এম এ রউফ, সিলেট

  ২৪ জুন, ২০১৮

সিলেটে উধাও খেলার মাঠ শিশুরা ঝুঁকছে গেমে

গত ২০ বছরে সিলেট নগর থেকে হারিয়ে গেছে অনেকগুলো খেলার মাঠ। এতে সংকুচিত হয়ে গেছে কিশোর যুবকদের খেলাধুলার সুযোগ। ফলে খেলাধুলার সুযোগ ছাড়া চার দেয়ালের মাঝে বেড়ে উঠছে একটি নতুন প্রজন্ম, তারা ঝুঁকছে স্মার্টফোন আর কম্পিউটারের গেমে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে ব্যাহত হচ্ছে প্রজন্মের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ।

সিলেট নগরের প্রতিটি মহল্লায় ছিল ছোট-বড় খেলার মাঠ। সিলেট জেলা স্টেডিয়াম ছাড়াও বড় পরিসরের খেলার মাঠ ছিল সিলেট রেজিস্টারি মাঠ, সিলেট পুলিশ লাইনস মাঠ, আলিয়া মাদরাসা মাঠ, সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ মাঠ, কালাপাথর মাঠ, এমসি কলেজ মাঠ, শাহী ঈদগাহ খেলার মাঠ, কয়েদির মাঠ অন্যতম। এ ছাড়াও পাড়া-মহল্লার মাঠগুলোর মধ্যে লালদীঘির পাড় গাছতলা মাঠ, বর্ণমালা স্কুল মাঠ, লালমাটিয়া মাঠ, মজুমদার বাড়ির মাঠ, বাগবাড়ী এতিম স্কুল মাঠ, পীর মহল্লার সৈয়দ জিলকদর আলীর মাঠ, বাদাম বাগিচা মাঠ, প্রাইমারি টিচার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট মাঠ, রাজবাড়ী খেলার মাঠ, ছড়ারপার খেলার মাঠ, গলফ ক্লাবের মাঠ, আম্বরখানা সরকারি কলোনির মাঠ অন্যতম। এসব মাঠের অনেকগুলোই এখন কেবল স্মৃতি।

এমন একটা সময় ছিল, যখন বিদ্যালয় বলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠত ছোট-বড় পাকা-আধপাকা দালান, মাঝখানে বড়সড় খেলার মাঠ। সেখানে ছিল শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা দৌড়াদৌড়ি আর কোলাহল। নানা বয়সী মানুষের

হাঁটাচলা। কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদ দিলে স্কুলের এই চিরায়ত চিত্র সিলেট নগরে বিলীন হয়ে গেছে। বাণিজ্যিক ভবনে চলছে স্কুলের কার্যক্রম। ছোট ছোট শ্রেণিকক্ষে চলছে ক্লাস। অনেক ক্ষেত্রেই নেই ছোট্ট আঙিনাটুকুও। শুধু স্কুল নয়, সিলেট নগর থেকেই হারিয়ে গেছে খেলার মাঠ। একসময় মহল্লার মাঠে বিকেল হলেই নানা বয়সী মানুষ আসত। এক ধরনের মিলনমেলায় পরিণত হতো খেলার মাঠ। বয়স্করা হাঁটতেন, কিশোর যুবকরা খেলাধুলা করত। এখন সেই প্রাণ নেই কোথাও। মাঠগুলো দখল করে দালান তৈরি শুরু হয়েছে অনেক আগেই। অবশিষ্ট যে কয়েকটি বাকি এখনো তাতে লোলুপ দৃষ্টি ভূমিখেকোদের। ফলে চার দেয়ালের বৈচিত্র্যহীন পরিবেশে বেড়ে উঠছে আমাদের নতুন প্রজন্ম।

