লিবিয়ার অভিবাসী আটককেন্দ্রে সাম্প্রতিক হামলার ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যান নিহাল নামে ৩১ বছর বয়সি এক বাংলাদেশি। গত ৩ জুলাই রাজধানী ত্রিপোলির তাজুরা আটককেন্দ্রের ওই বিমান হামলায় এক বাংলাদেশিসহ কমপক্ষে ৫৩ জন নিহত ও ১৩০ জন আহত হন। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হামলার ভয়াবহতা বর্ণনা করেছেন তিনি। নিহাল বলেন, আমার মনে আছে, সেদিন এক সুদানি নাগরিকের সঙ্গে খাচ্ছিলাম। আমাদের গন্তব্য কোথায়, কীভাবে এ জায়গা থেকে বের হতে হবে এসব ব্যাপারে না জেনে এখানে থাকাটা কত কঠিন তা নিয়ে কথা বলছিলাম। তখনই বিমান হামলার শব্দ শুনলাম আমরা। আমি মাটিতে পড়ে গেলাম এবং হামাগুঁড়ি দিতে লাগলাম। আমরা শুধু বললাম, ‘আমাদের বাঁচাও, আমাদের বাঁচাও’। আমরা দেয়ালের কাছে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকলাম। তখনই আবার আরেকটি হামলার শব্দ পেলাম। তাজুরায় ওই রাতে হামলার পর পরই তিনি কী দেখেছিলেন সেই বর্ণনা করতে গিয়ে নিহাল মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলেন, তারা সবাই মরে পড়েছিল, সবাই ছিল মৃত।

কোনো কর্তৃপক্ষই লিবিয়ার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। চরমভাবে অস্থিতিশীল দেশটির নিয়ন্ত্রণ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক এবং সামরিক গোষ্ঠীর হাতে। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে একটি প্রধানমন্ত্রীর সারাজের নেতৃত্বাধীন এবং অপরটি জেনারেল হাফতারের নিয়ন্ত্রণাধীন। গত চার দশক ধরে লিবিয়ার রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন জেনারেল হাফতার। ১৯৮০-এর দশকে মতবিরোধের জেরে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনের আগ পর্যন্ত গাদ্দাফির কাছের মিত্র ছিলেন তিনি।

২০১১ সালের আন্দোলনের পর দেশে ফিরে পূর্বাঞ্চলে নিজের শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলেন। সমর্থন পান ফ্রান্স, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের। গাদ্দাফি সংশ্লিষ্টতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় তার প্রতি মানুষের মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তবে বেনগাজি এবং এর আশপাশের এলাকাগুলো থেকে কথিত ইসলামপন্থি জঙ্গিদের বিতাড়িত করায় অনেকে তাকে কৃতিত্ব দেন। লিবিয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ত্রিপোলির নিয়ন্ত্রণ নিতে তিন মাস আগে সেখানে স্থল অভিযান ও বিমান হামলা শুরু করে খলিফা হাফতারের বাহিনী। তবে তাজুরা আটক কেন্দ্রে হামলার দায় অস্বীকার করেছে তারা।

গত শুক্রবার আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, এ সপ্তাহে তাজুরা আটককেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। হামলার ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া ৪০০ মানুষকে অন্য একটি আটককেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। সেটি খুব জনাকীর্ণ। লিবিয়াজুড়ে বিভিন্ন আটক কেন্দ্রে থাকা ৫ হাজারেরও বেশি অভিবাসী ও শরণার্থীকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য বরাবরই আহ্বান জানিয়ে আসছে এ দুই সংস্থা। আইওএম’র বিবৃতিতে বলা হয়, লিবিয়ার অন্যান্য আটক কেন্দ্রে আরো অনেক শরণার্থী ও অভিবাসী আটক রয়েছে। সেখানে তারা দুর্ভোগ পোহাচ্ছে ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি থেকে গেছে। বন্দিদের মুক্তির ব্যাপারে সম্ভাব্য সহযোগিতা সংক্রান্ত যথাযথ তথ্যসহ একটি নিরাপদ, ব্যবস্থাপনাকৃত প্রক্রিয়া সবার জন্য জরুরি।

