্ণা/তপস্যায় লভিলেন বর অন্নপূর্ণা...।’

১৯৮১ সালের ৫ ও ৬ মার্চ রাজধানী ঢাকায় গণসংগীতের শিক্ষক, সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক, জীবনভর আপসহীন হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ তাকে ফুলে ফুলে বরণ করে নেন। ওই অনুষ্ঠানে তার পরিবেশিত গণসংগীত ‘ঢাকার ডাক’ শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে। ১৯৮৭ সালের ২২ নভেম্বর এ দেশের সংগীতবোদ্ধাদের অহংকার হেমাঙ্গ বিশ্বাস ইহলোক ত্যাগ করেন। বর্তমানে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশী গ্রামের জমিদারবাড়িতে তার ভ্রাতৃষ্পুত্র প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস, রঞ্জিত বিশ্বাসরা বসবাস করেন।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close