আবু আফজাল মোহা. সালেহ
নদী
শহরের ভরকেন্দ্র
বাংলাদেশের রাজধানী ও তার আশপাশের জেলার নদীগুলোর দূষণমাত্রা চরমে। বলা যায়, শিল্পকারখানার বর্জ্য বা উপজাতসহ বিভিন্ন কারণে বড় শহরগুলোতে এ সমস্যা প্রকট। নদী হলো প্রকৃতির অন্যতম দান। নদীর প্রবাহ না থাকলে প্রকৃতিও বিরূপ হয়। পৃথিবীর বড় বড় শহর নদীর তীরেই অবস্থিত। নদীকে কেন্দ্র করেই সভ্যতা গড়ে উঠেছে। নদীকে সভ্যতা বা আধুনিক শহরের ভরকেন্দ্র বলা যেতে পারে। নদীকে কেন্দ্র করেই শহরের উন্নতির ওঠা-নামা করে। অথচ, নদীগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। বুড়িগঙ্গা থেকে কর্ণফুলী, শীতললক্ষ্যা থেকে সুরমা কিংবা তুরাগ থেকে রূপসাÑসব নদীই ভয়াবহ দূষণের শিকার। আমরাই আমাদের প্রকৃতির অন্যতম প্রাণ নদীকে হারিয়ে ফেলছি, নষ্ট করছি। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের জেলাগুলোতে দূষণের মাত্রা চরমে। যেখানে শিল্পকলকারখানা যত বেশি, সেখানে দূষণের মাত্রার অনুপাত তত বেশি।
ময়লা-আবর্জনা ফেলা নদী দূষণের অন্যতম কারণ। বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী অনেক এলাকার মানুষই সরাসরি বুড়িগঙ্গায় ময়লা-আবর্জনা ফেলেন। এসব ময়লা-আবর্জনা বুড়িগঙ্গার পানিতে মিশে যায়। নদীকে ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভয়াবহ দূষণে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি কুচকুচে কালো। ঢাকার প্রাণ বলা হয় এই বুড়িগঙ্গাকে। কিন্তু দূষণে জর্জরিত নদীটি দিনে দিনে যেন মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। ঢাকার বাবুবাজার এলাকা দিয়ে সরাসরি বর্জ্য মিশ্রিত পানি ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গায়। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার এ রকম বেশ কিছু জায়গা থেকে সরাসরি বুড়িগঙ্গায় ফেলা হয় বর্জ্য। বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের এটি একটি অন্যতম কারণ। বুড়িগঙ্গার পানিতে রাসায়নিক বহন করার ব্যাগ পরিষ্কার করছেন শ্রমিকরা। পুরনো ঢাকার বেশ কয়েকটি স্থানে নিয়মিত রাসায়নিক বহনের ব্যাগ, কন্টেইনার পরিষ্কার করার কারণে এ নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। পুরনো ঢাকার ইসলামবাগ, শোয়ারিঘাট, কামরাঙ্গিরচরসহ বিভিন্ন এলাকায় বুড়িগঙ্গার তীরজুড়ে চলে প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ। বিভিন্ন রাসায়নিব দ্রব্য মিশ্রিত এসব প্লাস্টিকসামগ্রী পরিষ্কারের কাজটি সরাসরি করা হয় বুড়িগঙ্গার পানিতে। বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের আরেকটি কারণ ব্যবহৃত প্লাস্টিকজাতীয় মোড়ক, ফোম ইত্যাদি। পুরনো ঢাকার বাদামতলী এলাকায় ঢাকার সবচেয়ে বড় ফলের পাইকারি বাজার থেকে এসব অপচনশীল দ্রব্যাদি সরাসরি ফেলা হয় বুড়িগঙ্গায়। নদীর আরেক শত্রু ডকইয়ার্ড। বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ডকইয়ার্ড। এসব ডকইয়ার্ডের