আটক কেন্দ্রে থাকা অন্য অভিবাসন প্রত্যাশীদের মতো বাংলাদেশি তরুণ নিহালও সাগরপথে আটক হয়েছিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে পরিচালিত অভিযানের অংশ হিসেবে লিবীয় কোস্টগার্ড তাকে আটক করে মূল ভূখন্ডে ফিরিয়ে নিয়েছিল।

গত সপ্তাহে জাতিসংঘের ভূমধ্যসাগরীয় অভিবাসনবিষয়ক বিশেষ দূত ভিনচেন্ট কোশেটেল জানান, আটককেন্দ্রগুলোতে মানুষের জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় দেখেছেন তিনি। পরিস্থিতি দেখতে তার কাছে ১৯৯০-এর দশকে বসনিয়ায় ও ১৯৭০ এর দশকের শেষের দিকে কম্বোডিয়ার কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোর মতো মনে হচ্ছিল।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, আটককেন্দ্রগুলোর ভেতরে ধর্ষণ, নির্যাতন ও জোরপূর্বক সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়াসহ নানা নিপীড়ন চালানো হয়ে থাকে। নিহাল জানান, সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য টাকা জোগাড় করার চেষ্টায় অস্ত্র পরিষ্কারের কাজও মঞ্জুর করেছিলেন তিনি।

গত এপ্রিলে কাসর বিন গাশির নামক অভিবাসী আটক কেন্দ্রে অস্ত্রধারীদের হামলা হয়েছিল। হামলাকারীদের গুলিতে সেই সময় দুজন নিহত হন। ধারণা করা হয়, বিদ্রোহী নেতা খলিফা হাফতারের প্রতি আনুগত বাহিনী ওই হামলা চালিয়েছিল। ওই ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যান ২৭ বছর বয়সি ইরিত্রীয় নাগরিক মুনির। সেই সময়কার পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছিল না, আমরা জানতাম, রাতে মিলিশিয়াদের হাতে নারীরা ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঝুঁকি আছে।

স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে সুদান হয়ে লিবিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন মুনির। সেখান থেকে তাদের গ্রেফতার করে কাসর বিন গাশির আটক কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল। মুনির জানান, ক্যাম্প পাহারায় নিয়োজিত সেনারা এপ্রিলে জেনারেল হাফতার বাহিনীর অভিযান শুরুর পর পরই পালিয়েছিল। তিনি বলেন, পাঁচদিন ধরে আমরা একাছিলাম, সঙ্গে খাবার ছিল না, পানি ছিল খুবই সামান্য পরিমাণে। বাচ্চাদের শুধু পানি আর চিনি খেতে দিয়েছিলাম। তিনি আরো জানান, এক সপ্তাহের মধ্যে একদল সশস্ত্র ব্যক্তি অরক্ষিত ওই ক্যাম্পে ঢুকে পড়েছিল, টাকা আর মোবাইল চাইছিল তারা। হঠাৎ করে পরিস্থিতি খুবই বাজে হয়ে উঠল।

‘খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের একটি দল প্রার্থনা করছিল, সশস্ত্ররা তাদের প্রার্থনা থামাতে বলেছিল। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ওইসব মানুষ তাতে সায় দেয়নি। এরপর অস্ত্রধারীরা ছাদ লক্ষ্য করে এক নাগাড়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে। এতে কয়েকজন আহত হন। ওই সময়ের মধ্যে অনেকে নিখোঁজ হন। আমরা জানি না তাদের কী হয়েছিল। তারা কী পালাতে পেরেছিলেন নাকি সেনাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে সম্মুখযুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল, বলেন মুনির। বর্তমানে মুনির ও তার পরিবারকে ত্রিপোলিতে লিবিয়ান রেড ক্রিসেন্ট ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। তবে তিনি জানিয়েছেন, এখনো নিরাপদ বোধ করেন না। মুনির বলেন, তারা বলেছেন, আমরা এখানে নিরাপদ, তবে এ দেশে আমাদের জন্য নিরাপদ কোনো জায়গা নেই।

"