অলোক আচার্য

  ১৬ জানুয়ারি, ২০১৯

নিবন্ধ

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধই সমাধান

কোনো আইন তৈরির উদ্দেশ্য থাকে জনসাধারণের কল্যাণ। আইনপ্রণেতারা আইন প্রণয়ন করেন, জনগণের কাজ সেই আইন মান্য করা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেই আইনের বাস্তবায়নে সাহায্য করেন। মূল কথা, আইন মেনে চলা প্রকৃত অর্থেই মঙ্গলজনক। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন আসে যে, আইন মানতে আমরা কতটুকু ইচ্ছুক। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে দেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হয়ে গেল। সড়ক নিরাপত্তায় আইনও প্রণয়ন হলো। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা কমছে কি? প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এখানেও আইন না মানার কারণেই ঘটছে। ওভার স্পিডে বাস চালাতে গিয়ে কোথাও দুর্ঘটনা ঘটছে, ওভারটেক করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। কোথাও মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি রাস্তায় নামানোর জন্য আবার কোথাও পথচারীর ভুলেও দুর্ঘটনা ঘটছে। পথচারীর ভুলটা কম হলেও এটা কিন্তু ঘটছে। ঢাকা শহরের অবস্থা যদি দেখি সেখানে পথচারীরা ওভারব্রিজ থাকা সত্ত্বেও পার হচ্ছে যানবাহনের সামনে দিয়ে। পার হওয়ার সময় হাতটা গাড়ির দিকে থামার ইশারা করি। এখন ভেবে দেখি সেখানে কি গাড়ির থামার কথা? যদি সে গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে? এর দায় কে নেবে? এই দৃশ্য সমগ্র ঢাকাসহ দেশের শহরাঞ্চলগুলোর। আইন মানার জন্যই তৈরি করা হয়। নিজ দায়িত্বেই এটা মেনে চলার কথা। কিন্তু মানি না। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে আমাদেরও কম ভূমিকা নেই। একটি জাতীয় দৈনিকে এসেছেÑ ‘ঢাকার রাস্তায় নিয়ম মানে না কেউ’। যত্রতত্র পার্কিং করা ঢাকার নিত্যনৈমিত্তিক চিত্র। কোথায় পার্কিং করছি সেটা কোনো সমস্যা না। পার্কি করতে পারলেই হলো। উল্টোপথে গাড়ি চলাও নিয়মিত দৃশ্য। এই তালিকায় সরকারি বেসরকারি সব ধরনের গাড়ি রয়েছে। এটা তো গেল সড়ক দুর্ঘটনার কথা।

প্রতিটি ক্ষেত্রেই যদি আইন মেনে চলতে পারি তাহলে সেসব ক্ষেত্রে যেমন দুর্নীতির সুযোগ থাকবে না তেমনি দেশ এগিয়ে যাবে দ্রুত গতিতে। কিন্তু আইন যদি কেবল কাগজে-কলমে থাকে তাহলে এটা কোনদিনই সম্ভব হবে না। সব দোষ কর্তৃপক্ষের দিয়ে বসে থাকাটা যথেষ্ট নেই। আমাদের দেশে ধূমপানের একটা নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সেই নিয়ম কি আদৌ মেনে চলি আমরা। আবার নিয়ম মানা হচ্ছে কিনা তা দেখভালের দায়িত্ব যাদের তারাও সেটা দেখছেন না। অথচ একটা আইন ঠিকই রয়েছে। দেশে অনেক বড় বড় সমস্যা রয়েছে। আর আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও পর্যাপ্ত নয়। আইনটা যদি আমরাই মেনে চলি তাহলে এত ঝামেলার দরকারই হয় না। দেশে পলিথিন নিষিদ্ধ। পলিথিন পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। অথচ দেদার পলিথিন ব্যবহার হচ্ছে। সেটা আমরাই করছি। আমরা কি চাই? জোর করে এটা বন্ধ করতে হবে? আমরা ক্ষতি করছি জেনেও পলিথিন ব্যবহার করি। সচেতনভাবে সেটা বিক্রি বা ক্রয় বন্ধ করলেই মিটে যায়। কিন্তু তা হবে না। আইন এবং তার প্রয়োগের মাঝেও কথা থেকে যায়। আর তাহলো আমরা। যাদের জন্য আইন তৈরি করা হয়। মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে বাস চলছে, নৌকা চলছে, লঞ্চ চলছে। আইনে এসব নেই। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই লঞ্চ, বাস চলছে। এসব যাত্রী কারা? আমরা? প্রয়োজনেই আমরা অতিরিক্ত জেনেই চড়ে বসছি। এতে দায় আসলে কার? আমি নিজেও জেনে বুঝেই উঠছি আবার চালকও অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে রওনা দিল। এরপর যদি দুর্ঘটনা ঘটে যায় তাহলে কিন্তু দোষ সেই চালকের ওপরই বর্তাবে। এটাই সত্যি। অথচ চোখের সামনে অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া দেখেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছু বললো না। কারণ এটা ছাড়া যাত্রীদের কোনো উপায় হয়তো ছিল না। আইন না মানার দায় আমাদের সবার। প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্বের মধ্যেই সাংবিধানিক আইন মেনে চলার বাধ্যবাধকতার কথা রয়েছে। দেশে ছোট বড় বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছে। দালানকোঠা ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। দেখা গেল বিল্ডিংগুলো নিয়ম মেনে তৈরিই করা হয়নি। যেখানে তিনতলা করার কথা সেখানে দশ তলা করে বসে আছে। এর অনুমোদনও পেয়েছে। এক্ষেত্রে কেউ আইন মানলো না। অবৈধ সুবিধা নিয়ে আইনের বাইরে গিয়ে বিল্ডিং তৈরি হয়ে গেল। তারপর এক সময় সেটা সেখানে বসবাস করা মানুষের ওপর ভেঙে পড়লো।

