ডা. এস এ মালেক

  ০৩ নভেম্বর, ২০১৮

পর্যালোচনা

৩ নভেম্বর : জেল হত্যাকান্ড

নভেম্বর ৩। জেল হত্যা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নৃশংস হত্যার মাধ্যমে যে প্রতিবিপ্লব সংঘটিত করা হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বরে জেল হত্যা। জেলখানায় চার জাতীয় নেতাদের হত্যাকান্ড ও পরে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা একই সূত্রে গাথা। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বঙ্গবন্ধুর সৃষ্ট দল আওয়ামী লীগ কোনো প্রতিবাদ না করায় এবং সেদিনের সাংবিধানিক বাস্তবতা কাজে না লাগানোর কারণে ৩ নভেম্বর জেল হত্যা সংঘটিত হয় এবং তারই ধারাবাহিকতায় পরে আওয়ামী লীগের কয়েক শ কর্মীকে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় প্রখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতাদের। দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয় হাজার হাজার যুবককে। একটানা দু-তিন বছর জেল খাটেন অনেক কেন্দ্রীয় নেতা। অথচ সংবিধান অনুসরণ করে তৎকালীন স্পিকার মালেক উকিলকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে মোশতাক বিকল্প সরকার গঠন করে জিয়াকে চ্যালেঞ্জ করলে দেশের অধিকাংশ জনগণ ও সামরিক বাহিনীতে কর্মরত সৈনিকরা সেই সরকারকে সমর্থন করত। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তার স্বীকৃতি মিলত। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেদের নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার কারণে ও প্রয়োজনীয় মনোভাব না থাকায় রাজনৈতিক দক্ষতার অনুপস্থিতিতে এমনভাবে মৌন রয়েছিল, যাতে করে মনে হয় প্রতিবাদ করে জেলে যাওয়ার চেয়ে আত্মসমর্পণ করে জেলে যাওয়ায়ই শ্রেয় ছিল। তা না হলে এত বড় ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সুযোগ কেন কাজে লাগানো হলো না। মনে হয়, সেদিন বিকল্প সরকার গঠন করে আন্দোলনের ডাক দিলে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে এত দেরি হতো না। প্রথম সারির নেতারা যখন কিছুই করলেন না, তখন দ্বিতীয় শ্রেণির নেতারা উদ্যোগ নিয়েছিল এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রাথমিক পর্যায়ে তৎকালীন জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল মালেক উকিল, যার রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা ছিল, তিনি স্বগৃহ থেকে পালিয়ে গেলেন। যারা সেদিন দলীয় নেতৃত্ব থেকে সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি বা অন্য কোনো কারণে নীরব রয়েছেন, তারাই পরে বেশ কিছুটা জেনারেল জিয়ার অনুকম্পায় রাজনৈতিক দল নিয়ে তথাকথিত নির্বাচনে অংশ নিয়ে জিয়াকে স্বীকৃতি দেন। সেই থেকে শুরু মূল ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের পালা। এ কথা ঠিক, চার জাতীয় নেতা খুনি মোশতাকের শর্ত মেনে নিতে রাজি হননি বলে জেলে যেতে হয়েছিল। আর ৮২ দিনে মোশতাক বঙ্গবন্ধুর খুনের অনুমোদন দিতে ব্যর্থ হওয়ায় (পরপর দুবার চেষ্টা করেও) মোস্তাককে পরে পর্দার অন্তরালে প্রধান কুশীলব জেনারেল জিয়াকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসিয়ে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বাস্তবায়নের জন্য সামরিক বাহিনীর ওপর অর্পণ করে এবং সুদীর্ঘ ১৫ বছর সে শাসন অব্যাহত রাখে। বস্তুত তারা ৩ থেকে ৭ নভেম্বর যা ঘটেছিল তা ছিল এক রকম সাজানো নাটক। অভ্যুত্থান ঘটে গেল একের পর এক। খন্দকার মোস্তাককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে জিয়াকে তথাকথিত বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতার অধিকারী করা হলো। এরপর জেনারেল জিয়া নিজেই অসংখ্য সেনা সদস্যকে হত্যা করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিজের অবস্থান মজবুত করলেন। একসময় যারা সিপাহি বিপ্লবের কথা বলে ট্যাংকের পিঠে দাঁড়িয়ে জিয়াকে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন, সেই গণবাহিনীর সদস্যকে জিয়া নির্মমভাবে হত্যা করলেন। নিশ্চয়ই জেলখানায় চার নেতার হত্যার মূল লক্ষ্য ছিল দেশে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি। খুনিরা ভালো করেই জানত এই চার নেতা বেঁচে থাকলে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় যেতে সক্ষম হবে। তারা এও জানত, চার নেতা ছাড়া তৎকালীন আওয়ামী লীগকে বাগিয়ে আনা সম্ভব হবে না। হত্যার পরে কী দেখা গেল। কিছুদিন পর বিচারপতি সায়েমকে রেখে জিয়া নিজেই ক্ষমতা দখল করলেন এবং তারপর শুরু হলো ইতিহাস বিকৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্মকান্ড। বিএনপি নেতারা প্রায়ই বলে থাকেন, রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টির কারণে জিয়াকে ক্ষমতায় বসতে হয়েছে। আসলে ক্ষমতায় বসার জন্যই জিয়া ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি করেছিলেন। এখন তো স্পষ্ট বোঝা যায় কেন জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যার সবচেয়ে বড় সুফলভোগী। সাড়ে ছয় বছর তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। ওই সময় রাষ্ট্রীয় পরিচালনা কর্মকান্ডের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, তিনি প্রতিবিপ্লবের নেতা ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী তিনি। তা না হলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া এবং কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করলেন কেন। খুনিদের বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দেওয়া ও দেশে এনে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিলেন, সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ সবকিছুই তো জিয়া করেছেন। কোন দায়বদ্ধতার কারণে এসব করা হয়েছে। তা কি এ দেশের মানুষ বুঝতে অক্ষম? শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করাই একমাত্র লক্ষ্য ছিল না, লক্ষ্য ছিল বিপ্লবের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীন দেশের জন্ম দিলেন এবং যে বিপ্লবের ধারায় তিনি বাংলাদেশকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন, সেই বিপ্লবের প্রতিবিপ্লব ঘটানোয় ছিল জিয়ার একমাত্র লক্ষ্য। জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় একে একে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, তা প্রমাণ করে মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত সবকিছুই প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে ধ্বংস করেছে।

জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান, রাষ্ট্রীয় পরিচালনা নীতি, উন্নয়ন প্রভৃতির কথা বলিÑসর্বক্ষেত্রেই জিয়া প্রমাণ করেছিলেন তিনি প্রতিবিপ্লবের নায়ক ছিলেন। মনে হয় খুনি, লোভী মোস্তাককেই জিয়া হত্যাকান্ডের জন্য প্রলোভন দেখিয়েছিলেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাণপুরুষকে হত্যা করিয়ে স্বাধীনতার শত্রুদের নিয়ে দল ও সরকার গঠন করে জিয়া কি প্রমাণ করেননি যে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ছিলেন না। সব দেখেশুনে মনে হয় তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত হত্যাকারী। ১৯৭১ সালে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করতে গিয়ে তিনি যে চাতুর্যতার আশ্রয় নিয়েছিলেন, পরে তার দলের নেতারা এটাকে কেন্দ্র করে ইতিহাস বিকৃতির দায়িত্বহীন কার্যকলাপ সুদীর্ঘ সময় অব্যাহত রেখেছেন এবং এখনো বলে যাচ্ছেন। এটাও প্রমাণ করে তিনি একজন ষড়যন্ত্রকারী। মনে হয় ষড়যন্ত্রকে কার্যকর করার জন্যই তিনি মুক্তিযুদ্ধের খাতায় নাম লিখেছিলেন। আসলে যারা বাংলাদেশ চাননি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও জাতিসত্তার বিশ্বাসী নয়, এক কথায় স্বাধীনতার শত্রু, সেই জামায়াত-শিবির চক্র আন্তর্জাতিক চক্রান্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে এবং সুদীর্ঘ ১৫ বছর সামরিক শাসন অব্যাহত রেখে স্বাধীনতাবিরোধী ধারায় বাংলাদেশকে পরিচালিত করে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে মহাসংকটের সৃষ্টি করে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। যদিও ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হয়ে সেই ধারার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। এখন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অগ্রসরমান। তবু অতীতের গণবিরোধী রাজনীতির প্রভাব এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এখনো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সংঘবদ্ধ হয়ে বারবার দেশরতœ শেখ হাসিনাকে হত্যা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের লক্ষ্য, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তারা যেমন একটানা দুই দশক স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের দ্বারা শাসন ও শোষণ করেছে, একইভাবে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারলে বাংলাদেশকে চিরদিনের জন্য তাদের পদানত করতে সক্ষম হবে। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া ওদের লক্ষ্য নয়, ওদের লক্ষ্য রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা। বঙ্গবন্ধু পরিবারের স্বাধীনতার সপক্ষের দল আওয়ামী লীগের কোনো ব্যক্তিকে তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখতে চায় না। তাই জাতীয় নির্বাচন এলে অংশগ্রহণ করে এবং এমন অবস্থার সৃষ্টি করে যাতে ওই নির্বাচন অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। ওদের লক্ষ্য, জোর-জবরদস্তি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি এবং সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া। ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে ক্ষুণœ করা। গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদবিরোধী শক্তিকে ইন্ধন জোগানো এবং যে অর্থে আজ বাংলাদেশ স্বাধীন তা সামগ্রিকভাবে বিনষ্ট করা। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে ওরা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। এখনো এ অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। আজকের বাস্তবতা হচ্ছে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা না করতে পারলে ওরা ওদের ষড়যন্ত্রকে দ্রুত এগিয়ে নেবে, যা দেশ ও জাতির জন্য ভয়াবহ অমঙ্গলজনক।

লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close