আবু আফজাল মোহা. সালেহ

  ০১ অক্টোবর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের চা-শিল্প

বাংলাদেশ চা বোর্ড (বিটিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালে দেশে চা উৎপাদন হয়েছিল ৫ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার কেজি। এ সময় ভোগের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৬৯ লাখ ৫০ হাজার কেজি। ওই বছরে ১ কোটি ২৯ লাখ ২০ হাজার কেজি চা রফতানি করা সম্ভব হয়েছিল। আর রফতানির মাধ্যমে আয় হয়েছিল প্রায় ৮৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৭ সালে এসে এ উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার কেজিতে। বিপরীতে ভোগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ৫৯ লাখ ৩০ হাজার কেজিতে। এ সময়ের ব্যবধানে দেশে ভোগ তথা ভোক্তাপর্যায়ে পণ্যটির ব্যবহার বেড়েছে ১৩২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর বিপরীতে উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। কমেছে রফতানির পরিমাণও। গত বছর বাংলাদেশ থেকে পণ্যটি রফতানি হয়েছে মাত্র ২৫ লাখ ৬০ হাজার কেজি। অর্থাৎ প্রায় দেড় দশকের ব্যবধানে রফতানির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ। ২০০১ সালে দেশে মাথাপিছু চা ভোগের পরিমাণ ছিল ২৯৩ গ্রাম। ২০১৩ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৩৭৯ গ্রামে। গত বছরেই তা ৫০০ গ্রাম ছাড়িয়ে যায়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকা ও চাষ সম্প্রসারণের সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছি। চা-শিল্প খাতে একটু নজর দিলে চায়ের দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা সম্ভব হবে। চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দিকেই। তবে উৎপাদন হার আর মানের দিকে কমতি রয়েছে। ক্রমান্বয়ে চায়ের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু সে তুলনায় উৎপাদন বাড়ছে না।

চা চাষের সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে উত্তরের জেলাগুলোয়। এ অঞ্চলের মাটি উন্নতমানের চা উৎপাদনের জন্য বেশ উপযোগী। এখানে চা উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। পঞ্চগড়ের অর্গানিক চা তো বিদেশে রফতানি হচ্ছেই। ঠাকুরগাঁয়েও সীমিত পরিসরে চা চাষ হচ্ছে। লালমনিরহাট, নীলফামারীতে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। একটু উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জের চায়ের মান বৃদ্ধি করা যেতে পারে। চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল থেকে পাইলটিং হিসেবে শুরু করতে পারি। বাড়তি চাহিদা মেটাতে দেশের উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট জেলায় উন্নতমানের চা উৎপাদন বেগবান করতে হবে। সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।

চা-শিল্পকে দেশের শিল্প না বলে অনেকে আভিজাত্যের শিল্প বলে থাকেন। কারণ গুটিকয়েক মালিকের হাতে জিম্মি এ শিল্প। এ শিল্প দেখিয়ে তাদের অনেকে বেশ সুযোগ-সুবিধা নেন দেশ-বিদেশ থেকে। কিন্তু চা-কেন্দ্রিক সুযোগ-সুবিধা নিলেও অনেকে চায়ের উন্নয়নে কাজে লাগান না! এ ব্যাপারে সরকার কঠোর হলেই বিপুল সম্ভাবনা দেখা দেবে এ শিল্পে। সরকার চা চাষের উন্নয়নে হাতে নিয়েছে পরিকল্পনা। ভিশন-২০২৫। পার্বত্যাঞ্চলে চা সম্প্রসারণে নিয়েছে বেশ কিছু প্রকল্প। এসব সহযোগিতা ও সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগালে চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধির

মাধ্যমে দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করে বিপুল পরিমাণ চা বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া চায়ের আমদানিকে নিরুৎসাহিত করে উৎপাদন বাড়াতে হবে। চায়ের বাজার ধরে রাখতে হলে আমাদের উচ্চফলনশীল জাতের চা চাষ বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশে চা আবাদের সম্ভাব্য সমীক্ষা পরিচালনা করে রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইলের মধুপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার মোট ১ লাখ ১ হাজার ৭২৪ হেক্টর ক্ষুদ্রায়তনে চাষযোগ্য জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে বৃহদায়তনের চা বাগানগুলোর আওতায় মোট ১ লাখ ১১ হাজার ৫৫৫ হেক্টর জমি রয়েছে। এর মধ্যে চায়ের আবাদ হচ্ছে ৫৭ হাজার ১৮৬ হেক্টরে।

চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাগানগুলোর সর্বোচ্চ কার্যকারিতাও বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে উৎপাদনশীলতাও। উৎপাদনশীলতায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন বৈশ্বিক গড়ের নিচে। ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা ও কেনিয়া দেশগুলোর মধ্যে হেক্টরপ্রতি আড়াই হাজার কেজির কাছাকাছি উৎপাদন করে। বৈশ্বিক উৎপাদনশীলতায় এগিয়ে রয়েছে কেনিয়া। এর পরই রয়েছে ভারত ও জাপান। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আবহাওয়া চা উৎপাদনের অনুকূলে থাকলেও, এখানে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন মাত্র ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ কেজির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাংলাদেশে আধুনিক প্রযুক্তির অভাব রয়েছে। ফলে অন্য দেশের চেয়ে উৎপাদন কম হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ চা আমদানি করতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে দেশের বাণিজ্য ভারসাম্য প্রতিকূলে যাচ্ছে। দেশের চা-শিল্পে বর্তমানে প্রায় দেড় লাখ লোকের সরাসরি কর্মসংস্থান রয়েছে। এ শিল্পের ওপর নানাভাবে নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা প্রায় চার লাখ। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রফতানি বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশের চা-শিল্পের উন্নয়নের জন্য কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

‘বাংলাদেশ চা বোর্ড’ বাংলাদেশের চা-শিল্পের উন্নয়নের জন্য কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা ‘ভিশন ২০২৫’-এর বাস্তবায়ন শুরু করেছে। এর আওতায় ২০২৫ সালের মধ্যে বার্ষিক ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের মাইলফলক অতিক্রমের লক্ষ্য

নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্য পূরণের জন্য বৃহদায়তনের বাগানের পাশাপাশি ক্ষুদ্রায়তনের জমিতে চায়ের আবাদ

বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। বিদেশি ক্রেতাদের

আকৃষ্ট করতে চায়ের শ্রেণিবিন্যাস করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সাধারণ কালো চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঠা-া চা, সুগন্ধি চা, মসলাযুক্ত চা, ঔষধি চায়ের মতো বিশেষ ক্যাটাগরির চা রফতানি করা হবে। রফতানিযোগ্য চা উন্নত মোড়কে প্যাকেটজাত এবং চায়ের উৎপাদন ও গুণাগুণ-সম্পর্কিত পর্যাপ্ত তথ্যাবলিসহ রফতানি করা হবে।

চা-শিল্পের সমস্যাগুলোÑপরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা, চায়ের বস্তা/মোড়ক/বাক্স সরবরাহের সমস্যা, অর্থাভাব, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, শ্রমিক সমস্যা, পয়োনিষ্কাশন ও সেচ সমস্যা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট, আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা, ভালো বীজের অভাব, রাসায়নিক সারের অপ্রাচুর্য ও সময়োচিত সরবরাহ, যন্ত্রপাতি ও খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহের ঘাটতি, গুদামের সমস্যা, প্রয়োজনীয় ঋণব্যবস্থার সমস্যা, অনিশ্চিত বৃষ্টিপাত, উৎপাদনের উচ্চব্যয়, মূল্যের অস্থিতিশীলতা, গবেষণার সীমিত সুযোগ, রোগবালাই ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ ইত্যাদি। এ খাতের উন্নয়নে ব্যাংক সুদের হার কমানো, আমদানিকে নিরুৎসাহিত, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, শ্রম অসন্তুষ্টি কমাতে আরো সুবিধা বাড়ানো ও জমি ইজারা নিয়ে বিরোধগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। চা-শিল্প শ্রমিকদের উন্নয়নেও নানা কর্মসূচি নিতে হবে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে নানা প্রণোদনা দিতে হবে। এগুলোর সর্বোচ্চ ও যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো জরুরি। গবেষণাকাজের ক্ষেত্র সরকারি বরাদ্দের পরিমাণ বাড়াতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। বিদেশে বাজার সম্প্রসারণ করতে হবে। চা বাগান এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বাড়াতে হবে বা আলাদা করা যেতে পারে।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

উপপরিচালক (বিআরডিবি), লালমনিরহাট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close