আইন মানা আমাদের দায়িত্ব ছিল। কিন্তু কেউ না মানার কারণেই এমনটা হলো। এরপর হয়তো আইনের একটু কড়াকড়ি হলো। কিন্তু আজও কি দেশের সব দালানকোঠা নিয়ম মেনে তৈরি করা হচ্ছে? সবাই কি রাতারাতি শুধরে গেছে? সেটা হয়নি। সব দোষ কর্তৃপক্ষের ঘাড়ে চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। নাগরিক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করাটাও একটা আইন। আমরা যদি সবাই এমন ভাবতে শুরু করি এটুকু আইন ভাঙলে সমস্যা নেই তাহলে এদেশটা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে না। কিছুদিন আগে একজন কলামিস্টের লেখায় চীনের একটি শহরের বর্ণনা পড়েছিলাম। গাড়ি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কেউ হর্ণ দিচ্ছে না। কারণ ড্রাইভার জানে যানজট কমলে এমনিতেই সামনের গাড়ি চলতে শুরু করবে। পুলিশ কিন্তু তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে নেই। তবু সে আইন মেনে চলছে। আর আমাদের দেশে সব ধরনের যানবাহন প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সব সময় হর্ণ বাজিয়ে কান ঝালাপালা করে দেয়। এটাই শ্রদ্ধাবোধ। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। আইন কেবল জোর করে মানাতে হবে তার অপেক্ষায় বসে থাকলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আমরা হরহামেশাই বলতে শুনি এটা করা উচিত ছিল বা ওটা করলে ভালো হতো। কিন্তু কেউ নিজের দায়িত্বটুকু পালন করে না কেন। বাড়ির নোংরা আবর্জনা কষ্ট করে বাড়ির সামনের রাস্তায় রেখে ভাবি বাকিটা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব। অথচ একটু দূরেই ডাস্টবিন থাকে। বুঝতে চাই যে নিজের ঘর পরিষ্কার করার দায়িত্ব যেমন আমার তেমনি দেশটা পরিষ্কার রাখার দায়িত্বও আমাদেরই। কেবল সিটি করপোরশেনের দায়িত্বই পরিষ্কার রাখা নয়। এভাবেই নিজের দায়িত্বটুকু সব সময় অবহেলা করে আসছি। কোনো আইন কেন ফলপ্রসূ হয় না তার কারণ হিসেবে সবসময়ই কর্তৃপক্ষের ওপর দোষ চাপাই। দোষ দিয়ে বসে থাকলেই আইন কার্যকর হয়ে ওঠে না। প্রতিটি ছোট বড় অপরাধ আমাদের সামনে প্রতিনিয়ত ঘটে আসছে। আমরা দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাই। ভাবি প্রশাসন তো আছেই। কিন্তু একটু সচেতন হলেই অনায়াসে এসব নোংরা সমাজ থেকে দূর করতে পারি। অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার পর মোবাইলে ভিডিও করার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। অথচ ঝামেলা হবে ভেবে আমরা অনেকেই তা এড়িয়ে যাই। যদি আমি সে জায়গায় থাকতাম তাহলে বুঝতে পারতাম এ অবহেলার মূল্য। আইন মেনে না চলা মানুষের সংখ্যা যদি কম হতো, তাহলে কর্তৃপক্ষের আইন প্রয়োগের ব্যাপারটি সহজ হতো। কিন্তু যদি সবাই বা অধিকাংশই আইন না মেনে চলতে চাই, তাহলে সেটা বেশ কঠিন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close