ইয়াসমীন রীমা

  ০৩ অক্টোবর, ২০১৮

পর্যালোচনা

জলাতঙ্ক নয় আতঙ্ক

সৌখিন আজ দুপুরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায়। জরুরি বিভাগের দুই নম্বর সিটে সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। মৃত্যুর আগে কেবল একবার তার মা সিতারা খাতুনের দিকে তাকিয়েছিল। অথচ, কোনো শব্দ করতে পারেনি। মৃত্যুযন্ত্রণায় তার আট বছরের পুরো দেহটা কেমন বাঁকিয়ে আসছিল বারবার। তবে সে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। সৌখিনের বাবা মিজানুর রহমান ভূঁইয়া কুমিল্লা সদর উপজেলার তফসিল অফিসের একজন কর্মচারী। তিন তিনটি কন্যাসন্তান জন্ম নেওয়ার পর সৌখিন তার একমাত্র ছেলে সন্তান। তার কথায় ভূঁইয়া বংশের প্রদীপ। এই সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল প্রদীপ যে এত তাড়াতাড়ি নিভে যাবে, কল্পনা করতে পারছে না তার দুই চোখ। এখন কল্পনাহীন দুই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। ওদিকে প্রিয় ছোট আদরের ভাইকে হারিয়ে তিন বোনের গলা জড়াজড়ি করে কান্না হাসপাতালের করিডর আঙ্গিনা ভারী হয়ে আসছিল। আর মা সিতারা খাতুনের দুবার জ্ঞান হারানোর পর এখন কিছুই বলছে না। যেন কাঁদতে ভুলে গেছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জরুরি বিভাগের সিটে পড়ে থাকা ছেলের নিথর দেহটির দিকে। কুমিল্লা নগরীর মোগলটুলী এলাকায় হলিচাইল্ড কেয়ার একাডেমির তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিল সৌখিন। পড়াশোনায় ছিলো যেমন ভালো, তেমনি খেলাধুলায় ছিল অগ্রগামী। বাসা থেকে স্কুল- খুব একটা দূরত্ব নয়। প্রতিদিন একাই স্কুলে যেত। স্কুল থেকে ফিরে মোগলটুলির পোস্ট অফিস মাঠে খেলতে যেত বিকেলে। একদিন খেলা থেকে ফেরার পথে তাকে যে কুকুর কামড়েছিল, তা সে গোপন রেখেছিল বাসার সবার কাছে। অনেকটা বকুনির ভয়ে। কুকুরে কামড়টি তার পশ্চাৎদেশে ছিল বিধায় মায়ের নজরে আসেনি। আঘাত শুকিয়ে গেলেও সে যে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে গেছে, তা বোঝা যায়নি। উপসর্গ শুরু হওয়াতে ডাক্তারের কাছে যখন যাওয়া হলো, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

জলাতঙ্ক মূলত একটি ভাইরাসজনিত মরণব্যাধি। এটি লাতিন শব্দ; যার অর্থ ‘পাগলামি’ করা। জলাতঙ্ক আক্রান্ত প্রাণী বা রোগীর আচরণ থেকেই এর নামকরণের সূত্রপাত। বাংলাদেশে বর্তমানে জলাতঙ্ক একটা জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের জন্য। জলাতঙ্ক রোগ বাংলাদেশে নতুন কোনো বিষয় নয়। পুরনো বিষয় হলেও এ রোগে এখনো দেশে শত শত শিশু-কিশোর এবং মানুষ মারা যাচ্ছে। কুকুর র‌্যাবিস ভাইরাস বহন করে তার কামড়, আঁচড় বা লালা থেকে জলাতঙ্ক রোগের ভাইরাস ছড়াতে পারে। কুকুড়ের কামড়ে রোগের ভাইরাস ক্ষতস্থান থেকে মস্তিষ্কে সংক্রমিত হয় এবং তাতে স্নায়ুতন্ত্রের নানা রকম জটিল উপসর্গ দেখা দেয়। ফলে আক্রান্ত শিশু বা ব্যক্তির পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। শ্বাস ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মানুষ মারা যায়। এই রোগে আক্রান্ত রোগী জল দেখলে আতঙ্কিত হয়। সে কারণে এর নাম হয়েছে জলাতঙ্ক। তা ছাড়া আলো দেখলে বা মৃদু বায়ুপ্রবাহ হলেও অনেক ভীতি হয়ে পড়ে। প্রচ- তৃষ্ণার্ত হয়েও পানি পান করতে পারে না। এ রোগে জল খাওয়া বা পান করার সময় খাদ্যনালির ঊর্ধ্বভাগের মাংসপেশিতে ব্যথাসহ তীব্র সংকোচন হয়। জলাতঙ্ক আক্রান্ত হলে কুকুর এবং রোগী উভয়েরই মৃত্যু অনিবার্য। সব কুকুরে কামড়ালেই জলাতঙ্ক হয় না। কারণ, প্রধানত এটা পশুদের রোগ। তাই প্রথমত পশুদের হতে হবে। তারপরই মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হবে।

সারা বিশ্বে প্রতি মিনিটে একজন করে মানুষ মারা যায় জলাতঙ্ক রোগে। বছরে মারা যায় প্রায় ৫৫ হাজার। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ থেকে ৯৫ শতাংশ ভাগ মারা যায় এশিয়া ও আফ্রিকায়। বাংলাদেশে প্রতি বছর জলাতঙ্কে মৃত্যু হয় ২ হাজারের বেশি; যার মধ্যে ১৫ বছরের নিচে শিশু-কিশোরের সংখ্যা বেশি। ৮৮ শতাংশ রোগী মারা যায় গ্রামে এবং ১২ শতাংশ শহরে। তাছাড়া অন্যান্য প্রাণীর কামড়ে মারা যায় ৬ শতাংশ। রোগটি নির্মূল হওয়ার আগেই একটি রোগের আবরণে ঢাকা পড়ে অন্য একটি পুরনো রোগ। অনেকের ধারণা, পুরুষ বা স্ত্রী লিঙ্গের উভয় কুকুরই কামড় দেয় তার পেটে ওই প্রাণীর বাচ্চা আসে। এই কল্পনাপ্রসূত ধারণাটি মোটেই সঠিক নয়। কারণ, কুকুরের লালা বা দাঁতের সঙ্গে প্রজনন ক্রিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং কুকুর কামড় দেওয়া স্থানটিতে সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ পানি সম্ভব হলে সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে, যাতে জলাতঙ্ক রোগের জীবাণুটি বের হয়ে যায়। আর যদি তৎক্ষণাৎ জোগাড় করা সম্ভব হলে স্পিরিট বা টিংচার আয়োডিন-পভিডন আয়োডিন প্রয়োগ করতে হবে। কেউ কেউ আবার কুসংস্কারকে বিশ্বাস করে থালাপড়া, পানিপড়া, ঝাড়ফুঁক, গাছ-গাছড়া, কলাপড়া, গুড়পড়া ইত্যাদি করে থাকেন কিন্তু এই রোগের প্রতিরোধে এসবের কোনো কার্যকারিতা নেই।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা) মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, জলাতঙ্ক একটি গুরুত্বহীন রোগ। জলাতঙ্ক নির্মূল কার্যক্রমের পাইলট প্রকল্প নরসিংদী, কুতুবদিয়া ও কক্সবাজারে চালু হতে যাচ্ছে। এসব জায়গায় পশুর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, পশু জলাতঙ্ক রোগের ভাইরাসমুক্ত করা এবং কুকুর নিবন্ধন করা হবে। গ্রামাঞ্চলে অনেক সময় কুকুরে গরু-ছাগল আক্রমণ করে। কুকুর জলাতঙ্ক রোগের ভাইরাসে আক্রান্ত হলে গরু বা ছাগলও আক্রান্ত হয়। ফলে রোগাক্রান্ত পশু জবাই করে মাংস খাওয়া হয় বা বিক্রি করা হয়। তা থেকেও এই রোগের সংক্রমণ মানুষে ঘটতে পারে। প্রতিদিন কেবল ঢাকা ও তার আশপাশে থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ রোগী রোগের চিকিৎসা নিতে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে আসছে। তাহলে সহজেই অনুমেয় সারা দেশের পরিস্থিতি।’

দেশে জলাতঙ্ক রোগে মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমছে না। রোগীদের ৯৬ শতাংশ কুকুরের কামড়ের কারণে আক্রান্ত হচ্ছে। বন বিভাগের এক তথ্যে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে প্রায় ২০ লাখের বেশি কুকুর রয়েছে; যার মধ্যে ১৪ লাখ বেওয়ারিশ। এদের মধ্যে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার কুকুর র‌্যাবিশ (জলাতঙ্ক) আক্রান্ত। দেশে বছরে জালাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে শিশু-কিশোর-মানুষ মিলিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা শতাধিক। সংক্রামক ব্যাধি অধিদফতরের তথ্য মতে, দেশে ২০১০ সালে জলাতঙ্কের কারণে ১০৪ জনের মৃত্যুর হয়েছে; যার মধ্যে ১৫ বছরের শিশু রয়েছে ৭৯ জন। ২০১১ সালে এর রোগে মারা যায় ১০৯ জন; যার মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৮০ জন। ২০১২ সালে ৮৫ জন এবং শিশু ৩২ জন। ২০১৩ সালে ৯১ জন। ২০১৪ সালে ১০৪ জন। তবে ২০১৫ সালে মাত্র ৬৬ জন জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আর চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত জলাতঙ্কে মারা গেছেন ৩৫ জন, যার মধ্যে শিশু ৩৩ জন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার এমডিভি কনসালটেন্ট ডা. কামরুল ইসলাম বলেন, কুকুর কামড় দিলে নাভির চারপাশে চরম যন্ত্রণাদায়ক ১৪টি ইঞ্জেকশন দেওয়ার দিন এখন নেই। কুকুর কামড়ালে অ্যান্টি র‌্যাবিস ভ্যাকসিন এখন খুব সহজলভ্য। চিকিৎসাসেবায় বর্তমান সরকারের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হলেও নগর-বন্দরের অনেক সচেতন মানুষ এখনো জানেন না সরকারের এই সাফল্যের কথা। কাউকে আর ভ্যাকসিনটি সংগ্রহের জন্য ভোগান্তিতে পড়তে হয় না। তাছাড়া জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান (আইপিএইচ) এসব ‘নার্ভ টিস্যুর টিকা তৈরি করছে। নির্দিষ্ট বিরতিতে এই টিকা মাংসপেশিতে দেওয়া হয়। বর্তমানে নতুন টিকার মাধ্যমে চিকিৎসা করা হচ্ছে, এতে ২৮ দিনেই রোগী আশঙ্কামুক্ত হয়ে যায়। বিনামূল্যে এই চিকিৎসা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে ২০১১ থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত কুকুরের টিকাদান কর্মসূচিতে প্রায় ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৩০টি কুকুরকে জলাতঙ্ক প্রতিরোধক টিকা প্রদান করা হয়েছে। এ দেশে শিশু-কিশোরদের কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্তের হার সর্বাধিক। রাস্তাঘাটে বিপুলসংখ্যক কুকুর বংশবিস্তার করে চলছে। জলাতঙ্ক সক্রমণপ্রবণ দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

জলাতঙ্ক একটি মরণব্যাধি রোগ। তবে শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে মৃত্যু অবধারিত। বিশ্বে জলাতঙ্ক নির্ণয়ের কোনো ধরনের পরীক্ষা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তা ছাড়া সাত দিন থেকে সাত বছরের মতো এই রোগের জীবাণু দেহে সুপ্ত থাকতে পারে। আর জলাতঙ্কে আক্রান্ত হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই রোগীর মৃত্যু ঘটে থাকে। এ রোগের আক্রমণাত্মক দিক এখনো আশঙ্কামুক্ত নয়। শিক্ষা ও জনসচেতনতা এবং আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে এ রোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে দেশের শিশু-কিশোররা।

লেখক : গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close