গাজী শাহনেওয়াজ

  ১৫ জুলাই, ২০১৯

এরশাদের সম্পদ কত?

উত্তরাধিকারী কারা

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (ফাইল ছবি)

সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আর নেই। মৃত্যুর আগে তিনি নিজের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ট্রাস্ট করে দিয়েছেন। আবার স্বাক্ষর জাল করে অন্য কেউ তার সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে পারেন বলেও তিনি থানায় জিডি করেছিলেন। সব মিলিয়ে মৃত্যুর আগপর্যন্ত এরশাদ ছিলেন আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আর তাই সাধারণের মনে প্রশ্ন উঠেছে, কত সম্পদের মালিক এই এরশাদ?

পরিবার ও ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, ক্ষমতা ছাড়ার পর কোনো সম্পদ নেই বলে আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করেন এরশাদ। যার টিআইএন নং-১০৮-১০৬-০৬৩৯/সার্কেল ৮৯ কোম্পানি। কিন্তু খেয়ালের বসে তিনি রিটার্নে কোনো অর্থ না দেখালেও হঠাৎ ২ লাখ টাকার রিটার্ন দেখিয়ে তাৎক্ষণিক তা আবার তুলে নেন। এই তথ্যের গোপনীয়তার কারণে ওই সময়ে এক মামলায় তার ৫ বছরের জেল হয়। ৯ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা এরশাদের কোনো সম্পদ নেই—এর কারণ অনুসন্ধানে পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টের বিচারপতির সমন্বয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যার সমন্বয়ক করা হয় সাবেক বিচারপতি ডি এম আনসার উদ্দীনকে। কমিটি তদন্ত অনুসন্ধানে এরশাদের গোপন সম্পদের হদিস পায়। ওই কমিটি প্রতারণার আশ্রয় নেয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধারায় ৭৩টি মামলা করে। এসব মামলার মধ্যে কয়েকটিতে খালাস এবং অনেক মামলা বিচারাধীন রয়েছে।

জীবন সায়াহ্নে এসে হঠাৎ সম্পদের ট্রাস্ট গঠন করে আবারো আলোচিত হন সাবেক এই রাষ্ট্রপ্রধান। দেখা গেছে, ২০১২ সালে ইউনিয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে ৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। পরে ৪০ কোটি টাকার ৩৫ শতাংশ শেয়ার হিসেবে ১৪ কোটি টাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ট্যাক্স ফাইলে জমা দিয়ে ওই ব্যাংকের পরিচালক হন।

এর আগে ব্যবসা হিসেবে রংপুরে একটি কোল্ডস্টোরেজ তৈরি করেন। ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে ‘পদাগঞ্জ কোল্ডস্টোরেজ লিমিটেড’ নামের প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে ব্যাংকের সম্মতিতে স্বত্বাধিকারী হিসেবে সাদ এরশাদ, জাবিন এরশাদ ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ—এই তিনজন কোম্পানি থেকে অব্যাহতি নেন। ২০১০ সালে সাব-কবলা দলিল করে সেখান থেকে চিরতরে নিঃস্বার্থবান হন।

এদিকে রংপুরে পৈতৃক সম্পত্তি সেনপাড়ায় ১৯ শতক জমির অংশীদার এরশাদসহ ৪ ছেলে ও ৫ মেয়ে। সেখানে বসবাস করছেন পরিবারের মেজো ছেলে মোজাম্মেল হক লালু ও ভাতিজা আসিফ। কিন্তু এরশাদ এই পৈতৃক সম্পত্তি ট্রাস্টের সম্পদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, এরশাদ এ ব্যাপারে ভাই-বোনদের কাছ থেকে তা লিখিত নিয়েছেন।

২০১৯ সালের মার্চে ট্রাস্টের অনুকূলে এ সম্পদ হস্তান্তর করলেও এ সম্পত্তিতে একটা দেওয়ানি মামলা আদালতে বিচারাধীন আছে বলে এরশাদের ঘনিষ্ঠজনদের সূত্রে জানা গেছে—যার মামলা নং-৮৮/১২। একইভাবে এই সম্পত্তি রংপুরে থাকলেও ঢাকার তেজগাঁওয়ে গুলশান সার্কেলের রেজিস্ট্রেশন অফিসের অধীনে ট্রাস্ট দলিল করা হয়েছে যাতে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে বলে একাধিক সূত্র দাবি করেছে।

কারণ হিসেবে সূত্র জানিয়েছে, এরশাদ তার শাসনামলে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে একটা আইন করেছিলেন। সেখানে বলা আছে, সংশ্লিষ্ট এলাকার রেজিস্ট্রি অফিসে জমি ক্রয়-বিক্রয় করতে হবে। এক্ষেত্রে এরশাদ নিজের আইন লঙ্ঘন করেছেন। একই প্রক্রিয়ায় রংপুরের দর্শনায় ১ একর অর্থাৎ ৩ বিঘা জমি ছাড়াও তৎকালীন ডিসি অফিস থেকে আরো ১৩ শতক জমি নেন এরশাদ। এসব জমিতে একটি ছয়তলা ও একতলা একটি ভবন আছে। এ সম্পত্তিও ট্রাস্টে দান করেছেন এরশাদ।

এছাড়া এরশাদের আরো সম্পদের মধ্যে বনানীর ইউএই শপিং কমপ্লেক্সের ৪৪নং দোকানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এটি ট্রাস্টের মাধ্যমে বিক্রির জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চুক্তিপত্র অনুযায়ী দেড়কোটি টাকা নেন তিনি। অথচ ট্রাস্টে ওই দোকানটির মূল্য দেখানো হয়েছে ৭৭ লাখ টাকা।

বারিধারার দূতাবাস রোডে প্রেসিডেন্ট পার্কে ছয়তলায় এরশাদের একটি ফ্ল্যাট আছে। এ ফ্ল্যাটটির আয়তন ৭০৪২ স্কয়ার ফিট যা ট্রাস্টে উল্লেখ করা হয়। অথচ ওই ফ্ল্যাটটি রাজউকের অনুমতি নিয়ে ২০০৩ সালের ২৩ আগস্ট ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখেন। যার মর্গেজ দলির নং-১২৯৬/৮/১১/২০০৩। বনানীর বাড়ি-১৫, রোড-১৬তে ১৪৯৭ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার মূল্য দেখানো হয় ৪৯ লাখ টাকা, গুলশানের বাড়ি-০৪, রোড-৯৬’তে ফ্ল্যাট-বি-২১৭১ বর্গফুটের আরেকটি ফ্ল্যাট রয়েছে সাবেক এই সেনাপ্রধান ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের। এছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে এফডিআর আছে আনুমানিক ৪০ কোটি টাকা এবং নিজের নামে ১৮ কোটি টাকা। ব্র্যাক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে ডিপিএস রয়েছে ৯ লাখ টাকা করে দুটি। এছাড়া ব্র্যাক ব্যাংকে ৪৪ কোটি ১০ লাখ টাকা ও জনতা পাবলিকেন্স লিমিটেডে এরশাদের শেয়ার রয়েছে ৫০ হাজার টাকার।

শিক্ষাজীবন থেকে সামরিক বাহিনীর চাকরিতে চমক সৃষ্টি করা এরশাদ রাজনীতিতেও কম যাননি। জাতীয় পার্টি গঠনের পর থেকে দল নিয়ে কখনো তিনি সংসদ থেকে দূরে থাকেননি। এখনো নিজ দলে সময়ে অসময়ে নেতাকর্মীদের বহিষ্কার করে পদে পুনর্বহাল করে আলোচনায় রয়েছেন তিনি। সেই অর্থে বলা যায়, সামরিক বাহিনী থেকে সেনাপ্রধান হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের মধ্যে এরশাদের নাম রয়েছে সবাই ওপরে। বিএনপি রাজনীতি থেকে দূরে থাকার কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তার দল জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের আসনে বসেছে। এটাও এরশাদের জন্য বিরল অর্জন বলে মনে করছেন তার ঘনিষ্ঠজনদের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যরা।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
এরশাদ,সম্পদ,জাতীয় পার্টি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close