স্কুল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিধি অনুযায়ী, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বেলায় নগর এলাকায় দশমিক ২৫ একর, পৌর ও শিল্প এলাকায় দশমিক ৩০ একর, মফস্বল এলাকায় দশমিক ৭৫ একর জমি থাকা আবশ্যক। কিন্তু এ নিয়মের তোয়াক্কা না করেই সিলেটের বেশির ভাগ স্কুল গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে শিক্ষা বাণিজ্যের চিন্তা থেকে বাসা-বাড়িতে স্কুল-কলেজ গড়ে ওঠায় শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে মুক্ত আকাশ এবং সবুজ খেলার মাঠ থেকে। গত দুই দশকে সিলেট নগরে গজিয়ে উঠা ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যমের বেসরকারি স্কুলগুলোতে খেলার মাঠ তো দূরের কথা সেখানে ছোট্ট আঙিনাটুকুও নেই। সরেজমিন দেখা গেছে, নগরের ওসমানী মেডিকেল খেলার মাঠে গড়ে তোলা হয়েছে নার্সিংহোম ও ইন্টার্ন আবাসিক ভবন, সিলেট রেজিস্টারি মাঠ কয়েক দশক ধরে হকারদের দখলে চলে গেছে, পুলিশ লাইনস মাঠে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করে ফেলায় সাধারণের ব্যবহারের সুযোগ নেই। নগরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে থাকা সিলেট আলিয়া মাদরাসা মাঠে বছরজুড়ে ওয়াজ মাহফিল, বৃক্ষমেলা, সভা-সমাবেশ হওয়ায় খেলার সুযোগ থাকছে না। নগরের ইলেকট্রিক সাপ্লাই এলাকার পার্শ্ববর্তী কালাপাথর মাঠের আকার বিশাল ছিল। এখানে নগরের বিভিন্ন ক্লাব অনুশীলন ছাড়াও পাড়া-মহল্লার দলগুলোর অংশগ্রহণে বিভিন্ন ধরনের ফুটবল টুর্নামেন্ট হতো বছরজুড়ে। ভূমিখেকোদের দখল চেষ্টা মোকাবিলা করে স্থানীয়রা মাঠটি টিকিয়ে রাখলেও আগ্রাসনে ছোট হয়ে এসেছে মাঠের আকৃতি। নগরের মাছিমপুরস্থ কয়েদির হাওর মাঠ লিজ নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবনসহ নানা স্থাপনা। মাঠের আয়তন ছোট হয়েছে তাতে। টিকে থাকা এমসি কলেজের মাঠই এখন ক্রীড়াপ্রেমীদের শেষ আশ্রয়স্থলগুলোর একটি। যদিও এখানে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো না থাকায় বর্ষার সময় পানি জমে খেলার অনুপযুক্ত হয়ে যায়। এ ছাড়া নগরের শাহী ঈদগাহ খেলার মাঠে কয়েক বছর ধরে নিয়ম করে এখানে মাসব্যাপী বাণিজ্যমেলা আয়োজন করছে সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স। এ ছাড়া প্রতি বছর কোরবানী ঈদের আগে এখানে বসানো হয় পশুরহাট। এসব কারণে মাঠটিতে সম্ভব হয় না খেলাধুলার। এই মাঠটি মিনি স্টেডিয়ামে রূপান্তরের ঘোষণা হলেও তা কার্যকরা হয়নি। একসময়ের জমজমাট নগরের মজুমদারির মজুমদারবাড়ির মাঠ দখল হয়ে গেছে এক যুগের বেশি সময় আগে। নগরের পীরমহল্লার সৈয়দ জিলকদর আলীর মাঠে দালান তুলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল। পিটিআই এর মাঠ দেয়াল তুলে প্রবেশাধিকার সংরক্ষণ করে ফেলায় এখানে আর খেলাধুলার সুযোগ থাকেনি সাধারণদের। লাক্কাতুরা চা বাগানের অভ্যন্তরে থাকা গলফ ক্লাবের মাঠেও প্রাচীর তুলে দেওয়া হয়েছে। আম্বরখানা কলোনির বিশাল মাঠ টিলা কাটা আর দখলে ক্রমেই সংকুচিত হয়ে এসেছে। ঠিক একইভাবে বাদাম বাগিচার মাঠ, ছড়ারপার খেলার মাঠ, রাজবাড়ি খেলার মাঠ, লালদীঘিরপার গাছতলা মাঠসহ বেশির ভাগ মাঠে দালানসহ নানা স্থাপনা তুলে ফেলায় এগুলো এখন নগরের বয়োজ্যেষ্ঠদের মনের কোণে থাকা কেবলই স্মৃতি।

সিলেটের প্রথম বিভাগের ক্লাব ইলেভেন ব্রাদাসের সাধারণ সম্পাদক ও সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস চৌধুরী রুহেল বলেন, ‘আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে একটাই চিন্তা ছিল কতক্ষণে মাঠে গিয়ে পৌঁছাব। বিকেলে মাঠে গিয়ে খেলার যে আনন্দ, উন্মাদনা সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই এখনকার ছেলেমেয়েদের।’ তিনি আরো বলেন, ‘পড়াশোনার চাপ, অবসরে কম্পিউটার বা মোবাইলে গেম খেলাই শিশু-কিশোরদের বিনোদন। এতে করে তাদের স্বাভাবিক বিকাশ হচ্ছে না বলেই আমার মনে হয়।’

সিলেট জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সিলেটের ১২ উপজেলায় ৬০৫টি সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় খেলার মাঠ নেই। এর মধ্যে সিলেট সদর উপজেলায় ১৩৯, দক্ষিণ সুরমায় ৬৩, ফেঞ্চুগঞ্জে ১৯, বালাগঞ্জে ৫২, বিশ্বনাথে ৪৭, গোলাপগঞ্জে ৫৩, বিয়ানীবাজারে ৬৫, গোয়াইনঘাটে ৩৭, জকিগঞ্জে ৪৯, কানাইঘাটে ৩৮, কোম্পানীগঞ্জে ২১ ও জৈন্তাপুর উপজেলায় ২২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে; যার মধ্যে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনুমতিপ্রাপ্ত ৬৬, স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ১৫৩ এবং এমপিওভুক্ত ৩৮৬ বিদ্যালয় রয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের আহ্বায়ক ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বহুতল ভবনের চার দেয়ালের মধ্যে বেড়ে উঠছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। যারা স্কুলেও সুযোগ পাচ্ছে না দুচোখ ভরে আকাশ দেখার, খোলা বাতাসে প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার কিংবা খেলার মাঠে ছুটে বেড়ানোর। ফলে তাদের পৃথিবী হয়ে যাচ্ছে চার দেয়ালে বন্দি।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist