অলোক আচার্য

  ১৪ মার্চ, ২০১৯

আলোচনা

কৃষিজমি রক্ষায় মহাপরিকল্পনা

শহরায়ণ প্রক্রিয়ায় চাষযোগ্য জমি ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাষযোগ্য জমি রক্ষা এবং ফসলি জমিতে অপরিকল্পিত ভবন, সড়ক ও ঘরবাড়ি নির্মাণ রোধে প্রতিটি উপজেলায় একটি মহাপরিকল্পনা করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। সত্যিকার অর্থেই আমাদের একটি মহাপরিকল্পনা করা প্রয়োজন, যার মধ্যে অন্তর্ভুুক্ত থাকবে স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট, বাজারসহ সব অবকাঠামো এবং সেই সঙ্গে কৃষিজমি। যেখানে কোনো ধরনের দখল বা নির্মাণ করা হবে না। আমাদের দেশে গ্রামগুলো শহরায়ণ প্রক্রিয়া মূলত কয়েক দশক থেকেই শুরু হয়েছে। প্রথমদিকে এর গতি একটু ধীর হলেও গত এক দশকে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। হারিয়েছি বহু নদী, খাল-বিল আর বিনিময়ে পেয়েছি নাগরিক জীবনের কিছু সুবিধা। তাই খুব দ্রুত দৃশ্যপট পাল্টাচ্ছে। নগর সভ্যতার ছোঁয়ায় আমাদের চেনা পরিচিত গ্রামগুলো তার চেনা দৃশ্য হারাচ্ছে। ফসলি জমিতে গড়ে উঠেছে জনবসতি। আমাদের দেশে বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে আবাসন গড়ে উঠছে ঠিকই, কিন্তু তা অপরিকল্পিতভাবে। এবং এ কারণেই আবাসন সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে। আবাসন সংকট মেটাতে গিয়ে কৃষিজমির ওপর চাপ বৃদ্ধি পাওয়া সুখের খবর নয়। প্রকৃতপক্ষে আমাদের কৃষিজমি ভরাট হওয়াটাই আশঙ্কাজনক। আমরা যদি এখন থেকেই কৃষিজমি রক্ষা করার দৃঢ় পদক্ষেপ না নিতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে সংকট এড়াতে পারব না।

দ্রুত শহরায়ণের বিস্তার আমাদের কৃষিজমিকে গিলে খাচ্ছে। একসময় যেখানে সবুজ-শ্যামল জমি ছিল এখন হয়তো সেখানে কোনো শিল্প-কারখানা বা কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড টাঙানো। কয়েকদিন পরই হয়তো সেখানে কোনো শিল্প গড়ে উঠবে। আমাদের উন্নয়নের প্রয়োজন আছে কিন্তু কৃষিজমিকে হত্যা করে অবশ্যই নয়। মনে রাখতে হবে, কৃষিভিত্তিক আমাদের এই দেশে কৃষিতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেই হবে। আমি শিল্প-কারখানার গুরুত্বকে খাটো করে দেখছি না, কিন্তু কৃষিজমি রক্ষা না করলে আমাদের পরিণতি হবে ভয়াবহ। ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন করতে হলে এবং বেকার সমস্যা সমাধান করতে হলে কৃষির পাশাপাশি শিল্পকেও গুরুত্ব দিতে হবে, কিন্তু তা অবশ্যই সঠিক পরিকল্পনা করে। যেখানে-সেখানে ফসলি জমি দখল করে নয়। কৃষিজমি দখল হয়ে কল-কারখানা হচ্ছে, ইটভাটা হচ্ছে বা বহুতল ভবন উঠছে। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে পরিকল্পিতভাবে কৃষিজমি রক্ষার পরিকল্পনা ও আইন প্রয়োগ এবং তার বাস্তবায়ন করতে হবে। ২০১৫ সালের তথ্যানুযায়ী দেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৫ লাখ ৫ হাজার ২৭৮ দশমিক ১৪ হেক্টর এবং আবাদযোগ্য পতিত জমি রয়েছে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৬৬ দশমিক ২৪ হেক্টর। নগরায়ণের ফলে দেশে অপরিকল্পিত শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠছে এবং নতুন নতুন ইটভাটা গড়ে উঠছে। রাজধানীসহ সারা দেশেই এক অবস্থা। এক হিসাবে দেখা গেছে, দেশে সাড়ে চার হাজারের বেশি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এসব ভাটায় যে পরিমাণ মাটি পোড়ানো হয় তাতে বছরে প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমি ফসল উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হয়।

এসব ছাড়াও নদীভাঙনে প্রতি বছর চাষযোগ্য ফসলি জমি আমাদের হারাতে হচ্ছে। এসব মানুষ বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেয় শহরে অথবা মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেয় কোনো নতুন ভিটেয়। যেখানে কোনো কৃষিজমি দখল হচ্ছে। এ রকমটি চলতে থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে ৩ হাজার ৫৭৫ বর্গকিলোমিটার ভূমি নদীতে বিলীন হবে, যার অর্ধেকেরও বেশি থাকে কৃষিজমি। যে দেশের অধিকাংশ অর্থাৎ প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষই কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত; সে দেশে কৃষিজমির আশঙ্কাজনক হারে কমতে থাকা আমাদের জীবন ও জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। আধুনিক সমাজব্যবস্থা এবং নগরায়ণ দ্রুততর করতে গিয়ে এ কৃষিজমির বিসর্জন দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। এটা বুমেরাং হবে। আবাসন সংকট মেটাতে সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার। প্রতিদিন যে পরিমাণ কৃষিজমি কমছে তার অধিকাংশই ব্যবহৃত হচ্ছে বাড়ি নির্মাণের কাজে। কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে আমাদের হাতে কৃষিজমি রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার আগেই আমাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য সরকারের যেমন সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে; তেমনি আমাদের সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। কৃষিজমি থেকে অপরিকল্পিত স্থাপনা গড়ে ওঠা ঠেকাতে হবে। সেজন্য কৃষিজমির সংজ্ঞা স্পষ্ট করতে হবে। অবৈধ ইটভাটা তুলতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সচেষ্ট হতে হবে। আর কেউ যাতে কৃষিজমিতে ইটভাটা গড়ে তুলতে না পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। মোটকথা কৃষিজমি রক্ষা করতে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close