কারণেও দূষিত হচ্ছে বুড়িগঙ্গা। ডকইয়ার্ডের জাহাজের তেল আর পোড়া মবিল এ দূষণে ভূমিকা রাখে। পলিথিন হচ্ছে পরিবেশের অন্যতম শত্রু। চিপসের ব্যাগ বা পলিথিনের ব্যাগও বুড়িগঙ্গা দূষণের অন্যতম কারণ। বাংলাদেশে পলিথিন ব্যবহারে কিছুটা বিধিনিষেধ থাকলেও বাস্তবে সে আইন কোথাও মানা হয় না। ফলে ঢাকা শহরের সর্বত্র অবাধে পলিথিন ব্যবহার করা হয় এবং বিভিন্ন ড্রেন হয়ে ব্যবহৃত সব পলিথিন চলে আসে বুড়িগঙ্গায়। বর্ষা মৌসুমে ভাটি থেকে প্রচুর কচুরিপনা এসে বুড়িগঙ্গার পানি ঢেকে ফেলে। এ সময়ে এ নদীতে নৌকা ও জাহাজ চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়। বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে বিভিন্ন এলাকায় আছে বেশ কিছু ইটভাটা। ঢাকায় যাওয়ার পথে এ চিত্র দেখা যায়। তুরাগ বা নদ-খালের দখলে জর্জরিত দুই পাড়। দখলকারীরা মূলত প্রভাবশালী বালু আর পাথর ব্যবসায়ী। ঢাকার মিরপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় তুরাগ নদে গবাদি পশু আর মানুষের গোসল চলছে একই সঙ্গে। এ দৃশ্য অন্য জায়গাতেও দেখা যায়। শিল্প যেমন আশীর্বাদ তেমনই কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিশাপ। শিল্পের আধিক্যের কারণে নারায়ণগঞ্জের শীতালক্ষ্যা নদীও ভয়াবাহ দূষণের শিকার। এ নদীর পানি শীত মৌসুমে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এ নদী দূষণের অন্যতম কারণ এর দুই তীরের অসংখ্য শিল্পকারখানা। অনেক স্থান থেকে শিল্পকারাখানা থেকে রাসায়নিক মিশ্রিত বর্জ্য শীতালক্ষ্যায় ফেলা হচ্ছে। ফলে পানির রং কুচকুচে কালো হয়ে যায়। এ পানি ব্যবহার করলে চর্মসহ বিভিন্ন রকম রোগে আক্রান্ত হতেই হবে। মৃত গবাদি পশুর বেশির ভাগই সরাসরি ফেলা হয় নদীতে। মৃত গবাদি পশু পচে নদীগুলো দূষিত হয়।
শিল্পকারখানা স্থাপনের সময় বা এখন শিল্পের বর্জ্যব্যবস্থাপনা নিয়ে কঠোর হতে হবে। সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকলে কোনো শিল্প স্থাপনা করার অনুমোদন না দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অধিক কঠোর হতে হবে। প্লাস্টিক সামগ্রী, পলিব্যাগ, প্যাকেটজাত দ্রব্যের মোড়কের ব্যপারে চিন্তাভাবনা করতে হবে। এগুলো নদীদূষণের অন্যতম কারণ। নদীর ধারে পশুর হাটগুলোতে নজরদারি বাড়াতে হবে। অযথা যতে পানি দূষণ করতে না পারে এ ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে। নগরায়নে মাস্টার প্লানের কোনো বিকল্প নেই। শিল্পকারখানা বা আবাসিক স্থাপনা বা হাটবাজার স্থাপনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শুধু আইন করে বা আইন প্রয়োগ করেই এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সরকার, শিল্পপতি ও জনগণ সবাইকে সচেতন হতে হবে। যার যার ক্ষেত্র থেকে আন্তরিক হলেই এ সমস্যার সমাধান করা যাবে। শুধুমাত্র ব্যবসায়িক মুনাফা দেখলে এ সমস্যার সমাধান হবে না।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট
"